বিশ্বব্যবস্থার সংকট: মানবতা বনাম ক্ষমতার লড়াই
প্রকাশ: ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৪:১৪ এএম

রহমান মৃধা, গবেষক ও লেখক, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন
একটি ন্যায্য বিশ্বব্যবস্থা গড়ার প্রতিশ্রুতি নিয়েই সভ্যতার অগ্রযাত্রা শুরু হয়েছিল। অথচ আজ আমরা এমন এক বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে, যেখানে কিছু মানুষ প্রাচুর্যে ভাসছে, আর কিছু মানুষ বেঁচে থাকার জন্য লড়াই করছে। গরিবের ভাগ্যে কি শুধুই বঞ্চনা? যারা শোষিত, যাদের শ্রমে অর্থনীতির চাকা ঘোরে, তাদের যদি বিতাড়িত করা হয়, তাহলে কী হবে তাদের পরিবারগুলোর? এই প্রশ্নের উত্তর কি আজকের বিশ্ব নেতাদের কাছে আছে?
আমেরিকা সহ অন্যান্য ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলো চাইলেই মানবজাতির জন্য অনেক কিছু করতে পারে। প্রযুক্তি, সম্পদ, এবং বৈশ্বিক নেতৃত্ব তাদের হাতে। তারা চাইলে যুদ্ধ বন্ধ করতে পারে, বৈষম্য কমাতে পারে, ক্ষুধার্তদের খাবার দিতে পারে, উদ্বাস্তুদের আশ্রয় দিতে পারে। কিন্তু তাদের নীতিতে কি সেই মানবিকতার ছাপ আছে? নাকি তাদের সিদ্ধান্ত কেবলই রাজনৈতিক স্বার্থের খেলা?
এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে বিশ্ব
আজকের বিশ্ব এক অস্থির সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। কঠোর অভিবাসন নীতি, অর্থনৈতিক বৈষম্য, জলবায়ু পরিবর্তন, এবং সামরিক উত্তেজনা বিশ্বব্যবস্থাকে সংকটের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। ইউরোপ থেকে আমেরিকা—যেদিকেই তাকাই, অভিবাসন রাজনীতি নিয়ে বিতর্ক তুঙ্গে। সীমান্ত খোলা থাকবে, নাকি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত হবে—এ সিদ্ধান্ত মূলত ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলোর স্বার্থের ওপর নির্ভর করছে। কিন্তু এই কঠোর নীতির প্রকৃত শিকার কারা?
অভিবাসন সংকট: মানবিকতা বনাম স্বার্থপরতা
বিশ্বায়নের যুগেও অভিবাসী শ্রমিকরা বৈষম্য ও অবহেলার শিকার। মধ্যপ্রাচ্যে বছরের পর বছর শ্রম দিয়ে গেলেও তারা নাগরিকত্ব পান না, ফলে নেই কোনো পেনশন, নেই কোনো সামাজিক নিরাপত্তা। অন্যদিকে, কঠোর ব্যাংকিং নীতির কারণে রেমিট্যান্স পাঠানো কঠিন হয়ে পড়ছে, যা উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনীতিকে দুর্বল করছে।
জার্মানির আসন্ন নির্বাচন অভিবাসীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে নতুন অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে। একইভাবে, যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধ অভিবাসীদের গণহারে ফেরত পাঠানো বিশ্বব্যাপী উদ্বেগ বাড়িয়েছে। সুইডেনে সাম্প্রতিক সহিংসতায় নিহতদের বেশিরভাগই অভিবাসী, যা প্রশ্ন তুলছে—সহিংসতার মূল কারণ কি অভিবাসন, নাকি বৈষম্যমূলক নীতি ও সামাজিক বিভাজন?
বিশ্বব্যাপী অস্থিরতা: বাস্তবতা ও সম্ভাবনা
বিশ্ব এখন দ্বিধাবিভক্ত—একদিকে সংকট, সংঘাত ও বৈষম্য; অন্যদিকে সম্ভাবনা, অগ্রগতি ও সমাধানের পথ। ভূ-রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, অর্থনৈতিক বৈষম্য, জলবায়ু পরিবর্তন, এবং অভিবাসন সংকট আমাদের সময়ের কঠিন বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে, বিশ্ব নেতৃত্বের ভূমিকা কী হওয়া উচিত?
বৈশ্বিক শক্তির দ্বন্দ্ব ও ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতা
চীন আজকের বিশ্ব রাজনীতির অন্যতম নিয়ামক, যার নীতি ও কার্যক্রম বৈশ্বিক ভারসাম্যকে প্রভাবিত করছে।
• বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (BRI): অবকাঠামো উন্নয়নের সুযোগ তৈরি করলেও, এটি অনেক দেশকে চীনের অর্থনৈতিক আধিপত্যের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
• উইঘুর নিপীড়ন ও মানবাধিকার লঙ্ঘন: চীনের পশ্চিমাঞ্চলে উইঘুর মুসলিমদের ওপর দমন-পীড়নের অভিযোগ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে।
• তাইওয়ান ও দক্ষিণ চীন সাগরে সামরিক উত্তেজনা: চীনের সম্প্রসারণবাদ এশিয়ার নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলছে।
মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার সংকট: সংঘাত ও মানবিক বিপর্যয়
মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাত অভিবাসন সংকটকে আরও তীব্র করছে।
• সিরিয়া ও ইয়েমেন যুদ্ধ: দীর্ঘস্থায়ী গৃহযুদ্ধের ফলে লক্ষ লক্ষ মানুষ উদ্বাস্তু হয়েছে।
• ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত: মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতা আজ চরম হুমকির মুখে।
• আফ্রিকার রাজনৈতিক অস্থিরতা, দারিদ্র্য এবং জলবায়ু পরিবর্তন আরও গভীর সংকট সৃষ্টি করেছে।
• সাহেল অঞ্চলে জঙ্গি তৎপরতা: মালি, নাইজার ও বুরকিনা ফাসোতে সন্ত্রাসী হামলা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
• বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের জটিলতা: সীমান্ত হত্যা, পানিসম্পদ বণ্টনে বৈষম্য এবং রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতার জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সংখ্যালঘু নিপীড়ন ও দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে ভারসাম্যহীনতা নিয়েও উদ্বেগ বাড়ছে।
• খাদ্য সংকট: জলবায়ু পরিবর্তন ও সংঘাতের কারণে আফ্রিকায় দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে।
বাংলাদেশের করণীয়: সংকটের মাঝে সম্ভাবনা
বিশ্বের এই অস্থির পরিস্থিতিতে বাংলাদেশকে এগিয়ে যেতে হলে কৌশলগত পরিকল্পনার প্রয়োজন।
১. প্রবাসীদের সুরক্ষা ও অভিবাসন নীতি
• প্রবাসী শ্রমিকদের অধিকার রক্ষায় আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কূটনৈতিক চাপ বাড়ানো।
• দক্ষ জনশক্তি তৈরির জন্য প্রশিক্ষণ ও শিক্ষাব্যবস্থার আধুনিকায়ন।
২. জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা
• আন্তর্জাতিক ফোরামে বাংলাদেশের দাবিকে আরও শক্তিশালী করা।
• নবায়নযোগ্য শক্তির ওপর বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং উপকূলীয় জনগোষ্ঠীর জন্য পুনর্বাসন পরিকল্পনা গ্রহণ।
৩. অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা
• পোশাক শিল্পের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে প্রযুক্তি, কৃষি, ওষুধ ও চামড়া শিল্পে বৈচিত্র্য আনা।
• দক্ষ কর্মসংস্থান তৈরির জন্য টেকনিক্যাল শিক্ষা ও ভোকেশনাল ট্রেনিংয়ের ওপর গুরুত্ব দেওয়া।
৪. রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও গণতন্ত্র
• গণতন্ত্র ও সুশাসন নিশ্চিত করতে রাজনৈতিক সংলাপ বাড়ানো।
• দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ।
৫. যুবসমাজ ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
• শিক্ষাব্যবস্থা আধুনিকীকরণ করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) ও প্রযুক্তির ওপর জোর দেওয়া।
• উদ্যোক্তাদের জন্য সহজ ঋণের ব্যবস্থা করা এবং নতুন স্টার্টআপকে উৎসাহিত করা।
বিশ্বব্যাপী সংকট থেকে উত্তরণ: আমাদের করণীয় কী?
✅ মানবাধিকারের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান: জাতিগত বিদ্বেষ ও সাম্প্রদায়িক সংঘাতের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে।
✅ আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি: বৈশ্বিক সমস্যা সমাধানে দেশগুলোকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।
✅ গণতন্ত্র ও সুশাসন নিশ্চিতকরণ: প্রতিটি দেশে স্বচ্ছ সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা জরুরি।
✅ নতুন প্রজন্মের সচেতনতা বৃদ্ধি: তরুণদের শান্তি, ন্যায়বিচার ও বৈষম্যহীন সমাজ গঠনে নেতৃত্ব দিতে হবে।
✅ অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার নিশ্চিতকরণ: দরিদ্র দেশগুলোর প্রতি বৈষম্যমূলক নীতি পরিহার করে একটি ন্যায্য বৈশ্বিক অর্থনৈতিক কাঠামো তৈরি করতে হবে।
নতুন বিশ্বব্যবস্থা: সংকট নাকি সম্ভাবনা?
বিশ্ব এক দ্বিধাবিভক্ত মোড়ে দাঁড়িয়ে—একদিকে বিভাজন, যুদ্ধ ও সংকট, অন্যদিকে ঐক্য, সহযোগিতা ও শান্তি। আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমরা কোন পথে হাঁটব।
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা, সামরিক শক্তির পরিবর্তে কূটনৈতিক সংলাপকে অগ্রাধিকার দেওয়া এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়তা প্রদান আজ অত্যন্ত জরুরি।
বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক কাঠামোর সংস্কার প্রয়োজন, যেখানে ধনী দেশগুলো কেবল নিজেদের স্বার্থ দেখবে না, বরং উন্নয়নশীল দেশগুলোর টেকসই উন্নয়নেও ভূমিকা রাখবে।
বর্তমান সংকট আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জ হলেও, এটি সম্ভাবনার দুয়ারও খুলে দিচ্ছে। যদি আমরা ঐক্যবদ্ধ হই, সহযোগিতার হাত বাড়াই এবং ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়াই, তাহলে আজকের এই অস্থিরতা পেরিয়ে আমরা একটি নতুন পৃথিবীর দিকে এগিয়ে যেতে পারব—একটি সমতার, ন্যায়বিচারের এবং মানবিক মূল্যবোধের বিশ্ব।
রহমান মৃধা, গবেষক ও লেখক, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন, Rahman.Mridha@gmail.com