স্টারলিংক ও বাংলাদেশ ইন্টারনেট

ইকবাল আহমদ ফখরুল হাসান
প্রকাশ: ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৫:০০ এএম

স্টারলিংক ও বাংলাদেশ ইন্টারনেট
বাংলাদেশে ইন্টারনেটের শুরুটা হয় স্যাটেলাইট ইন্টারনেটের মাধ্যমে ১৯৯৬ এর দিকে। কয়েক কেবিপিএস ইন্টারনেট নিয়ে সেটাকে টেলিফোন ডায়ালআপ এর মাধ্যমে বাসাবাড়ি ও অফিস এ পৌঁছানো হতো। বিটিআরসি ইন্টারনেট কোম্পানির লাইসেন্স শব্দটার জন্মও তখন।
ক্যাপিটাল সিটি ঢাকা থেকে হাটিহাটি পা পা করে বড় শহর গুলোতে ভিস্যাট ইন্টারনেট এর প্রসার ঘটতে থাকে। সরকারি পর্যায়ে সিটি টু সিটি কানেক্টিভিটি চিন্তা করা হয় যতদূর মনে করতে পারি ইন্টারনেট কানেক্টিভিটি ও টেলিফোন / মোবাইল কলকে সহজীকরণের জন্য। রেলওয়ে ট্র্যাক ব্যবহার হয়েছিল।
২০০৫- ২০০৬ পর্যন্ত অনেক দামি কিন্তু ধীর গতির ভিস্যাট ইন্টারনেট বাংলাদেশের একমাত্র ইন্টারন্যাশনাল কনেক্টিভিটি। যদিও সাবমেরিন কানেক্টিভিটি নেয়ার বেপারটা আমরা আমাদের নির্বুদ্ধিতায় এড়িয়ে যাই। পরবর্তীতে se-me-we-4 সাবমেরিন এ আমরা যুক্ত হই। ভুল না বলে থাকলে ২০০৬-৭ এ ঢাকাতে সাবমেরিন ইন্টারনেট পাওয়া যায় , যদিও সহজলভ্যতা তৈরি হয়না। আস্তে আস্তে করে বাংলাদেশ এ আইএসপি কোম্পানিগুলো শহর, ছোট-শহর, গ্রাম এ কপারওয়্যার ও ফাইবার ক্যাবল দিয়ে প্রবেশ করতে শুরু করে।
এটারই একটা দ্রুত বাস্তবায়ন, বিস্তার আর ধূর্ত কামানোর পরিকল্পনায় এনটিটিএন লাইসেন্স (সীমিত) এর প্রত্যাবর্তন ঘটে। কিন্তু সত্যিকার অর্থে বাংলাদেশের ইন্টারনেটকে বিস্তৃতি দেয় ফাইবার ভিত্তিক ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট কোম্পানিগুলো। হা, এদের ইনভেস্টমেন্ট এ গড়া মার্কেটে সহজে পয়সা কমানোর রাস্তায় টেলিফোন/মোবাইল কোম্পানিগুলো সহজ রাস্তায় সরকারের ব্যয়কৃত রেলওয়ে ফাইবার ও অন্যান্য ইনভেস্টমেন্ট এর উপর ভর করে G ইন্টারনেট নামে দেশের মানুষের পকেট খালি করা শুরু করে। কিন্তু পয়সা যেই কামাক - দেশের মানুষ ইয়াহু, গুগল আর ফেসবুক এ কাজ করা শিখে ফেলে।
ইন্টারনেটের বিস্তার এর কারণে যত ব্যবসা দাঁড়ানোর কথা সেটা খুব বেশি না হলেও ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম ব্যবহার যথেষ্ট বেড়ে ১০ কোটি ব্যবহারকারী তৈরি হয়ে যায়। হা, কিছু সুফল আমরা পেতে শুরু করি যার মধ্যে ইমেল ও ওয়েবসাইট ইনফরমেশন গুরুত্বপূর্ণ। সফটওয়্যার ব্যবহার বা ডাটা নিয়ে ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড, শিক্ষা, স্বাস্থ্য বা তথ্য প্রযুক্তিতে তেমন বিস্তার হয়ে ওঠে না। তাতেও আমরা খুব একটা অখুশি হওয়ার মতো ঘটনা চিন্তা করা হয়নি তেমন কারোই।
জুলাই রাজনৈতিক পরিক্রমায় ইন্টারনেট বন্ধ ও মিথ্যে ঘোষণায় বাক-স্বাধীনতা ও ব্যবসা পরিমণ্ডলকে নড়বড়ে করে দেয়। সরকার পক্ষ থেকে এটি করতে পারার মূল কারণ বিটিআরসির দুর্বল ইন্টারনেট পলিসি ও রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার। বিশ্বের মানচিত্রে নেটওয়ার্কবিহীন বিশাল ক্ষতিগ্রস্ত একটি দেশে পরিণত হয়। সকল ব্যবসা, শিক্ষা ও যোগাযোগের ভিত্তি ইন্টারনেট নাই হয়ে যাওয়ায় দেশ অপূরণীয় ক্ষতির স্বীকার হয়। এর পর থেকে ইন্টারনেটকে নাগরিক অধিকারে রূপান্তর একটা বড় মাইলফলক হিসেবে দেখা হয়।
তারপরও জনমনে অধিকারের বিশ্বস্ততা তৈরি না হওয়ার প্রধান কারণ বিটিআরসি সরকারি সংস্থা ও তার রাজনৈতিক অবকাঠামোগত ক্ষমতায়নের পূর্ববর্তী অভিজ্ঞতা থেকে। যদিও স্বায়ত্তশাসিত হয়ে সরকারি সংস্থা, আইসিটি বাণিজ্য সংগঠন ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি দিয়ে পরিচালিত ও নিয়ম তৈরি হলে বিশ্বস্ততার সমস্যা সমাধান হয়ে যেতো বলা যায়। ইন্টারনেট ও মোবাইল অপারেটরদের রেগুলেটরি বডি আলাদা হলেও অনেকখানি সহজ হতো, ফাইবার ব্রডব্যান্ড নিয়ে পলিসি তৈরিতে বারবার 5G থেকে কামানোর চিন্তাটা একটু দূরে রাখা যেতো।
গত কয়েকমাসে ইন্টারনেট বন্ধের কারণে হওয়া ক্ষতির উত্তরণের কথা বাদ দিয়ে আমরা সবাই লেগে আছি বিশ্বের সর্বোচ্চ ধনী ব্যক্তির সেলসম্যানশিপে। কারণ বেশিরভাগই মনে করছি, Starlink বাংলাদেশের রাজনৈতিকভাবে অপব্যবহারযোগ্য ইন্টারনেট দিয়ে নাগরিক অধিকার ও অপ্রতিরোধ্য ব্যবসায়ীক যোগাযোগ মাধ্যম হয়ে থাকবে।
না, এটিও বিটিআরসি দ্বারা পরিচালিত হবে। আর যদি বিটিআরসি কন্ট্রোল না করতে পারে তাহলে বিশ্বের সর্বোচ্চ ধনী ব্যক্তির ক্ষমতায়ই চলবে। আমরা অবশ্যই আমাদের smw-4, smw-5 সাবমেরিন এর পাশাপাশি আরও প্যারালাল কানেকশন চাই , নদীমাতৃক দেশ- যেখানে ফাইবার যাবেনা - সেখানে স্যাটেলাইট ইন্টারনেট চাই , সমুদ্রে জাহাজ চলাচলে চাই , স্পেশাল বিজনেস এর চাহিদা পূরণ করতে চাই। কিন্তু ফাইবার ইন্টারনেট, 3G/4G মোবাইল ইন্টারনেট সার্ভিস টিকিয়ে রাখার সকল ব্যবস্থা করেই starlink কে সুযোগ দিতে হবে আরও কভারেজ এরিয়া বৃদ্ধি করার জন্য।
তথা, বিশ্বের সর্বোচ্চ ধনী ব্যক্তি বা বিশ্বের শক্তিধর দেশের সাথে সম্পর্ক অথবা DOGE (Department Of Goverment Efficiency, USA) এর প্রধান এর সঙ্গে ডিপ্লোম্যাটিক সম্পর্ক - তিনটি আলাদা চিন্তা হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। অন্যথায়, প্রাইভেট সেক্টর এর ৩০ বছরে আস্তে আস্তে গড়া ইন্টারনেট অবকাঠামো ভেঙে পড়তে পারে এবং বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে যোগাযোগ, শিক্ষা ও ব্যবসা পরিচালনা খরচ বাড়ার সম্ভাবনাও অমূলক হবে না।
লেখক: ইকবাল আহমদ ফখরুল হাসান, প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী, ডিভাইন আইটি লিমিটেড