ভারতে প্রথম 'বিমান ছিনতাই'য়ের ঘটনা প্রভাব ফেলেছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধেও

কাগজ ডেস্ক
প্রকাশ: ৩১ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:২৫ এএম

ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের বিমান 'হাইজ্যাকের' ঘটনা প্রকাশ্যে আসার পর ভারতে তোলপাড় শুরু হয়
সালটা ছিল ১৯৭১, আর ঘটনাটা ৩০ জানুয়ারির। শ্রীনগর থেকে জম্মুগামী ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের ফোকাহ ফ্রেন্ডশিপ ফ্লাইট 'গঙ্গা'-তে দু'জন যুবক সওয়ার ছিলেন। বয়স এতটাই অল্প ছিল যে দেখে মনে হচ্ছিল সবেমাত্র গোঁফ গজিয়েছে তাদের।
সেই সময়, অর্থাৎ ১৯৭১ সাল নাগাদ শুধু বিত্তবান ব্যক্তিরাই বিমানে যাতায়াত করতেন এবং যাত্রীদের নিরাপত্তা তল্লাশিও করা হতো সংক্ষিপ্তভাবে।
বিমানে বসার পর ওই দুই যুবক বেশ ঘাবড়ে ছিলেন। এর একটা কারণ ছিল এটাই তাদের প্রথম বিমানযাত্রা। আর দ্বিতীয় কারণ হলো, কিছুক্ষণের মধ্যেই ওই বিমান হাইজ্যাক করতে চলেছিলেন দুই যুবক।
ঠিক সাড়ে এগারোটা নাগাদ বিমান জম্মুর দিকে উড়তে শুরু করে। অনুশা নন্দকুমার এবং সন্দীপ সাকেত তাদের 'দ্য ওয়ার দ্যাট মেড আর অ্যান্ড এডব্লিউ' বইয়ে উল্লেখ করেছেন, ‘জানালার পাশে বসা হাশিম কুরেশি তাকাচ্ছিলেন আশরাফ কুরেশির দিকে। দু'জনেই মাথা নেড়ে আস্তে আস্তে কলমা পড়তে থাকেন। এরপর দ্রুত সিটবেল্ট খুলে নিচু হয়ে নিজেদের ব্যাগ থেকে পিস্তল ও হ্যান্ড গ্রেনেড বের করেন।’
‘ককপিটের দিকে দৌড়ে যান হাশিম। তার পিস্তলের ব্যারেল পাইলটের মাথার পেছনে ঠেকিয়ে বিমানের নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নিয়ে নেন। হাতে হ্যান্ড গ্রেনেড নিয়ে ককপিটে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন আশরাফ। যাত্রীরা কান্নাকাটি-চেঁচামেচি শুরু করলে আশরাফ চিৎকার করে তাদের চুপ করতে বলেন। পুরো বিমান জুড়ে ছিল পিনপতন নিরবতা।’
সেই সময় পাকিস্তানের কার্যকলাপের ওপর কড়া নজর রাখতো দিল্লির লোধি রোডে অবস্থিত 'রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিসিস' বা 'র'-এর সদর দপ্তর।
পাকিস্তানের সামরিক অভ্যুত্থান, ইয়াহিয়া খানের ক্ষমতায় আসা, নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমানের জয় ও ক্ষমতা দখলের জন্য চলতে থাকা দরকষাকষির বিষয়ে প্রতিনিয়ত বিশ্লেষণ করে চলেছিলেন গোয়েন্দা সংস্থা 'র' প্রধান রামনাথ কাও এবং তার টিমের সদস্যরা।
এই পরিস্থিতিতে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে ফ্লাইট চলাচল বৃদ্ধি নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন 'র'-এর প্রধান।
হাশিম কুরেশির গ্রেপ্তার
পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানের দূরত্ব ছিল প্রায় ২০০০ কিলোমিটার। পূর্ব পাকিস্তানগামী প্রতিটা পাকিস্তানি বিমানকে ভারতের আকাশসীমা ব্যবহার করতে হতো।
যেভাবে হোক ভারতের আকাশসীমায় পাকিস্তানি বিমানের উড়ান বন্ধ করতে চাইছিল 'র' যাতে ইয়াহিয়া খানের সমস্যা আরো বাড়ে। এই পরিকল্পনা কীভাবে বাস্তবায়িত করা যায়, সে বিষয়ে ক্রমাগত মাথা খাটিয়ে চলেছিলেন 'র'-এর কর্মকর্তারা। কারণ ভারতের আকাশসীমায় না উড়তে দেয়ার জন্য বিশ্বের সামনে একটা পোক্ত যুক্তি দেখানোর প্রয়োজন ছিল।
এই সমস্ত কিছুর মাঝেই সীমান্তরক্ষী বাহিনীর একটা রিপোর্ট এসে পৌঁছায় মি. কাওয়ের ডেস্কে।
ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিল, সীমান্তরক্ষী বাহিনী হাশিম কুরেশি নামে এক ব্যক্তিকে ভারত সীমান্তে গ্রেপ্তার করেছে, যে কিনা ভারতে অস্ত্র ও বিস্ফোরক নিয়ে আসার চেষ্টা করছিল।
অনুশা নন্দকুমার ও সন্দীপ সাকেত তাদের বইয়ে উল্লেখ করেছেন, ‘জিজ্ঞাসাবাদের সময় হাশিম জানায়, সে ১৯৬৯ সালে তার কাকার সঙ্গে পেশোয়ার গিয়েছিল কিছুদিনের জন্য। সেখানে ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্টের প্রতিষ্ঠাতা মকবুল বাটের সঙ্গে তার পরিচয় হয় তার।’
‘হাশিমের মগজ ধোলাই করে কাশ্মীরের স্বাধীনতার জন্য তাকে কাজ করতে রাজি করানো হয়েছিল। সেখানে এনএলএফ ক্যাম্পে অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়। একই সঙ্গে তাকে ভারতীয় বিমান ছিনতাইয়ের নির্দেশ দেয়া হয়, যাতে এনএলএফের এজেন্ডা সারা বিশ্বে প্রচার করা যায়।’
জিজ্ঞাসাবাদের সময় আরো অনেক তথ্যই জানিয়েছিলেন হাশিম কুরেশি। তার উল্লেখ রয়েছে 'দ্য ওয়ার দ্যাট মেড আর অ্যান্ড এডব্লিউ' বইয়ে।
অনুশা নন্দকুমার ও সন্দীপ সাকেত ওই বইয়ে উল্লেখ করেছেন, "হাশিম বিএসএফ কর্মকর্তাদের জানিয়েছিলেন যে ফোকাহ ফ্রেন্ডশিপ বিমান দেখতে কেমন সে সম্পর্কে ধারণা দেয়ার জন্য তাকে রাওয়ালপিন্ডির চাকলাতা বিমানবন্দরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।"
"সেখানে পাকিস্তানি বিমান বাহিনীর সাবেক পাইলট জাভেদ মিন্টো তাকে বিমান সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য দেন। এরপর বিমান হাইজ্যাক করার জন্য অস্ত্র দিয়ে তাকে ভারতের সীমান্ত পার করিয়ে দেয়া হয়।"
কিন্তু বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স বা ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে যান তিনি।
রাজীব গান্ধীর বিমান হাইজ্যাকের পরিকল্পনা
ইরি্রিয়ান লিবারেশন ফোর্সের তিন সশস্ত্র বিদ্রোহী ১৯৬৯ সালে করাচি বিমানবন্দর থেকে ইথিওপিয়ান এয়ারলাইন্সের একটা বিমান হাইজ্যাক করেছিল। ভারতীয় বিমান ছিনতাইয়ের ছক কষা হয়েছিল ওই ঘটনার অনুকরণেই।
ইরি্রিয়ান লিবারেশন ফোর্সের সশস্ত্র বিদ্রোহীদের পরে গ্রেপ্তার করা হয় এবং এক বছরের কারাদণ্ডও দেয়া হয়েছিল।
অনুশা নন্দকুমার এবং সন্দীপ সাকেত তাদের বইয়ে লিখেছেন, ‘বিএসএফ কর্মকর্তারা হাশিমকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে বিমান ছিনতাই করলে কাশ্মীর স্বাধীনতা পাবে কি না? এর উত্তরে হাশিম যা বলেছিল সেটা শুনে হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন বিএসএফ কর্মকর্তারা।’
‘হাশিম জবাবে জানিয়েছিলেন, ইন্দিরা গান্ধীর ছেলে রাজীব গান্ধী যে বিমান চালাচ্ছেন, সেটা ছিনতাইয়ের জন্য তাকে বলা হয়েছিল।’
'র' প্রধানের পাল্টা পরিকল্পনা
রাজীব গান্ধী সেই সময় ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের পাইলট ছিলেন। জম্মু-শ্রীনগর সেক্টরে বিমান ওড়াতেন তিনি।
গ্রেপ্তার হাশিম কুরেশির দেয়া তথ্য কাজে লাগিয়ে একটা পাল্টা পরিকল্পনা তৈরি করেন রামনাথ কাও যা ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী অনুমোদন করেছিলেন।
'র' এবং ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী হাশিম কুরেশিকে তাদের হয়ে কাজ করার জন্য রাজি করিয়ে ফেলে। হাশিম কুরেশিকে বলা হয়েছিল, এর পরিবর্তে জেলে যাওয়া থেকে রেহাই পাবেন তিনি।
সাবেক 'র' কর্মকর্তা আর কে যাদব তার বই 'মিশন র'-এ লিখেছেন, ‘ঠিক করা হয় যে হাশিম কুরেশিকে ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের বিমান হাইজ্যাক করতে দেয়া হবে।’
"সেখান থেকে তাকে লাহোরে নিয়ে যাওয়া হবে। সেখানে সে যাত্রীদের বিনিময়ে ভারতের জেলে থাকা ৩৬ জন আল-ফাতাহ সদস্যের মুক্তির দাবি জানাবে। কিন্তু ততক্ষণ পর্যন্ত সে ওই বিমানের নিয়ন্ত্রণ পাকিস্তানের কর্তৃপক্ষের হাতে দেবে না যতক্ষণ না জুলফিকার আলী ভুট্টোর সঙ্গে তাকে বৈঠক করতে দেয়া হয়।"
আর কে যাদবের বই অনুসারে, ‘কাওই পরিকল্পনা করেছিলেন যে ভুট্টোর সঙ্গে সাক্ষাতের পর ভারতীয় বিমানে বিস্ফোরণ করিয়ে সেটা ধ্বংস করে দেয়া হবে যাতে সারা বিশ্বে এই বার্তা যায় যে ভারতের জেলে থাকা কাশ্মীরি চরমপন্থিদের মুক্ত করার জন্য এই পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।’
‘এই অভিযানকে সম্পূর্ণ গোপন রাখতে হাশিম কুরেশিকে বেঙ্গালুরুতে 'র'-এর একটা সেফ হাউজে পাঠানো হয়। পুরো বিষয় সম্পর্কে জম্মু ও কাশ্মীর সরকারকে বা অন্য কোনো নিরাপত্তা সংস্থাকে জানানো হয়নি।’
বিমানকে লাহোরে অবতরণের অনুমতি
পরিকল্পনা অনুযায়ী, হাশিম কুরেশিকে বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সে চাকরি দেয়া হয়। তাকে একটা নিয়োগপত্রও দেয়া হয়েছিল যেখানে উল্লেখ করা হয়েছিল যে তিনি এখন বেঙ্গালুরু ব্যাটালিয়ন ১০২ এর সদস্য।
দ্বিতীয় সঙ্গী হিসেবে তারই এক আত্মীয় আশরাফ কুরেশিকে বেছে নেন হাশিম কুরেশি। সেই সময় খবরের কাগজে এক ধরনের পিস্তলের বিজ্ঞাপন দেয়া হতো, যা দেখতে একেবাসে আসল পিস্তলের মতো। মূলত চোরদের ভয় দেখানোর জন্য ব্যবহার করা হতো ওই নকল পিস্তল।
ডাকযোগে ওই পিস্তল অর্ডার করেন হাশিম কুরেশি। তার আত্মীয় আশরাফ কুরেশি কাঠ দিয়ে একটা নকল হ্যান্ড গ্রেনেড তৈরি করে ধাতব রঙে রাঙিয়ে নিয়েছিলেন।
বিমান 'হাইজ্যাকের' পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হয় ১৯৭১ সালের ৩০ জানুয়ারি।
যে বিমান ছিনতাই হওয়ার কথা ছিল সেটা একটি পুরানো বিমান যা ভারতীয় বিমান বাহিনীর ব্যবহারের পর ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্স অধিগ্রহণ করেছিল।
অল ইন্ডিয়া রেডিও থেকে ওই বিমান ছিনতাইয়ের খবর প্রকাশ্যে আসতেই ভারতে তোলপাড় শুরু হয়।
হাশিম কুরেশির নির্দেশে ওই বিমান রাওয়ালপিন্ডির অভিমুখে যাত্রা করলে বিমানের ক্যাপ্টেন এম কে কাচরু ছিনতাইকারীদের জানান, রাওয়ালপিন্ডিতে নিয়ে যাওয়ার মতো পর্যাপ্ত জ্বালানি নেই।
যেকোনো মূল্যে তাদের লাহোরে অবতরণ করতে হবে। ক্যাপ্টেন কাচরুর কণ্ঠস্বর লাহোর এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলে শোনা যায়। লাহোর বিমানবন্দরে তৎক্ষণাৎ অবতরণের অনুমতি চান তিনি।
সর্বোচ্চ পর্যায়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার পর ওই বিমানকে লাহোরে অবতরণের অনুমতি দেয়া হয়।
ইয়াহিয়া সরকারের আশঙ্কা ছিল, পাকিস্তানের আকাশসীমায় জ্বালানি ফুরিয়ে যাওয়ায় কারণে ভারতীয় বিমান বিধ্বস্ত হলে সেটা তাদের বদনাম হবে।
ছিনতাইকারীদের সঙ্গে ভুট্টোর সাক্ষাৎ
দুপুর দেড়টার দিকে ওই বিমান লাহোরে অবতরণ করে। বিমানবন্দরের একটা কোণে রাখা হয় ওই বিমান। থামার সঙ্গে সঙ্গে নিরাপত্তারক্ষীরা চারদিক থেকে ঘিরে ধরেন।
ততক্ষণে কয়েকজন গণমাধ্যমকর্মীও বিমানবন্দরে পৌঁছে গিয়েছেন।
প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ প্রবীণ স্বামী তার বই 'ইন্ডিয়া, পাকিস্তান অ্যান্ড দ্য সিক্রেট জিহাদ: দ্য কভার্ট ওয়ার ইন কাশ্মীর'-এ লিখেছেন, "বিমান অবতরণের সঙ্গে সঙ্গে সেটা সাংবাদিকরা ঘিরে ফেলেন। বিমানের দরজা খুলতেই সিঁড়ি দিয়ে বেরিয়ে আসে হাশিম কুরেশি।"
"সেখান থেকেই সে ঘোষণা করে- আমরা অবিলম্বে এনএলএফের ৩৬জন ভাইয়ের মুক্তি দাবি করছি। যদি সেটা না হয় তবে আমরা সমস্ত যাত্রীদের মেরে ফেলব। এখন সমস্ত কিছু ভারত সরকারের হাতে। এই বলে হাশিম বিমানের ভেতরে চলে যায়।"
যে সময় বিমান ছিনতাইয়ের খবর ছড়িয়ে পড়ে সেই সময় জুলফিকার আলী ভুট্টো ঢাকায় শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজে সাক্ষাতে ব্যস্ত ছিলেন। তিনি তৎক্ষণাৎ লাহোরের উদ্দেশে রওনা হন।
লাহোর বিমানবন্দরে নামার পর তিনি ছিনতাইকারীদের সঙ্গে দেখা করতে যান। হাশিম এবং আশরাফ কুরেশির দাবি শোনেন তিনি এবং যাওয়ার আগে তাদের আলিঙ্গন করেন। বিমানের যাত্রীদের ছেড়ে দেয়ার জন্য তাদের রাজি করান মি. ভুট্টো।
যাত্রীদের 'মুক্তি' পর বিমান ধ্বংস
প্রত্যাশা মতোই ভারত জানায়, 'এনএলএফ চরমপন্থীদের' ছাড়তে নারাজ তারা। অন্যদিকে, লাহোর বিমানবন্দরে অবাধে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন হাশিম কুরেশি। তিনি টেলিফোন ব্যবহার করছিলেন এবং গণমাধ্যমের সঙ্গে খোলামেলাভাবে কথাও বলছিলেন।
আর কে যাদব তার বইয়ে উল্লেখ করেছেন, "দ্বিতীয় ছিনতাইকারী আশরাফ কুরেশি বিমানের ভেতরে থাকা যাত্রীদের ওপর নজর রাখছিল। ভুট্টোর নির্দেশে সমস্ত যাত্রীদের ছেড়ে দেয়া হয়। লাহোরের এক পাঁচতারা হোটেলে রাখা হয় যাত্রীদের।"
"দু'দিন পর তাকে হুসেইনিওয়ালা সীমান্ত দিয়ে সড়কপথে ভারতে ফেরত পাঠানো হয় যাত্রীদের। ২ ফেব্রুয়ারি রাত আটটায় সবার সামনে বিস্ফোরক দিয়ে উড়িয়ে দেয়া হয় ওই বিমান। পরে নিশ্চিত করা হয় যে আইএসআই সদস্যরাই ওই বিমানকে উড়িয়ে দিয়েছিল।"
"জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর হাশিম কুরেশিও তা স্বীকার করে নেয়। পাকিস্তান সরকার প্রাথমিকভাবে এই ছিনতাইকারীদের রাজনৈতিক আশ্রয় দিয়েছিল। ভুট্টো একবারও বিমান ছিনতাইয়ের সমালোচনা করেননি, যা ভারতের এই দাবিকে শক্তিশালী করে তুলেছিল যে বিমান ছিনতাইয়ের পিছনে পাকিস্তান রয়েছে এবং ভুট্টো এ বিষয়ে সবটা জানতেন।"
ভারতের আকাশসীমায় নিষিদ্ধ পাকিস্তানি বিমান
শেখ মুজিবুর রহমান কিন্তু নীরব ছিলেন না। ঢাকা থেকে তিনি বলেছিলেন, পাকিস্তানই এই বিমান হাইজ্যাক করিয়েছে যাতে পূর্ব পাকিস্তানের চলতে থাকা সংকট থেকে দৃষ্টি সরানো যায় এবং ক্ষমতা হস্তান্তরকে বিলম্বিত করা যায়।
এই পরিস্থিতিতে সবার চোখ ছিল ভারতের দিকে। তাদের (ভারতের) অবস্থান কী হবে সে বিষয়ে জানতে উৎসুক ছিল সবাই।
অনুশা নন্দকুমার এবং সন্দীপ সাকেত বইয়ে উল্লেখ করেছেন, "ইন্দিরা গান্ধী প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে বসে কাওকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন- আপনার কী মনে হয়? উত্তরে কাও বলেছিলেন- ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত না হওয়া পর্যন্ত আমরা পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানগামী কোনো বিমানকে ভারতীয় ভূখণ্ডের ওপর দিয়ে যেতে দেব না।"
এদিকে, বিমান ছিনতাইয়ের পর পাকিস্তানের পত্রপত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয় যে হাশিম কুরেশি আসলে 'র'-এর হয়ে কাজ করছেন।
'র'-এর পক্ষ থেকে কখনোই আনুষ্ঠানিকভাবে এই বিষয়ে কিছু জানানো হয়নি। তবে এই সিদ্ধান্তে ভারত যে ব্যাপক লাভবান হয়েছিল তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
যে সমস্ত বিমান পশ্চিম পাকিস্তান থেকে উড়ে তিন-চার ঘণ্টার মধ্যে ঢাকায় পৌঁছাতে পারত, সেগুলো শ্রীলঙ্কায় জ্বালানি ভরে তারপর বাধ্য ঢাকায় যেতে বাধ্য হচ্ছিল।
১৯৭১-এর যুদ্ধে প্রভাব
এই ঘুরপথে ঢাকায় প্রবেশের প্রভাব একাধিক বিষয়ের ওপর পড়েছিল। শ্রীলঙ্কা হয়ে যাওয়ার ফলে শুধু যাতায়াতের সময়ই বাড়েনি, পাকিস্তানের খরচও বেড়েছিল।
আকাশপথে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পূর্ব পাকিস্তানে প্রবেশের দিক থেকেও উল্লেখযোগ্যভাবে রাশ পড়ে। এর উল্লেখযোগ্য প্রভাব দেখা গিয়েছিল ১৯৭১-এ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধেও।
'র'-এর অ্যাডিশনাল সেক্রেটারি বি রমন তার বই 'দ্য কাউ বয়েজ অফ র'-এ লিখেছেন, "ইন্দিরা গান্ধীর পাকিস্তানি বিমান নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত অবশেষে ১৯৭১ সালের যুদ্ধে ভারতের জয়ের পথ প্রশস্ত করে দেয়।"
"পাকিস্তানি বিমান যখন শ্রীলঙ্কা হয়ে পূর্ব পাকিস্তানে যাওয়ার চেষ্টা করতে থাকে, তখন ইন্দিরা গান্ধী শ্রীলঙ্কা সরকারকে চাপ দিয়েছিলেন যাতে পাকিস্তানি বিমানকে জ্বালানি ভরতে না দেয়া হয়।"
"এর ফলে পূর্ব পাকিস্তানে রসদ পাঠানোর বিষয়ে পাকিস্তানের ক্ষমতা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।"
পাকিস্তানের অভিযোগ
গ্যারি বাস তার 'দ্য ব্লাড টেলিগ্রাম' বইয়ে লিখেছেন, "ইয়াহিয়া খান ভারতের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলেন যে তারা নিজেরাই নিজেদের বিমান ছিনতাই করেছে, যাতে তিনি পাকিস্তানি বিমানকে তাদের ভূখণ্ডের ওপর দিয়ে উড়তে না দেয়ার অজুহাত খুঁজে পায়।"
এপ্রিল মাসের মধ্যে হাশিম ও আশরাফ কুরেশিকে পাকিস্তানে নায়কের মর্যাদা দেওয়া হয়। কিন্তু এরপরই তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।
ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার হয়ে কাজ করার অভিযোগে বিশেষ আদালতে হাশিম ও আশরাফ কুরেশির বিচার হয়।
আশরাফ কুরেশিকে মুক্তি দেয়া হলেও হাশিম কুরেশিকে ১৯ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়। এটক, সাহিওয়াল, ফয়সালাবাদ, লাহোর ও মুলতানের বিভিন্ন কারাগারে নয় বছর কাটান। ১৯৮০ সালে তিনি মুক্তি পান হাশিম কুরেশি।
'র' প্রধান দুলাতের সঙ্গে সাক্ষাৎ
মুক্তি পেয়ে পাকিস্তান থেকে হল্যান্ডে চলে যান হাশিম কুরেশি। 'কাশ্মীর: দ্য বাজপেয়ী ইয়ার্স' বইয়ে 'র'-এর সাবেক প্রধান এ এস দুলাত লিখেছেন, "১৯৮৩ সালে মকবুল বাটের মুক্তির জন্য ভারতীয় বিমান ছিনতাইয়ের পরিকল্পনা করেন হাশিম।
আইএসআই তাকে একটা পাসপোর্ট দেয়, যার সুবাদে তিনি লন্ডনে যান এবং তৎকালীন জেকেএলএফ প্রধান আমানউল্লাহ খানের সঙ্গে দেখা করেন।"
"কিন্তু সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। আমি যখন 'র'-এর প্রধান ছিলাম, তখন হাশিম কুরেশি আমার সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছা প্রকাশ করে। হল্যান্ডে আমার সঙ্গে দেখা করতে চায়নি কারণ সেখানে সে গোয়েন্দা সংস্থার হয়ে কাজ করছিল।"
"আমরা অন্য এক দেশে দেখা করি। সেই সময় সে ভারতে ফিরে আসার ইচ্ছা প্রকাশ করে। মজার ব্যাপার হলো, হাশিমের সঙ্গে যখন আমার পরিচয় হয়, তখন হল্যান্ডে র-এর একজন কর্মকর্তা ছিলেন, তার নাম নাম রবীন্দ্র সিং।"
"ইনি 'র' এর সেই অফিসার, যিনি ২০০৪ সালে ভারত থেকে পালিয়ে আমেরিকায় চলে গিয়েছিলেন, যখন জানা যায় যে তিনি সিআইএ-র হয়ে কাজ করছেন।"
ভারতে ফেরার পর গ্রেপ্তার
সাক্ষাতের সময় হাশিম কুরেশির কাছে দুলাত জানতে চান, তিনি কেন ভারতে ফিরতে চাইছেন এবং ফেরার পর তার ভূমিকা কী হবে?
উত্তরে হাশিম কুরেশি জানিয়েছিলেন, কাশ্মীরে রাজনৈতিক কাজকর্ম শুরু হলে তিনি সেখানে নিজের জন্য কিছু না কিছু খুঁজে নেবেন।
শেষ পর্যন্ত ২০০০ সালের ২৯ ডিসেম্বর দিল্লিতে অবতরণ করেন তিনি। দিল্লিতে নামার সঙ্গে সঙ্গেই তার বিরুদ্ধে লুকআউট ওয়ারেন্টের কারণে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
এরপর ১৫ দিন দিল্লির তিহার জেলে বন্দি ছিলেন হাশিম কুরেশি। পরে তাকে শ্রীনগরে নিয়ে যাওয়া হয়, যেখানে তাকে প্রায় এক বছর যৌথ জিজ্ঞাসাবাদ কেন্দ্রে রাখা হয়।
তিনি জামিনে মুক্তি পান ২০০১ সালের নভেম্বরে। হাশিম কুরেশির দুই ছেলে ও দুই মেয়ে রয়েছে। তার এক মেয়ের বিয়ে হয়েছে দুবাইয়ে।
দুলাত তার বইয়ে লিখেছেন, ‘তার মেয়ের বিয়েতে আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। আমি তার ছেলে জুনায়েদের বিয়েতেও গিয়েছিলাম।’
‘হাশিমকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আমি ‘র’-এর সাবেক প্রধান। আমি কি বিয়েতে আসব? আমার আসাটা কাশ্মীরে আপনাদের জন্য সমস্যা তৈরি করবে না? হাশিম হাসতে হাসতে বলেছিল, অদের বলতে দিন আমি আপনার এজেন্ট।’
হাশিম কুরেশি এখনও শ্রীনগরে থাকেন। তিনি কাশ্মীরের বিভিন্ন সংবাদপত্রে লেখালেখি করেন। কাশ্মীর নিয়ে এখনও পর্যন্ত পাঁচটা বই লিখেছেন তিনি।