আন্তঃক্যাডার বৈষম্য দূরে করণীয়

কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১৫ জুলাই ২০২০, ০৭:৪৬ পিএম
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিসিএসই একমাত্র চাকরি যেখানে বিশেষ মান-সম্মান, যশ-খ্যাতি পাওয়া যায়, সরকারি ছায়াতলে থেকে পাওয়ার প্র্যাকটিস করা যায়। তাই সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দিন দিন এদেশের শিক্ষিত জনগোষ্ঠী, তরুণ প্রজন্ম বিসিএসের দিকে ঝুঁকছে। আর এ চাহিদাই বিসিএসকে ‘সোনার হরিণে’ পরিণত করেছে। বিসিএসের প্রতি আমাদের নির্ভরশীলতা এমন চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে যে- ৪০তম বিসিএসে আবেদনকারীর সংখ্যা মালদ্বীপের জনসংখ্যাকেও অতিক্রম করেছে। দেশের বিশাল এক শিক্ষিত জনগোষ্ঠী উদ্যোক্তা বা আবিষ্কারক হওয়ার নেশা ছেড়ে আমলা হওয়ার স্বপ্নে বিভোর। এটা প্রকৃতপক্ষে দেশের জন্য কোনোভাবেই মঙ্গলজনক নয়। হ্যাঁ, দেশের মেধাবীদের দেশ পরিচালনায় এগিয়ে আসা উচিত, কিন্তু তারও একটা সীমা রয়েছে। একটা দেশ তো শুধু আমলা বা আমলাতন্ত্র দিয়ে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে না। সোনার হরিণ বিসিএস পরীক্ষার সূচনায় হয় ২০০ নম্বরের প্রিলিমিনারি পরীক্ষার মাধ্যমে। এর মাধ্যমে বিশাল একটা অংশ বাছাই হয়ে যায়। ৩৮তম বিসিএসে সাড়ে ৩ লাখ পরীক্ষার্থী থেকে প্রিলিমিনারিতে টিকেছে মাত্র ১৬ হাজার। এর প্রশ্ন মূলত ভাষা, সাহিত্য, সাধারণ জ্ঞান, সাধারণ গণিত ও বিজ্ঞান, রাষ্ট্র, ইতিহাস, ভূগোলের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। প্রিলিমিনারির পরবর্তী ধাপ হলো লিখিত পরীক্ষা। লিখিত পরীক্ষায় বাংলা ও ইংরেজি এবং বাংলাদেশ বিষয়গুলোতে ২০০ নম্বর করে, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে ১০০ নম্বর করে রয়েছে। আর ১০০ নম্বর করে বরাদ্দ রয়েছে গাণিতিক যুক্তি ও মানসিক দক্ষতা বিষয়ে। সর্বমোট ৯০০ নম্বরের পরীক্ষা। অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে গত ৩০ জুন ৩৮তম বিসিএসের ফলাফল ঘোষণা করা হয়েছে। ৩৮তম বিসিএস এক ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে থাকবে। কারণ এ বিসিএস থেকেই কোটা পদ্ধতির বিলুপ্তি ঘটছে যাচ্ছে। বৈষম্য নিয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন অবশেষে সফল হয়েছে। যুগ যুগ ধরে শিক্ষার্থীদের সব আন্দোলনই সফল হয়েছে। ছাত্রসমাজ চাইলেই যে কোনো কিছু বাস্তবায়ন করতে পারে। ৩৮তম বিসিএসে বিভিন্ন ক্যাডার পদে সর্বমোট ২ হাজার ২০৪ জনকে মনোনীত করা হয়েছে। সবাইকে জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। ৩৮তম বিসিএসের ক্যাডার পদ বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে ইঞ্জিনিয়ারিং, ডাক্তারি পড়–য়া শিক্ষার্থীদের বেশিরভাগই তাদের পেশার সঙ্গে জড়িত ক্যাডার পদ ছেড়ে পররাষ্ট্র, প্রশাসন ও পুলিশ এবং অনেকেই সাধারণ ক্যাডার পদে যোগ দিয়েছেন। এখন আমার সাদাসিধে প্রশ্ন- একজন মেডিকেল পড়ুয়া শিক্ষার্থী এত কষ্ট, এত পরিশ্রম করে, এত লাখ লাখ টাকা খরচ করে দীর্ঘ ৫/৬ বছর ডাক্তারি পড়াশোনা করে কেন স্বাস্থ্য ক্যাডারে যোগদান না করে পররাষ্ট্র, প্রশাসন, পুলিশ বা কর ক্যাডারে যোগদান করলেন? আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তন এখন সময়ের দাবি। দিনশেষে আমাদের দেশে দেখা যায় প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা বা ডিগ্রির সঙ্গে আমাদের চাকরি বা কর্মক্ষেত্রের কোনো মিল থাকে না। এজন্য ডাক্তারি পড়–য়া একজন ডাক্তার ডাক্তারি না করে যোগদান করেন প্রশাসনে। ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে আজীবন পড়াশোনা করে যোগ দেন পুলিশে। তাহলে আমাদের এ শিক্ষার কী দাম রইল? শিক্ষা তো তার মহৎ উদ্দেশ্য সাধনে ব্যর্থ হলো! শিক্ষাব্যবস্থাকে এখন ঢেলে সাজানোর সময় এসেছে। যে যে বিষয়ে পড়াশোনা করছে তার জন্য, তার বিষয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত সেরকম কর্মপরিবেশ তৈরি করতে হবে। পেশা অনুযায়ী সব পেশাতে সমান সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য শিক্ষা খাতের সংস্কারের জন্য প্রচলিত নিয়মকানুন পরিবর্তনে সরকারকে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে। বিসিএসের মতো তুমুল প্রতিযোগিতাপূর্ণ চাকরি পরীক্ষায় প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রির ওপর সমন্বয় তথা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করে মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে ক্যাডার মনোনয়ন দিতে হবে, দূর করতে হবে আন্তঃক্যাডার বৈষম্য। তখন হয়তো বৈষম্যের দেয়াল ভাঙবে। শিক্ষার মহৎ উদ্দেশ্য সাধিত হবে।
শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।