নাশকতাকারীদের টেলিগ্রাম বার্তা ও অডিও রেকর্ড ফাঁস

কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২৫ জুলাই ২০২৪, ০২:১৮ পিএম

ছবি: সংগৃহীত
কোটা সংস্কার আন্দোলনের আড়ালে নাশকতার মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের জন্য সারাদেশে জামায়াত-শিবিরের ক্যাডাররা মাঠে নেমেছিল। ইতিমধ্যে নাশকতাকারীদের একাধিক টেলিগ্রাম বার্তা ও অডিও রেকর্ড প্রকাশ্যে এসেছে। ফাঁস হওয়া টেলিগ্রাম বার্তা ও অডিও রেকর্ডে সরকার হটাতে তারা একযোগে সবাইকে মাঠে নামার আহ্বান জানিয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরকারবিরোধী আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার নির্দেশনা দেয়া হয়।
সরকার পতনের জন্য রাজধানীকে সারাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করার ডাক দিয়ে টেলিগ্রামে বার্তা দিয়েছে একাধিক। আন্দোলনের নামে সৃষ্ট নৈরাজ্যে জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে মাঠে নেমেছিল জঙ্গিরাও। তাণ্ডবের তদন্তে নেমে একাধিক তথ্যপ্রমাণ পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। শিবিরের চার কেন্দ্রীয় নেতাকে গ্রেপ্তারের পর তাদের কাছ থেকে নাশকতায় জড়িত থাকার বিস্তুর তথ্য প্রমাণ পেয়েছে পুলিশ।
জানা গেছে, ইসলামী ছাত্রশিবিরের ঢাকা জেলা দক্ষিণের সাধারণ সম্পাদক মাহাবুবুর রহমান সিয়াম ছিলেন সমন্বয়কের দায়িত্বে। টেলিগ্রাম বার্তায় তিনি গত বুধবার বিকালে সাংগঠনিক ইউনিটের নেতাদের উদ্দেশে বলেন, ঢাকাকে সারাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে হবে। গত বৃহস্পতিবার বিকাল ৩টার পর থেকে সবাইকে রাস্তায় নেমে সরকার হটাতে সবরকম চেষ্টা করতে বলেন তিনি।
এর আগে বুধবার রাতে তাদের সাথীরা ঢাকার যাত্রাবাড়ী, ধোলাইখাল, শনির আখড়ার দায়িত্ব নিয়েছে বলেও জানান তিনি। সিয়াম তখন তার সাথীদের জানান, যে কোনো সময় ইন্টারনেট সেবা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। সাংকেতিক ভাষায় দেয়া নির্দেশনা সবাইকে পালন করতে হবে। কেরানীগঞ্জ, দোহার ও নবাবগঞ্জের সবাইকে প্রস্তুতি নিয়ে তৎপর থাকতে হবে।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সঙ্গে সমন্বয় করে সবকিছু মোকাবিলা করতে হবে। আন্দোলনে থাকা শিক্ষার্থীরা কীভাবে পুলিশকে মোকাবিলা করবে তাও জানান সিয়াম। জামায়াতের ‘স্বপ্নচরী’, ‘বাশেরকেল্লা’ ও ‘কাশফুল’- পেইজ থেকে সরকারবিরোধী আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার নির্দেশনা দেয়া হয়। নেতাকর্মীরা পুলিশকে আক্রমণ করতে তার কাছে ককটেলের যোগান চায়।
কেরানীগঞ্জের হাসনাবাদের একটি মেসে গত মঙ্গলবার রাতে ঢাকা জেলা পুলিশের একটি টিম অভিযান চালিয়ে শিবিরের চার কেন্দ্রীয় নেতাকে গ্রেপ্তার করেছে। ঢাকা জেলা দক্ষিণের ইসলামী ছাত্রশিবিরের বিজ্ঞান ও পাঠচক্রবিষয়ক সম্পাদক আব্দুল কাদের জিলানী, মানবসম্পদ উন্নয়নবিষয়ক সম্পাদক নাজমুল হোসেন নামে প্রথম সারির দুই নেতাও রয়েছে। তারা কেরানীগঞ্জের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে হামলা চালিয়ে দখলের পরিকল্পনার পাশাপাশি ঢাকার সবকটি প্রবেশমুখ বন্ধ করে দেয়ার পরিকল্পনা করেছিল। পোস্তগোলা ব্রিজ, এক্সপ্রেসওয়ে নিয়ন্ত্রণে নেয়ার পরিকল্পনা করেছিল। পুলিশের সতর্কতায় তারা পেরে উঠেনি।
পুলিশ বলছে, দীর্ঘদিন ধরে এই আস্তানাটি শিবিরের ঢাকা জেলা দক্ষিণের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার হতো। ওই বাসা থেকে উদ্ধার হয়েছে শিবিরের বিভিন্ন লিফলেট ও পুস্তিকা।
ঢাকা জেলা পুলিশ সুপার মো. আসাদুজ্জামান জানান, গ্রেপ্তারকৃতদের জব্দ করা মোবাইল ও বিভিন্ন ইলেকট্রনিক ডিভাইসে তথ্যপ্রমাণ অনুযায়ী কোটা সংস্কার আন্দোলনে ভর করে সারাদেশে সহিংসতা ছড়িয়ে দেয়ার পরিকল্পনা ছিল শিবিরের। স্বপ্নচারী, কাশফুল, বাঁশেরকেল্লাসহ বেশ কয়েকটি টেলিগ্রাম গ্রুপে এসব প্রমাণ মিলেছে।
টেলিগ্রামের স্বপ্নচারী গ্রুপে ঢাকা জেলা দক্ষিণের ইসলামী ছাত্র শিবিরের সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুর রহমান সিয়াম তার একটি বার্তায় লিখেছেন, ‘দোহার, নবাবগঞ্জ, কেরানীগঞ্জ সব শাখা এখন থেকেই প্রস্তুত থাকুন। বৃহত্তর কর্মসূচি আসতে যাচ্ছে। ডাক আসার সঙ্গে সঙ্গে সব জনশক্তিসহ আমজনতাকে সঙ্গে নিয়ে ময়দানে জালিমশাহির বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। ইতোমধ্যে কেন্দ্র গ্রিন সিগন্যাল দিয়ে দিয়েছে। সবাই প্রস্তুতি নিন। যে কোনো সময় নেট বন্ধ করে দেয়া হবে। তাই অফলাইনে সাংকেতিক শব্দের মাধ্যমে কথা বলা হলে বাকিটা বুঝে নিবেন।’
টেলিগ্রামের কাশফুল গ্রুপে সিয়াম নির্দেশনা দিয়ে বলেন, ‘আপনি আপনার থানার সভাপতি ও সেক্রেটারির সঙ্গে যোগাযোগ রাখুন। একই গ্রুপে আরেকজন লিখেছেন, ভাই, ককটলে প্রয়োজন। পুলিশকে প্রতিহত করার জন্য। এ সময় শিক্ষার্থীদের হাতে বাটুল আর গুলতি তুলে দেয়ার আহ্বান জানান সিয়াম। কীভাবে বাটুল দিয়ে আক্রমণ করা যায় সেই কৌশলও শিখিয়ে দেয়া হয়।
পুলিশ সুপার আরো বলেন, শুধু সহিংসতা, অগ্নিসন্ত্রাস এবং আন্দোলন উসকে দেয়া নয়, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার দখলেরও পরিকল্পনা ছিল শিবিরের। পুরো ঢাকাকে সারাদেশের সঙ্গে বিচ্ছিন করার পরিকল্পনা ছিল তাদের। আন্দোলনকে উসকে দেয়ার মতো অসংখ্য অডিও বার্তাও এসেছে পুলিশের হাতে। একটি অডিও বার্তায়- প্রবেশমুখ বন্ধ করে ঢাকা অচল করার নির্দেশনা দিয়েছেন সিয়াম। এছাড়া জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সঙ্গে সমন্বয় করে বড় একটি আন্দোলন করার পরিকল্পনাও ছিল তাদের।
পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, নাশকতায় ইন্ধন দিয়ে মাঠে নেমে অনেকস্থানে জামায়াত-শিবির কর্তৃত্ব নিয়ে নিয়েছিল। এমন অনেক অডিও কলরেকর্ড পাওয়া গেছে। টেলিগ্রামে তথ্য আদান প্রদানের তথ্য মিলেছে। বুয়েট ও একাধিক মেডিকেল কলেজে তাদের নেটওয়ার্ক বিস্তৃত জানিয়ে পুলিশ কর্মকর্তারা বলেছেন, প্রকাশ্য রাজনীতি করতে না পারায় তারা মেধাবীদের টার্গেট করে আদর্শিকভাবে প্রস্তুত করে আসছে। কোটা আন্দোলনের সুযোগটিও তারা কাজে লাগিয়েছে। ঢাকার মেসে মেসে রয়েছে জামায়াত-শিবিরের আস্তানা।
যেসব এলাকায় তাণ্ডব চলেছে সেসব এলাকায় অনেক মেস থাকায় অস্থিরতা ছিল দীর্ঘস্থায়ী। জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল পলাতক জঙ্গিদের অনেকে। নরসিংদী কারাগারে হামলা চালিয়ে ৯ জঙ্গি ছিনতাই ও তাদের পালানোর ধরন দেখে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে জঙ্গিদের যোগসূত্র পাওয়া গেছে।
পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ইউনিটের (সিটিটিসি) প্রধান আসাদুজ্জামান বলেছেন, নৈরাজ্যের সময় মাঠে ছিল জঙ্গিরাও।
এদিকে ডিবি সূত্র বলেছে, জামায়াত-শিবির ও জঙ্গিরা কয়েকটি স্পটে পুলিশের সঙ্গে সরাসরি সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। তাদের মধ্যে অনেকে বন্দুকের সামনে বুক পেতে দেয়। একজন গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর তাকে উদ্ধার না করে পাশেরজনও বন্দুকের সামনে বুক পেতে দেয়। ঢাকার রায়েরবাগ-যাত্রাবাড়ী, উত্তরা ও রামপুরায় নাশকতাকারীরা একাধিক আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করেছে।