চাষী নজরুল ইসলাম
সেলুলয়েডে জায়গা পেয়েছে মুক্তিযুদ্ধ ও সাহিত্য

কাগজ ডেস্ক
প্রকাশ: ২৬ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

চাষী নজরুল ইসলাম
বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে
উজ্জ্বল একটি নাম চাষী নজরুল ইসলাম। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে চলচ্চিত্র নির্মাণের অন্যতম কাণ্ডারিও তিনি। গুণী এ নির্মাতার জন্মদিন ছিল ২৩ অক্টোবর।
১৯৪১ সালের এইদিনে জন্ম নেয়া চাষী তার জীবদ্দশায় ৩৫টির মতো চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। প্রতিটি চলচ্চিত্রই ছিল দর্শকনন্দিত। চলচ্চিত্র নির্মাতার জন্মদিন স্মরণ করে তার আলোচিত পাঁচটি চলচ্চিত্রের বিস্তারিত জানাচ্ছে মেলা
ওরা ১১ জন
স্বাধীনতার পর মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে প্রথম চলচ্চিত্র ‘ওরা ১১ জন’। চাষী নজরুল ইসলাম ছিলেন এই চলচ্চিত্রের পরিচালক। মাসুদ পারভেজের (সোহেল রানা) প্রযোজনায় এই চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছিলেন নায়করাজ রাজ্জাক, খসরু, শাবানা, এ টি এম শামসুজ্জামান, খলিলুল্লাহ খান, সৈয়দ হাসান ইমামসহ আরো অনেকে। ১৯৭২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত এই চলচ্চিত্র শ্রেষ্ঠ হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও পেয়েছিল। সদ্য যুদ্ধ ফেরত কয়েকজন অভিনেতাকে নিয়ে চাষী নজরুল ইসলাম তৈরি করেছিলেন তার জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। মুক্তিযুদ্ধে নারীর অংশগ্রহণও তুলে ধরেছিলেন তিনি এই চলচ্চিত্রে। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের কিছুটা অংশও পাওয়া যায় এই চলচ্চিত্রে। যেন মুক্তিযুদ্ধকে ভুলে না গিয়ে তার ইতিহাসকে বহন করে নিয়ে যেতে পারে স্মৃতিচারণের মাধ্যমে, সে কারণেই রুপালি পর্দায় মুক্তিযুদ্ধকে বন্দি করেছিলেন চাষী নজরুল ইসলাম।
শুভদা
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর উপন্যাস অবলম্বনে চাষী নজরুল ইসলাম তৈরি করেছিলেন ‘শুভদা’। রাজ্জাক, বুলবুল আহমেদ, আনোয়ারা, জিনাত প্রমুখের অভিনয়ে এই চলচ্চিত্রে মুক্তি পায় ১৯৮৬ সালে। গ্রামের এক দরিদ্র পরিবারের গল্প নিয়ে এগিয়েছে শুভদার কাহিনি। জুয়া ও গাঁজায় আসক্ত হারান, তার স্ত্রী শুভদা, দুই কন্যা ললনা ও ছলনা, অসুস্থ ছেলে মাধব আর এক বিধবা বোনকে নিয়ে হারানের সংসার। গল্পে আরো আছে সদানন্দ, সারদার নামে আরো কিছু চরিত্র। নানা টানাপড়েনের ঘটনা নিয়ে আবর্তিত হয়েছে ‘শুভদা’র কাহিনি। চাষী নজরুল ইসলামের এই চলচ্চিত্র ১৯৮৬ সালের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্করে শ্রেষ্ঠ অভিনেতা, অভিনেত্রী, পরিচালক, প্রযোজক, সংগীত পরিচালকসহ পুরস্কার পায় ১১টি বিভাগে।
হাঙর নদী গ্রেনেড
প্রখ্যাত সাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের ১৯৭৬ সালে প্রকাশিত উপন্যাস ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ নিয়ে চাষী নজরুল ইসলাম তৈরি করেন তার বিখ্যাত চলচ্চিত্র ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে করা চাষী নজরুল ইসলামের আরেকটি অসাধারণ চলচ্চিত্র বলে বিবেচিত এই ছবিটি। সোহেল রানা, সুচরিতা, অরুণা বিশ্বাস প্রত্যেকে তাদের চরিত্রকে ফুটিয়ে তুলেছিলেন তাদের অভিনয় নৈপুণ্যের মাধ্যমে। বুড়ির চরিত্রে সুচরিতার দুই মুক্তিযোদ্ধাকে বাঁচাতে নিজের সন্তানকে পাকিস্তানিদের হাতে তুলে দেয়ার দৃশ্য আজো মানুষকে কাঁদায়। এই চলচ্চিত্র চাষী নজরুল ইসলামকে ২২তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে আবারো শ্রেষ্ঠ পরিচালকের পুরস্কার এনে দেয়।
হাছন রাজা
মরমি সাধক হাছন রাজার জীবন ও কর্ম নিয়ে ২০০২ সালে চাষী নজরুল ইসলাম তৈরি করেন ‘হাছন রাজা’। নাম ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন হেলাল খান। বিনোদিনীর চরিত্রে ছিলেন শমী কায়সার। সিলেট অঞ্চলের জমিদারপুত্র হাছন রাজাকে নিয়ে নির্মিত চাষী নজরুল ইসলামের এই চলচ্চিত্রও অর্জন করেছিল শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রসহ ছয়টি জাতীয় পুরস্কার।
শাস্তি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোট গল্প ‘শাস্তি’ অবলম্বনে ২০০৪ সালে মুক্তি পায় ইমপ্রেস টেলিফিল্মের প্রযোজনায় চাষী নজরুল ইসলামের চলচ্চিত্র ‘শাস্তি’। রিয়াজ, পূর্ণিমা, ইলিয়াস কাঞ্চন ও চম্পার অসাধারণ অভিনয় আর চাষী নজরুলের নির্মাণশৈলীতে ‘শাস্তি’ সেসময় দারুণ জনপ্রিয় হয়। গ্রামের দুই ভাইয়ের সংসারের অভাব-অনটন, তাদের দুই স্ত্রীর নিত্যদিনের ঝগড়া আর গল্পের শেষে দুই বৌয়েরই করুণ পরিণতি নিয়ে ‘শাস্তি’র গল্প। এই চলচ্চিত্রে আরো অভিনয় করেছিলেন শহিদুল আলম সাচ্চু, এ টি এম শামসুজ্জামান, আহমেদ শরীফ প্রমুখ। এই চলচ্চিত্রের মাধ্যমেই জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ২০০৪ এ শ্রেষ্ঠ পার্শ্ব অভিনেতা ও অভিনেত্রীর পুরস্কার পেয়েছিলেন ইলিয়াস কাঞ্চন ও চম্পা।
চাষী নজরুল ইসলাম মৃত্যুর আগ পর্যন্ত চলচ্চিত্রের কাজ করে গেছেন। তার অন্যান্য বিখ্যাত চলচ্চিত্রের মধ্যে আছে ‘বেহুলা লক্ষিন্দর’, ‘দাঙ্গা ফাসাদ’, ‘মেঘের পরে মেঘ’, ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা’, ‘সুভা’ প্রভৃতি। ২০১৫ সালের ১১ জানুয়ারি তিনি পাড়ি জমান অনন্তলোকে।
১৯৮২ সালে বুলবুল-কবরী-আনোয়ারাকে নিয়ে ‘দেবদাস’ নির্মাণ করেছিলেন তিনি। ২০১৩ সাল এসে শাকিব খান-অপু বিশ্বাস-মৌসুমীকে নিয়ে তিনি আবারো বানান সিনেমাটি। চাষী নজরুল ইসলাম সব মিলিয়ে ৩৫টির মতো ছবি নির্মাণ করেন। এর মধ্যে ছয়টি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক।
জানা যায়, ১৯৫৭ সালের দিকে পিতা মুসলেহ উদ্দিনের মৃত্যুর পর সংসারে বড় ছেলে হিসেবে সব দায়িত্ব তার কাঁধে এসে পড়ে। এ সময় তিনি এজি অফিসে অফিসের পোস্ট-সর্টার হিসেবে ১৯৬৯ পর্যন্ত চাকরি করেন। এফডিসি মাত্র তখন গড়ে উঠছে। আউয়াল সাহেব বিখ্যাত সিনেমা করিয়ে ফতেহ লোহানীর প্রধান সহকারী। চাষী চাকরির ফাঁকে ফাঁকে তার সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন, একই সঙ্গে শুরু করলেন নাটক। আলী মনসুরের কৃষ্টি সংঘের সঙ্গে কাজ করেন মঞ্চে অভিনয় করেন। এদিকে চাষীর সিনেমা প্রীতিটা জানতেন তার খালাতো বোনের স্বামী সৈয়দ আওয়াল। একদিন সুযোগ মতো চাষীকে তিনি পরিচয় করিয়ে দিলেন পরিচালক অভিনেতা ফতেহ লোহানীর সঙ্গে। ফতেহ লোহানী তখন ‘আছিয়া’ করছিলেন। চাষীকে ছোট্ট একটা রোল করার জন্য নিয়েছিলেন। কিন্তু ফতেহর নির্দেশে পরদিন সহকারী পরিচালকের দায়িত্ব দেয়া হয়। ১৯৬১’র জুন মাসে চাষী কাজ শুরু করলেন। এরপর ১৯৬৩-তে কাজ করেছেন প্রখ্যাত সাংবাদিক ও চলচ্চিত্রকার ওবায়েদ-উল-হকের সহকারী হিসেবে দুই দিগন্ত ছবিতে। এভাবে কাজ করতে করতে এলো ১৯৭১। মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিলেন। তারপর যুদ্ধশেষে বাংলাদেশের প্রথম মুক্তিযুদ্ধভিক্তিক চলচ্চিত্র ‘ওরা ১১ জন’ নির্মাণ করলেন। ১৯৭২ সালে এই ছবির মাধ্যমে পরিচালক হিসেবে চাষী নজরুলের আত্মপ্রকাশ ঘটে।