বিয়েশাদি: বাংলাদেশ বনাম পশ্চিমা দেশ
প্রকাশ: ১২ জুন ২০২৪, ০৭:৩৪ পিএম

বিয়েশাদি: বাংলাদেশ বনাম পশ্চিমা দেশ
বহুদিন ধরে নিচের বিষয়টি নিয়ে লিখব লিখব করে লেখা হয়ে ওঠেনি। কারণ কি জানেন? কারণ আমি বাংলাদেশের বাইরে থাকি, আমি লিখলেই অযথা বকাঝকা শুনতে হবে পাঠকের থেকে। লেখার উদ্দেশ্য জানা, শেখা, অনুপ্রাণিত করা কিন্তু যদি পাঠক বিষয়টি ভুলভাবে ব্যাখ্যা করেন তখন উদ্দেশ্য সফল হবে না। তাছাড়া আমার একটা চিন্তা বা ধারণা যদি যুগোপযোগী না হয় তখন সে লেখার সারমর্ম ভালো হলেও বা উদ্দেশ্য ভালো হলেও পাঠক সেটা সঠিকভাবে গ্রহণ করবে না।
সেক্ষেত্রে নীরবতা বাঞ্ছনীয়। যুগের পরিবর্তন হয়েছে, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের (সব ধরনের গণমাধ্যম) মাধ্যমে সকলেই জানা শোনার সুযোগ পাচ্ছে, যার ফলে এখন অনেক কিছুই খোলামেলা আলোচনা করার উপযুক্ত সময়। আসুন তাহলে আজ খোলামেলাভাবে এই অপ্রিয় সত্যটি নিয়ে আলোচনা করি।
এখন পুরো বিশ্বে যা কিছু ঘটছে আমরা স্কুলে না গিয়েও প্রযুক্তির মাধ্যমে জানতে পারছি। আমি যখন বাংলাদেশ থেকে এইচএসসি শেষ করে সুইডেনে পড়তে আসি, তখন আমার যে বয়স সে বয়সে সুইডিশ ছেলেমেয়ে বেশ ইন্টিমেট সম্পর্কে জড়িত। বিয়ে না করেই একে অপরের সাথে জড়িত। বিষয়টি আমার কাছে তখন অবাক মনে হয়েছে! মনে মনে ভেবেছি তখন সবাই জাহান্নামে যাবে কারণ দেশে থাকতে তো ওটাই শেখানো হয়েছে।
কিন্তু ঠিক ওই সময় আমরা গোপনে কে কী করেছি সেগুলো নাই বলি, তবে ভাবুন এখনও সেই পুরনো সিস্টেমে গৃহবন্দি হয়ে বাংলাদেশের মতো বিশ্বের বহু দেশের ছেলেমেয়েরা যৌবনের প্রকৃত সময় পার করে। তারপর ৩০-৩২ বছর বয়সে মাস্টার্স ডিগ্রি শেষে চাকরি করে টাকা উপার্জন না করা পর্যন্ত বিয়ের পিঁড়িতে বসা স্বপ্নই থেকে যাবে।
পাশ্চাত্যে নবম শ্রেণি পাশ করেই বা তারও আগে (১৪-১৫) বেশির ভাগ ছেলেমেয়ে যৌনতাকে নরমালভাবে ব্যবহার করছে, অনেকে দিব্যি কাজ, কর্ম বা সংসারও করছে। উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন না করা পর্যন্ত কেউ যৌনমিলন করছে না এমন গাধা আমার চোখে পড়েছে, তবে তারা সত্যিই গাধার দলের এক শ্রেণির লাজুক মানুষ। এসব দেশে যৌনতাকে অত্যন্ত নরমাল মনে করে।
এদের মতে কাজ, উচ্চশিক্ষা শেষ করার সাথে যৌনতার সম্পর্ক কী? যৌনতা শরীরের একটি চাহিদা সেটা কেন বন্ধ থাকবে? বন্ধ অবশ্য কখনও থাকেও না। আমরা দুধের স্বাদ ঘোলে মিটাই, যা অতি সাধারণ বিষয়। যার ফলে উচ্চধারী শিক্ষিত বা ল্যাটের বাট এমন কিছু না হওয়া পর্যন্ত ছেলেমেয়ের বিয়ে-শাদি আমাদের সমাজে খুব একটা হয় না। আর যারা লেখাপড়া না করে সরাসরি কাজে জড়িত তারাও প্রথমে একটা কাজ জোগাড় না করা অবধি বিয়ে করতে চায় না বা পারে না।
সবার কথা একটাই বিয়ে করলে বউকে কীভাবে খাওয়াব! আচ্ছা ভাবুন তো, বউও তো একজন তরতাজা মানুষ। সেও তো সবকিছু করতে পারে, তাকে কেন স্বামীকে খাওয়াতে হবে এযুগে? আমাদের সমাজে যৌনতাকে কষ্ট দিয়ে, শরীরের চাহিদাকে না পূরণ করে আমরা গ্রাজুয়েট বা পোস্ট গ্রাজুয়েট ডিগ্রি শেষ না করে বা কাজের মাধ্যমে প্রচুর অভিজ্ঞতা অর্জন না করে বিয়েশাদি করি না।
অথচ বিশ্বের অনেক দেশ যেমন সুইডেন বা গোটা ইউরোপে খুব অল্পসংখ্যক ছেলে-মেয়ে প্রথমে মাস্টার্স ডিগ্রি সম্পন্ন করে। পিএইচডি তো অনেক পরের ব্যাপার। কারণ এরা বাধ্যতামূলক স্কুলশিক্ষা শেষ করে, যে কোনো কাজে লেগে যায়। পরে যদি মনে করে আরো পড়তে হবে তখন তারা পড়ে।
আমাদের দেশের সমস্যা হলো, অন্ততঃ মাস্টার্স পর্যন্ত লেখাপড়া না করে তারা কিছুতেই চাকরিতে ঢুকবে না। আর সেই বহু আকাঙ্ক্ষিত চাকরিটাও হওয়া চাই। যেকোনো পেশার চাকরি শুরু করা যেন একটি অরুচিকর ব্যাপার। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি না পাল্টানো পর্যন্ত ছেলে-মেয়েদের দেরিতে বিয়ে করার সামাজিক সমস্যাটা সমস্যাই থেকে যাবে।
এখন প্রশ্ন হতে পারে ১৭ বছরে একটা ছেলে বা মেয়ে ইন্টারমিডিয়েটে ফাস্ট ইয়ারে পড়ে, তখন কি বিয়ে করা উচিত? তারা তো নিজেরাই বাবার টাকায় পড়ালেখা করে। তো বউয়ের খরচও কি বাবার থেকে নিবে? প্রশ্নটি লক্ষ্য করেন, বলা হচ্ছে বাবার টাকা। আচ্ছা মার কি কিছুই নেই? মাকে কেন এসব দায়িত্ব থেকে এখনও সরিয়ে রাখা হচ্ছে? ভাবুন তো!
আবার এও বলা হয় যেমন, খাওয়া, কাপড়-চোপড়, চিকিৎসা, বেড়ানো, বউয়ের শখ পূরণ করতে যে অর্থের প্রয়োজন সেটা কে দিবে? শুধু বউয়ের কথা, পুরুষ মানুষটি সব সময় হিরো, ভাবখানা তিনিই সব করেন। ঘটনাটি মূলত ছেলেমেয়েকে নিয়ে এবং তাদের যৌনতাকে নিয়ে, তবে বছর না যেতেই ঘরে বাচ্চা আসবে, বাচ্চার ভরণপোষণ, কাপড়, চিকিৎসার খরচ কে দিবে? এ ধরনের চিন্তাগুলো ভাবা যেতে পারে এবং তার জন্য জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি রয়েছে।
আমি যে বিষয়টি নিয়ে বেশি উদগ্রীব সেটা হচ্ছে সারাক্ষণ বলা হচ্ছে আমাদের সমাজে যেমন, ছেলেকে বিয়ে দিয়ে ছেলের সংসারের খরচ চালাতে পারে এমন পরিবার কয়টা আছে? একটা মেয়ের খাওয়া ছাড়াও বিভিন্ন রকমের খরচ থাকে। প্রতিবার কি বাবার কাছে টাকা চাইবে? আমার বউয়ের এটা লাগবে ওটা লাগবে এগুলো কি বার-বার বাবার কাছে বলা যায়? যদি চাকরির কথা আসে, ইন্টারপড়ুয়া ছেলেকে কে চাকরি দিবে? আর যদি কোনো কারণে একটা ছোটোখাটো চাকরি পেয়েও যায় তাহলে তার পড়ালেখার কী হবে?
যদি টিউশানি করে তাহলে কত টাকা রোজগার হবে? তাতে কি সংসার মেইনটেইন করা সম্ভব? একবারও মেয়ের কথা বলা হচ্ছে না। ভাবখানা এমন মেয়েদের জন্মই হয়েছে ছেলেদের উপর চেপে বসার জন্য! আমাদের সমাজে মেয়েরা সবসময়ই এ বিষয়গুলো মুখবুজে সহ্য করে আসছে, যার ফলে সবকিছু মেয়েদের ঘাড়ের উপরেই আসে। এটার প্রতিবাদ করতে হবে, মেয়েদের হৃদয়ে দুর্গ গড়ে তুলতে হবে এবং এখনই সেটা শুরু করতে হবে বলে আমি মনে করি।
ভাবুন একটা ছেলে বা মেয়ে ৩০ বছরের আগে বিয়ে করবে না বা তাদের যৌনতা থেকে তারা বিরত থাকবে। যৌনতার আবির্ভাব শরীরে কখন এসেছে? সাধারণত ছেলেমেয়ে সেক্সুয়ালি অ্যাডাল্ট হয় ১৩-১৪ বছর বয়সে বা তার আগেই। অথচ সমাজ সেখানে মেয়েদের বিয়ের বয়স নির্ধারণ করেছে ১৮ বছর ও ছেলেদের ২১ বছর।
ভালো কথা, কিন্তু সিস্টেম করে দিয়েছি আবার অন্য রকম। ছেলেদের চাকরির বয়স সীমা ৩২ বছর। গ্রাজুয়েশান শেষ করতে করতে বয়স হয়ে যায় ২৬/২৭ বছর। গড় আয়ু যদি ৭০ বছর হয় তাহলে ৩২ বছর বয়স পর্যন্ত সে অন্যের টাকায় চলবে। এর পর স্বাবলম্বী হয়ে বিয়ে করবে ৩২ এর পর। ছেলেটা সেক্সুয়ালি অ্যাডাল্ট হলো ১৩-১৪ বছর বয়সে। সে বিয়ে করলো আরো ১৫-১৮ বছর পর। এই ১৫-১৮ বছর সে কী করবে? এতগুলো বছর অপেক্ষা করবে শরীরের ক্ষুধা মিটানোর জন্য?
আমরা মানুষ, জীবন্ত জীব, পাথর না। আমাদের ফিজিক্যাল চাহিদা আছে। তাই বলে ১৫ বা ১৮ বছর অপেক্ষা করবে একটা ছেলে-মেয়ে? আপনি বা সমাজ কি বিশ্বাস করেন যে ছেলে-মেয়ে এতগুলো বছর অপেক্ষা করে? অপেক্ষা করে না দেখেই সমাজের এই অধঃপতন। সবকিছুই গমনে চলছে ঠিক দুর্নীতির মতো। আমরা এই অপ্রিয় সত্যকে মেনে নিয়েছি কিন্তু ছেলে প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত বিয়ে মেনে নিতে পারছি না।
আমরা সব সময় ধর্মকে টেনে আনি কিছু হলেই, অথচ গোপনে কাজগুলো করি বিপরীত, যেমন দুর্নীতি করা মহাপাপ কিন্তু গোপনে সেটাই করি। বিয়ে ছাড়া যৌনতা মহাপাপ অথচ গোপনে সেটাই করি। তবে একটা বিষয়ে আমরা ধর্মকে মেনে চলি, সেটা হলো বিয়ে। পাত্রের ভালো চাকরি নেই, সমাজের প্রভাবশালী কারো ছেলে না, বিয়ে হবে না। সমাজে আগে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে তার পর বিয়ে!
ইদানীং নতুন ফ্যাশন অ্যাড হয়েছে বাংলাদেশে, সেটা হলো বিসিএস দিয়ে ৩৫ বছর বয়সে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে তারপর বিয়ে করতে হবে। নিজের পায়ে ঠিকঠাক মতো দাঁড়াতে দাঁড়াতে 'আসল' জিনিসটি দাঁড়ানোর সময় পার হয়ে যাচ্ছে সেটা কি ভাবনায় আছে?
যাইহোক ইসলাম ধর্মে বিয়েকে যেভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে আমরা সেটাও ঠিকমতো পালন করি না। আমরা আসলে কী পালন করি? না ধর্ম না কর্ম? তারপরও কথা থেকেই যায় বিয়ে কি সত্যিই জরুরি? “ভালোবেসে, সখী, নিভৃতে যতনে আমার নামটি লিখো, তোমার মনের মন্দিরে, আমার পরানে যে গান বাজিছে তাহার তালটি শিখো, তোমার চরণমঞ্জীরে।”
আমি মনে করি যৌনতা আমাদের শারীরিক চাহিদা, তাকে তার গতিতে চলতে দিতে হবে বাধাবিঘ্ন ছাড়া এবং মনে প্রাণে বিশ্বাস করতে হবে যে ভালোবাসার মধ্যে রয়েছে শুধু ভালোবাসা, অতএব মনঃপ্রাণ দিয়ে একে অপরকে ভালোবাসোতে হবে। কারণ ভালোবাসাই দিবে সব সমস্যার সমাধান।
রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন থেকে, rahman.mridha@gmail.com