নতুন বছরে প্রয়োজন রাজনীতির পরিশুদ্ধতা

মোহাম্মাদ মনিরুজ্জামান
প্রকাশ: ১৩ জানুয়ারি ২০২৫, ০৯:৩১ পিএম

মোহাম্মাদ মনিরুজ্জামান, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী
বেশ কিছু দিন আগে, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন গবেষক বিশ্বের যেসব দেশে বিগত কয়েক দশকে গণ আন্দোলন-গণবিক্ষোভ হয়েছে সেগুলোর ওপর গবেষণা চালিয়েছেন। এই গবেষণার ভিত্তিতে তিনি বলেছেন, কোন জনগোষ্ঠীর মাত্র ৩ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ যদি গণবিক্ষোভে যোগ দেন, তাতেই তারা সফল হতে পারেন।
যদি কোনো দেশের লোকসংখ্যা ষোল কোটি হয় তবে আটচল্লিশ লক্ষ মানুষকে গণবিক্ষোভ ফেটে পড়তে হবে। সম্প্রতি বাংলাদেশে আন্দোলনকারীদের সংখ্যা জানা না থাকলেও অধিকাংশ মানুষের সমর্থন ছিল তা আন্দোলনের ব্যাপ্তি দেখলে বুঝা যায়। লেখক ও রাজনীতিবিদ বুদ্ধিজীবী বদরুদ্দীন উমর বলেছেন `চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থান ছিল বায়ান্ন সাল থেকে এখন পর্যন্ত সংঘটিত অভ্যুত্থানগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ব্যাপক, গভীর ও আক্রমণাত্মক।
গণঅভ্যুত্থান সাধারণত কোনো একটি নির্দিষ্ট ঘটনার ফলে হয় না। বরং এটি সমাজে দীর্ঘদিন ধরে চলা বিভিন্ন সমস্যা ও অসন্তোষের ফসল। এই সমস্যাগুলোর মধ্যে রয়েছে:
অর্থনৈতিক বৈষম্য:
দেশের সম্পদ কয়েকজনের হাতে কেন্দ্রীভূত হওয়া, দারিদ্র্য, বেকারত্ব ইত্যাদি কারণে গণঅভ্যুত্থানের সৃষ্টি হয়। এতে অল্প কয়েকজন ধনী থেকে ধনী হয়। আর অন্যরা গরিব থেকে গরিব হয়।
রাজনৈতিক দুর্নীতি:
সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, জনগণের উপর নির্যাতন। এছাড়াও বিরোধী দলকে রাজনীতি করতে না দেওয়া, ভিন্নমত দমন রয়েছে।
সামাজিক অবিচার:
ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, জাতি ইত্যাদির ভিত্তিতে বৈষম্য, মানবাধিকার লঙ্ঘন ইত্যাদি।
রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতার অভাব:
বিদেশি শক্তির দখলদারিত্ব, ন্যায্য আন্দোলন দমন ইত্যাদি। বাংলাদেশে স্বাধীনতার যুদ্ধ থেকে শুরু করে বিভিন্ন সময়ে জনগণের অধিকার আদায়ের জন্য গণ আন্দোলন সংঘটিত হয়েছে। এই আন্দোলনগুলোর মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিবর্তনও হয়েছে। তবে প্রশ্ন হলো, এই গণঅভ্যুত্থানগুলো কি রাজনীতিকে সত্যিই পরিশুদ্ধ করতে পেরেছে? ইতিহাস বলছে, বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে গণঅভ্যুত্থানের পরেও দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার দূর হয়নি। এর কারণ কি?
রাজনৈতিক সংস্কৃতির ঘাটতি:
বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে গভীরভাবে প্রোথিত আছে দলীয় স্বার্থ, ব্যক্তিবাদ এবং ক্ষমতার লোভ। এই সংস্কৃতির পরিবর্তন না হলে কোনো গণঅভ্যুত্থানই স্থায়ী পরিবর্তন আনতে পারবে না। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো নিজ দলের স্বার্থে ঘৃণিত দলের সাথে আঁতাত করে। যার ফলে জনমুখী নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তে পুরনো রাজনৈতিক বন্দোবস্তে আটকে থাকে।
প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা:
বলা হয়ে থাকে দেশের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো ঠিকভাবে ফাংশন না করলে একটা জাতি ব্যর্থ হয়ে যায়। বিখ্যাত বই ‘হোয়াই ন্যাশনস ফেইল’ বইতে ব্যাখ্যা করা আছে কীভাবে একটা দেশের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যর্থ হলে দুর্নীতি আর গরিব রাষ্ট্রে পরিণত হয়। বাংলাদেশের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা যথেষ্ট শক্তিশালী নয়। আইন প্রয়োগ সংস্থা, বিচার বিভাগ, এবং নির্বাচন কমিশন – এই সব প্রতিষ্ঠানের স্বাধীনতা এবং নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা জরুরি।
জনগণের সচেতনতা:
জনগণের রাজনৈতিক সচেতনতা বাড়ানো জরুরি। জনগণ যদি মূল বিষয় ফোকাস না দিয়ে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যায়। তাহলে তাদের আসল অধিকার অর্জন হবে না। জনগণ যাতে তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয় এবং রাজনীতিবিদদের জবাবদিহি করতে শিখে, সেদিকে নজর দিতে হবে। জনগণের সজাগ দৃষ্টি রাজনৈতিকদলগুলোর কর্মকাণ্ড সঠিক পথে পরিচালিত করতে বাধ্য করবে।
দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা:
গণঅভ্যুত্থানের পরে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করা জরুরি। রাজনৈতিক সংস্কার, প্রাতিষ্ঠানিক শক্তিশালী-করণ, এবং জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার মতো বিষয়গুলো এই পরিকল্পনার মধ্যে থাকতে হবে। সংবিধান এমনভাবে সাজাতে হবে যেন তার মধ্য দিয়ে ফ্যাসিবাদ না দাড়াতে পারে। সংবিধানে এমন ধারা থাকবে যাতে আর কখনো কেউ স্বৈরাচারী হয়ে দাড়াতে আর না পারে।
সুশাসন:
সুশাসনের ধারণাটিকে জীবনযাত্রার একটি অংশ করে তুলতে হবে। সুশাসনই গণঅভ্যুত্থানের প্রধান সুর। সুশাসন থাকলে জনগণের জয় হবে। আর কখনো দমনমূলক কিছু দাড়াতে পারবে না। সুশাসনে দুর্নীতি দমন, স্বচ্ছতা, এবং জবাবদিহিতা – এই সব বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিতে হবে।
সিভিল সোসাইটি:
সিভিল সোসাইটির ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তারা সরকারকে জবাবদিহি করতে সাহায্য করতে পারে এবং জনগণের অধিকার রক্ষার জন্য কাজ করতে পারে। তারা যদি সোচ্চার থাকে তাহলে সরকার স্বৈরাচারী হতে পারে না। সরকার সবসময় চাপে থাকে। এর ফলে এক ধরনের নীতিগত ব্যালেন্স তৈরি হয়।
শিক্ষা:
শিক্ষার মাধ্যমে মানুষকে সচেতন করা যায়। দেশের উন্নয়নের জন্য সবচেয়ে বেশি জরুরি শিক্ষা। শিক্ষা ব্যবস্থাকে এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে যাতে মানুষ গণতন্ত্র, মানবাধিকার, এবং সুশাসনের গুরুত্ব বুঝতে পারে।
মিডিয়া:
মিডিয়া একটি শক্তিশালী মাধ্যম। তারা সত্য তথ্য প্রকাশ করে এবং জনগণকে সচেতন করতে পারে। স্বাধীন এবং নিরপেক্ষ মিডিয়া একটি গণতান্ত্রিক সমাজের জন্য অপরিহার্য। কিন্তু অতীতে বাংলাদেশের মিডিয়া সরকারের পক্ষ হয়ে কথা বলেছে। জনগণের হয়ে উঠতে পারেনি।
বাংলাদেশের রাজনীতির পরিবর্তনের জন্য শুধু গণঅভ্যুত্থানই যথেষ্ট নয়। এর সাথে সাথে রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন, প্রাতিষ্ঠানিক শক্তিশালী-করণ, জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি, এবং দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করা জরুরি। সুশাসন, সিভিল সোসাইটি, শিক্ষা, এবং মিডিয়া– এই সব ক্ষেত্রে কাজ করার মাধ্যমে আমরা একটি সুন্দর ও উন্নত বাংলাদেশ গড়তে পারি।
আর গণঅভ্যুত্থান ব্যর্থ হলে দেশে অস্থিরতা ও অরাজকতা সৃষ্টি হতে পারে। বিদেশি হস্তক্ষেপের সুযোগ সৃষ্টি হয়। তাই গণঅভ্যুত্থানের স্পিরিট ধারণ করতে হবে সকলকে। এর মাধ্যমে জনগণের কল্যাণমুখী যাত্রা শুরু হয়।
মনে রাখতে হবে, রাজনীতির পরিশুদ্ধতা একটি চলমান প্রক্রিয়া। এটি একদিনে সম্ভব নয়। সবার যৌথ প্রচেষ্টায় আমাদের নতুন সময়ে এই লক্ষ্য অর্জন করতে হবে।
লেখক: মোহাম্মাদ মনিরুজ্জামান, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, ইমেইল: monirmaxwell2014@gmail.com