বাংলা সিনেমায় ধর্ষিতা নারীর আর্তনাদ

কাগজ ডেস্ক
প্রকাশ: ২৪ আগস্ট ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ছবি: সংগৃহীত
মনে পড়ে ‘একদিন প্রতিদিন’ ছবির সেই বড় মেয়ের কথা! যে পরিবারে বট গাছের মতো। সেই একমাত্র রোজগেরে মুখ বড় সংসারে। কিন্তু সেই বড় মেয়ে (মমতা শঙ্কর) একদিন সকালে অফিসের জন্য বেরিয়ে আর রাতে বাড়ি ফেরে না। ভাড়া বাড়ির সব পরিবার আতঙ্কের মধ্যে পড়ে যায়। শেষ অবধি মেয়েটি বাড়ি ফেরে কিন্তু এক রাত কাটিয়ে। তারপর সমাজের চোখে মেয়েটির কী অবস্থান হয় তা আর মৃণাল সেন বলে দেননি! কিন্তু কৌতূহলী প্রতিবেশীদের চোখে মেয়েটি অপরাধী হয়ে যায়। সেটা ছিল ১৯৮০ সাল। এখন ২০২৪।
আজো মেয়েরা রাত করে বাড়ি ফিরলে একাংশের চোখে অপরাধী হয়ে যায়। রাতে বাইরে মানেই খারাপ মেয়ে! আসলে ২০২৪-এ দাঁড়িয়ে আজো মেয়েদের জন্য শহর নিরাপদ নয়। ধর্ষণ, শ্লীলতাহানির আতঙ্ক আজও মেয়েদের তাড়া করে নিয়ে বেড়ায়। ইতিমধ্যে চলছে মা দুর্গা আসার দিন গোনা। কিন্তু তার মধ্যেই কলকাতা শহরে ঘটে গিয়েছে ভয়াবহ ধর্ষণ। মহিলা চিকিৎসক ধর্ষিত হয়ে খুন হলেন তার কর্মস্থলে, সরকারি হাসপাতালে। এই ঘটনায় টালিউডের অভিনেত্রী থেকে শুরু করে সমাজের সব স্তরের নারীরা স্বাধীনতা দিবসের সন্ধিক্ষণে রাস্তায় নেমে রাত দখল করার ডাক দিয়েছেন।
বহু নারী এগিয়ে এলেও অনেকেই ভয় পাচ্ছেন, রাতের শহরে জমায়েত করতে গিয়ে আরো কিছু নারীর শ্লীলতাহানি ঘটবে না তো! তার দায় কে নেবে! চলছে নানা জল্পনা-কল্পনা। তবু এ শহরের মেয়েরা রাতে রাস্তায় থাকবেন জেগে। এমন নানা সত্য ঘটনা অবলম্বনে ধর্ষণ কাহিনি নিয়ে সাহিত্যিকরা যেমন কলম ধরেছেন, তেমন বাংলা ছবিতেও ধর্ষিতা নারীর আর্তনাদ শোনা গেছে বারবার।
‘আলো আমার আলো’ ছবিতে গাড়ির মধ্যে হওয়া সুচিত্রা সেনের ওপর বঙ্কিম ঘোষের অত্যাচার কিংবা ‘বাঘিনী’ সন্ধ্যা রায়ের গ্রাম্য ভিলেন রবি ঘোষের বিরুদ্ধে কাটারি হাতে রুখে দাঁড়ানো- বাংলা ও হিন্দি ছবিতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে নায়িকাকে ভিলেনের হাত থেকে বাঁচাতে নায়কের অ্যাকশনধর্মী আবির্ভাব। ঠিক সেই দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের সময় শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাবের ফর্মুলা। কিন্তু বাস্তবে একজন কৃষ্ণও এগিয়ে আসে না এ যুগের পাঞ্চালিদের উদ্ধার করতে।
১৯৮২ সালে ধর্ষণকেন্দ্রিক গল্প নিয়ে বাংলায় প্রথম বিপ্লব ঘটান তপন সিনহা। ‘আদালত ও একটি মেয়ে’। তরুণী স্কুলশিক্ষিকা উর্মিলা তার আরো দুই সহকর্মী শিক্ষিকার সঙ্গে ট্রেনে করে গোপালপুর ঘুরতে যান। ট্রেনের ভেতরেই শুরু হয় তাদের উত্ত্যক্ত করা। কালপ্রিট ক্ষমতাশালী বড়লোকের চার মদ্যপ যুবক। ট্রেন থেকে নেমেও নিস্তার মেলে না। বখাটে ছেলেগুলো মেয়ে তিনটিকে ফলো করতে থাকে। যদিও তাদের লক্ষ্য উর্মিলা (তনুজা করেছিলেন যে চরিত্রটি)। শেষমেশ চার যুবক সমুদ্রের ভেতর টেনে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করে উর্মিলাকে। সমুদ্রের ভেতর হাড়হিম দৃশ্য রচনা করেন তপন সিনহা।
হাসপাতালে থেকে কলকাতায় ফেরে মেয়ে। ছিছিক্কার পড়ে যায়। মেয়েটির বাবা (পতঞ্জলি গুহঠাকুরতা) সমাজের সজ্জন মানুষ। বাবা আর মেয়ের শান্তির সংসারে নেমে আসে কালো মেঘ। সবার এক প্রশ্ন, ‘আপনার রেপড মেয়ে কেমন আছে?’ শেষমেশ ক্লান্ত পিতা অফিসের ডেস্কে লিখে রাখেন, ‘আমার ধর্ষিতা কন্যা ভালো আছে!’ এই একটা লাইন দেখিয়ে যেন তপন সিনহা সমাজের নির্লজ্জতার গায়ে চাবুক মারেন। কারণ সমাজ সংসারে উর্মিলাই হয়ে যায় অপরাধী। তার স্কুলের চাকরি অবধি চলে যেতে বসে। অথচ বড়লোক বাপের ছেলেরা কতটুকু শাস্তি পায়? তবু ‘আদালত ও একটি মেয়ে’ ছবির শেষ দৃশ্য মন ভালো করে দেয়, যখন স্কুলের ছোট ছোট ছাত্রীরা তাদের উর্মিলাদিকে স্কুল ছাড়তে দেয় না।
১৯৯২ সালে রাতের কলকাতায় টালিগঞ্জ মেট্রো স্টেশনে এক দল ক্ষমতাশালী পরিবারের যুবকের দ্বারা নিগৃহীতা হয় একটি গৃহবধূ। স্বামীর সঙ্গে থাকলেও মেয়েটি পার পায় না। সেই মুহূর্তেই যখন পথ চলতি সব পুরুষ গা বাঁচিয়ে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তখন আর একটি মেয়েই ছুটে গিয়ে নিগৃহীতা মেয়েটিকে উদ্ধার করে। কলকাতার বুকে ঘটা এই সত্য ঘটনা নিয়ে ‘দহন’ উপন্যাস লেখেন সাহিত্যিক সুচিত্রা ভট্টাচার্য। উপন্যাসটি নিয়ে ঋতুপর্ণ ঘোষ ১৯৯৭ সালে ‘দহন’ নামে চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেন।
প্রতিটি খবরের পাতায় ছাপা হয় এক স্কুল শিক্ষিকার বীরত্বের কথা। ‘স্কুল শিক্ষিকা শ্রবণা সরকারের সাহসিকতায় শ্লীলতাহানি থেকে রক্ষা পেল গৃহবধূ রমিতা।’ রমিতা চরিত্রে ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত এবং শ্রবণার চরিত্রে ইন্দ্রানি হালদার শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর যুগ্ম জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিলেন সে বার। কিন্তু আদৌ তো শ্রবণাদের জয় হয় না সমাজে। ‘লোকে কী বলবে’ এই ভয়ে চেপে যেতে বলা হয়।
ঠিক যেমন শ্রবণাকে আদালত চত্বরে রমিতার বাবা বলেছিলেন, ‘শ্বশুরবাড়ি বলে একটা জিনিস আছে, জানো তো মা। তোমার তো বিয়ে হয়নি তাই এখন বুঝবে না। রমিতা অনেক চেষ্টা করেছিল, কিন্তু ওরা ওকে বলতে দেয়নি। হাজার হোক বিয়ে তো! তুচ্ছ কারণে সেটা ভেঙে দেয়া যায় না!’ ধর্ষকদের শাস্তি সমাজের চোখে ‘তুচ্ছ ছোট ঘটনা’ বটে!
নয়ের দশকে স্কুল শিক্ষিকার ওপর গণধর্ষণ নিয়ে শতরূপা সান্যালের ‘অনু’ ছবিটিও সাড়া ফেলেছিল। শতরূপার একমাত্র সুপারহিট ছবি। ধর্ষিতার চরিত্রে এখানে ইন্দ্রানি হালদার। ব্যান্ডেজ বাঁধা শরীরে ইন্দ্রানির পোস্টারে শিউরে উঠেছিল কলকাতা শহরতলি। ‘দহন’ হিট করাতে ইন্দ্রানি আর ঋতুপর্ণা এ ধরনের গল্পে বেশিরভাগ কাস্ট হতে থাকেন।
সিরিয়ালের জগতে ধর্ষণ নিয়ে কাহিনি দেখিয়ে বিপ্লব ঘটালেন যিশু দাশগুপ্ত। তার ‘কুয়াশা যখন’ সিরিয়ালে নতুন বউ দেবযানী (ইন্দ্রানি হালদার) গণধর্ষণের শিকার হয় বরের অফিসের বস ও বসের দুই বন্ধুর দ্বারা। বিচার পায় না দেবযানী। কেটে যায় ২০ বছর। দেবযানীর মেয়ে মায়ের হয়ে লড়তে ময়দানে নামে। দ্বৈত চরিত্রে অভিনয় করেন ইন্দ্রানি হালদার।
হরনাথ চক্রবর্তী, মসলাদার বাণিজ্যিক ছবির পরিচালক, তার অন্য ধারার ছবি ‘দায় দায়িত্ব’ (১৯৯৯)। ঝোপের আড়ালে এক যুবতীকে (ইন্দ্রানি হালদার) নিগ্রহ করে দুষ্কৃতরা (কৌশিক ব্যানার্জি)। ঠিক ঋতুপর্ণা ঘোষের ‘দহন’ ছবির উল্টো ঘটনা ঘটে। মেয়েটিকে উদ্ধার করতে এগিয়ে আসে একজন তরুণ (প্রসেনজিৎ)। এখানে প্রসেনজিৎ কোনো অ্যাকশন হিরো নন, খুব সাধারণ ছেলে। সে মেয়েটিকে বাড়ি নিয়ে গিয়ে বোনের মর্যাদা দেয়। মেয়েটির নাম ছিল কাবেরি। কাবেরির জন্য বিচার চায় ছেলেটি। উঠে আসে রাঘববোয়ালদের নাম। ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত ছিলেন নায়কের বিপরীতে।
রঞ্জিত মল্লিকের অভিনয় প্রশংসিত হয় একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে। চলচ্চিত্রে নিগ্রহের ঘটনা উঠে এসেছে বারবার। কিন্তু বাস্তবের মতোই সেখানেও প্রকৃত দোষী আড়াল হয়েছে বারবার। যা সমাজে ঘটে, তাই তো চলচ্চিত্রে ফুটে ওঠে! রাজা সেন অবশ্যি তার ‘দেবীপক্ষ’ ছবিতে নায়িকা হৈমকে ছবির শেষে দেখান দুর্গা রূপেই। হৈমকে যখন পাড়ার ক্ষমতাশালী গুন্ডা (বিপ্লব চট্টোপাধ্যায়) হেনস্থা করতে যায়, তখন হৈম (ঋতুপর্ণা) দুর্গা রূপে ত্রিশূল গেঁথে দেয় অসুরের বুকে। এ ঘটনা যদিও বাস্তবে বিরল। রাজা আসে রাজা যায়, মেয়েদের জীবন সুরক্ষিত হয় না।
ধর্ষণ আদতে দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার। সবলের এতেই পরিতৃপ্তি। এ যেন এক পাওয়ার গেম। মোমবাতি মিছিল, কবিদের কবিতার প্রতিবাদ, দুদিনের বাকযুদ্ধ- আদৌ কি ধর্ষণের সমাধান? মনে পড়ে কলকাতা দূরদর্শনের সেই সিরিয়াল মহাশ্বেতা দেবীর কাহিনি অবলম্বনে ‘প্রতি চুয়ান্ন মিনিটে’! সোমা চক্রবর্তী দিদি আর সমতা দাস বোনের লড়াইয়ের গল্প। আজো চলছে লড়াই, হয়তো প্রতি চুয়ান্ন মিনিটেই!