সংকট এবং সম্ভাবনা
বাংলাদেশে গণমাধ্যম, শিক্ষা এবং দক্ষ মানবসম্পদ গঠন
প্রকাশ: ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৩:০০ এএম

রহমান মৃধা, গবেষক ও লেখক, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন
বাংলাদেশ একটি দ্রুত বর্ধনশীল দেশ, কিন্তু তার সঠিক উন্নয়নের জন্য অনেক ক্ষেত্রেই চ্যালেঞ্জ রয়েছে। বিশেষত, গণমাধ্যম, শিক্ষা এবং দক্ষ মানবসম্পদ গঠন—এই তিনটি ক্ষেত্র বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে, এই ক্ষেত্রগুলোতে বর্তমানে নানা ধরনের সংকট বিদ্যমান, যার প্রভাব দেশের সামগ্রিক অগ্রগতির উপর পড়ছে। এই আর্টিকেলে, আমি বাংলাদেশের গণমাধ্যম, শিক্ষা এবং দক্ষ মানবসম্পদ গঠনের বর্তমান অবস্থা, সমস্যাগুলি এবং তা সমাধানের উপায় আলোচনা করবো, পাশাপাশি উন্নত দেশগুলোর উদাহরণের মাধ্যমে সম্ভাব্য সমাধান পর্যালোচনা করবো।
গণমাধ্যমের সংকট এবং সম্ভাবনা কী হতে পারে?
বাংলাদেশে গণমাধ্যম একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, কিন্তু এর স্বাধীনতা এবং নৈতিকতা অনেক সময় প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে থাকে। বিশেষত, সামাজিক মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলোর বিস্তৃতি এবং প্রযুক্তিগত উন্নতির কারণে অনেক সময় ভুয়া তথ্য ছড়িয়ে পড়ে, যা দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে ঝুঁকির মুখে ফেলে। গণমাধ্যমের মালিকানার প্রতি রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এবং সংবাদ মাধ্যমের অদক্ষতা বিশেষভাবে উদ্বেগজনক।
তবে, যদি সাংবাদিকদের জন্য সঠিক প্রশিক্ষণ এবং স্বাধীনতার পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়, তবে দেশের গণমাধ্যম আরও শক্তিশালী এবং বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোর গণমাধ্যম ব্যবস্থায় সাংবাদিকদের জন্য উচ্চমানের প্রশিক্ষণ এবং পেশাদারিত্বের উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়, যা বাংলাদেশের জন্য একটি মডেল হতে পারে।
তাছাড়া, বাংলাদেশে সামাজিক মাধ্যমের ব্যবহার বেড়ে যাওয়া গণমাধ্যমের নতুন সম্ভাবনার দিকে ইঙ্গিত করে। ইউটিউব এবং টিকটক প্ল্যাটফর্মগুলো থেকে দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবেশে ব্যাপক প্রভাব সৃষ্টি হয়েছে, যা একটি নতুন ধরণের গণমাধ্যম হিসেবে কাজ করছে। এই পরিবর্তনগুলি যদি সঠিকভাবে ব্যবহৃত হয়, তবে গণমাধ্যমে একটি নতুন যুগ শুরু হতে পারে।
গণমাধ্যম: দুর্নীতিমুক্ত, স্বচ্ছ ও স্বাধীন চেতনায় পুনর্গঠন প্রয়োজন কেন?
গণমাধ্যমের বর্তমান অবস্থায় স্পষ্ট যে, এটি সাধারণ মানুষের কথা বলার পরিবর্তে নির্দিষ্ট গোষ্ঠী, করপোরেট স্বার্থ এবং রাজনৈতিক চাপের অধীন হয়ে পড়েছে। গণমাধ্যমে কৃষি, গ্রামীণ অর্থনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর জায়গা নেই। বরং প্রভাবশালী ব্যক্তি, ব্যবসায়ী এবং রাজনৈতিক দলের খবর বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে।
এই সংকটের মূল কারণ হলো গণমাধ্যমের মালিকানা, অর্থায়ন এবং বিজ্ঞাপননির্ভর কাঠামো। যখন গণমাধ্যম করপোরেট গোষ্ঠী বা রাজনৈতিক দলের স্বার্থে পরিচালিত হয়, তখন এটি জনগণের অধিকার ও কণ্ঠস্বর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এর ফলে গণমাধ্যম সত্যিকারের গণমানুষের হতে ব্যর্থ হচ্ছে।
এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য দুর্নীতিমুক্ত, স্বচ্ছ এবং স্বাধীন চেতনার ভিত্তিতে গণমাধ্যম পুনর্গঠনের উদ্যোগ নিতে হবে।
এখানে কিছু সম্ভব্য সমাধান তুলে ধরা হলো
১. স্বাধীন মালিকানা: করপোরেট স্বার্থমুক্ত একটি মালিকানা কাঠামো তৈরি করতে হবে।
২. স্বচ্ছ অর্থায়ন: বিজ্ঞাপনদাতাদের চাপ থেকে মুক্ত রাখতে বিকল্প আর্থিক মডেল প্রয়োজন।
৩. সঠিক তথ্য ও অনুসন্ধান: নির্ভরযোগ্য তথ্য পরিবেশন এবং অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় জোর দিতে হবে।
৪. সামাজিক সমতা: শহর ও গ্রাম, মধ্যবিত্ত ও খেটে খাওয়া মানুষের কথা একসঙ্গে তুলে ধরা জরুরি।
৫. দায়বদ্ধতা: গণমাধ্যমকে শুধু মাধ্যম নয়, গণমানুষের প্রতি দায়বদ্ধ একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করতে হবে এবং তার জন্য প্রয়োজন সঠিক জ্ঞান অর্জন।
সেক্ষেত্রে অবশ্যই দরকার সুশিক্ষা এবং দক্ষ মানবসম্পদ গঠন করা এবং সেটা কীভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব?
বাংলাদেশের সকল শিক্ষা ব্যবস্থা উন্নতির পথে এগোতে না পারায়, বহু শিক্ষার্থী আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে সক্ষম হচ্ছে না। এখানে শিক্ষক প্রশিক্ষণের অভাব, কনভেনশনাল পাঠ্যক্রম এবং প্রশাসনিক সমস্যাগুলো অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ। তবে, উন্নত দেশগুলো যেমন স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলো এবং সিঙ্গাপুর, যাদের শিক্ষা ব্যবস্থা বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত, তাদের মডেল অনুসরণ করা যেতে পারে। স্ক্যান্ডিনেভিয়া অঞ্চলে প্রকল্পভিত্তিক শিক্ষা, সৃজনশীল চিন্তাভাবনা এবং কমিউনিটিভ লার্নিং শিক্ষার্থীদের জন্য একটি সৃজনশীল ও কার্যকরী পরিবেশ তৈরি করেছে। সিঙ্গাপুরেও দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির জন্য ক্যারিয়ার-ভিত্তিক শিক্ষা এবং নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
বাংলাদেশে যদি শিক্ষকদের উন্নত প্রশিক্ষণ প্রদান এবং শিক্ষার্থীদের জন্য সৃজনশীল এবং সমালোচনামূলক চিন্তা উত্সাহিত করা সম্ভব হয়, তবে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি সহজ হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সাথে সংযুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং আন্তর্জাতিক শিক্ষা মানের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করা যেতে পারে, যাতে শিক্ষার্থীরা বাস্তব জীবনের সমস্যা সমাধানে আরও দক্ষ হয়ে উঠতে পারে। তাত্ত্বিক শিক্ষার পাশাপাশি, শিক্ষার্থীদের কর্মমুখী দক্ষতা অর্জন এবং বাস্তব জীবনে কাজে লাগানোর জন্য গবেষণাভিত্তিক শিক্ষা ও ইন্ডাস্ট্রি সহযোগিতার মাধ্যমে দক্ষতা বৃদ্ধি করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থী এবং গবেষকদের জন্যও আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষণ এবং বিদেশি বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে সহযোগিতা প্রয়োজন। এতে করে শিক্ষকরা নিজেদের গবেষণা ও শিক্ষার দক্ষতা বৃদ্ধি করতে পারবেন, যা দেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার মান উন্নয়নে সহায়ক হবে। এছাড়া, পেশাগত শিক্ষা এবং ইন্টার্নশিপের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের দক্ষতা বৃদ্ধি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষাব্যবস্থা এমনভাবে তৈরি করা উচিত, যাতে শিক্ষার্থীরা তাদের নির্দিষ্ট পেশায় নিয়োজিত হওয়ার আগে সেগুলোর সাথে সম্পর্কিত ইন্টার্নশিপের মাধ্যমে বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারে। যেমন, ডাক্তারদের ক্ষেত্রে কমপক্ষে ছয় মাসের ইন্টার্নশিপের ব্যবস্থা রয়েছে, যাতে তারা তত্ত্বভিত্তিক শিক্ষা অর্জন করার পাশাপাশি বাস্তব জগতের চিকিৎসা সেবা প্রদানে দক্ষ হয়ে ওঠে।
এই ধরনের পেশাগত প্রশিক্ষণ অন্যান্য ক্ষেত্রেও প্রয়োজনীয়। উদাহরণস্বরূপ, প্রকৌশলী, আইনজীবী, অর্থনীতিবিদ কিংবা অন্যান্য পেশায় যারা যুক্ত হতে যাচ্ছে, তাদেরও সেই পেশার সাথে সম্পর্কিত প্রশিক্ষণ এবং “অন দ্য জব ট্রেনিং” নিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে শুধুমাত্র তাত্ত্বিক জ্ঞান প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে নয়, বরং শিক্ষার্থীদের কর্মজীবনে দক্ষ করে তোলার কেন্দ্র হিসেবে কাজ করতে হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যখন ইন্টার্নশিপে অংশ নেবে, তখন তারা শুধুমাত্র পেশাগত দক্ষতা অর্জন করবে না, বরং সেই প্রতিষ্ঠানে ঘটে যাওয়া দুর্নীতি, ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্টের ত্রুটি এবং প্রশাসনিক গাফিলতির মতো সমস্যাগুলো পর্যবেক্ষণ করেও একটি গবেষণামূলক প্রতিবেদন তৈরি করতে পারবে।
এখন আসা যাক, কীভাবে আমরা অভিজ্ঞ এবং মানসম্মত সাংবাদিকদের প্রশিক্ষণ এবং দক্ষতার মূল্যায়ন করবো:
বাংলাদেশে সাংবাদিকদের জন্য প্রশিক্ষণ এবং দক্ষতা মূল্যায়নের ব্যবস্থা অপরিহার্য। ডেটা জার্নালিজম, ফ্যাক্ট-চেকিং এবং মাল্টিমিডিয়া রিপোর্টিং—এই সমস্ত দক্ষতা সাংবাদিকদের আধুনিক প্রযুক্তি এবং প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারে সাহায্য করতে পারে। দক্ষিণ কোরিয়া এবং শ্রীলঙ্কায় সাংবাদিকদের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রোগ্রাম চালু রয়েছে, যা তাদের কাজের মান বাড়িয়ে তুলছে।
বাংলাদেশেও যদি বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট এবং অন্যান্য সাংবাদিকতা সংস্থাগুলোর মাধ্যমে সাংবাদিকদের জন্য উন্নত প্রশিক্ষণ প্রোগ্রাম তৈরি করা যায়, তবে তারা দেশের গণমাধ্যম ব্যবস্থার উন্নতি সাধনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারবে। একইসাথে, সাংবাদিকদের দক্ষতা মূল্যায়নের জন্য একটি নিরপেক্ষ মূল্যায়ন ব্যবস্থা তৈরি করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যা তাদের পেশাদারিত্ব এবং নৈতিকতা নিশ্চিত করবে।
গণমাধ্যমের কাঠামোগত সংস্কার এখন সময়ের দাবি। এটি কেবলমাত্র নিরপেক্ষতা, পেশাদারিত্ব এবং জনগণের অধিকার রক্ষা নিশ্চিত করেই সম্ভব। গণমাধ্যম যদি স্বাধীন চেতনা, সঠিক তথ্য এবং সাধারণ মানুষের কল্যাণে কাজ না করে, তবে এটি তার মূল উদ্দেশ্য হারাবে। তাই একটি স্বচ্ছ, দায়িত্বশীল এবং নীতিনিষ্ঠ গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠার দিকে মনোযোগ দেওয়া সময়ের দাবী।
পরিশেষে বলতে চাই
বাংলাদেশে গণমাধ্যম, শিক্ষা এবং দক্ষ মানবসম্পদ গঠন বর্তমানে একটি জটিল পরিস্থিতির মুখোমুখি। তবে, যদি দেশের এই তিনটি গুরুত্বপূর্ণ খাতে সঠিক সংস্কার এবং আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়, তবে বাংলাদেশ দ্রুত উন্নতি করতে সক্ষম হবে। স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোর গণমাধ্যম মডেল, পেশার সাথে সম্পর্কিত প্রশিক্ষণ ও “অন দ্য জব ট্রেনিং” শিক্ষা ব্যবস্থা, এবং দক্ষিণ কোরিয়ার সাংবাদিকতা প্রশিক্ষণ—এই উদাহরণগুলো অনুসরণ করে বাংলাদেশে গণমাধ্যম, শিক্ষা এবং মানবসম্পদ গঠনের ক্ষেত্রে একটি বিপ্লবী পরিবর্তন আনা সম্ভব।
এটি যদি বাস্তবায়িত হয়, তবে বাংলাদেশের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিবেশ উজ্জ্বল হতে পারে। এই পরিবর্তনের মাধ্যমে দেশটির গণতন্ত্র আরও শক্তিশালী হবে, শিক্ষা ব্যবস্থা আরও উন্নত হবে, এবং দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি হবে, যা দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করবে।
রহমান মৃধা, গবেষক ও লেখক, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন, Rahman.Mridha@gmail.com