ঢালাও মামলা নিয়ে বিতর্ক তুঙ্গে, অন্তর্বর্তী সরকারের পদক্ষেপ কী?

কাগজ ডেস্ক
প্রকাশ: ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৮:২৬ পিএম

ছবি : সংগৃহীত
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকার পরিবর্তনের পর থেকে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন থানায় যেসব হত্যা মামলা হয়েছে, তাতে শত শত ব্যক্তিকে নামে-বেনামে বা অজ্ঞাতনামা আসামি করার বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। মানবাধিকার কর্মী এবং সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এসব মামলা ‘ঢালাও মামলা’ হিসেবে চিহ্নিত করছেন।
এ ধরনের মামলায় সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী, পেশাজীবী, রাজনৈতিক নেতাকর্মীসহ বিভিন্ন শ্রেণির মানুষকে জড়িয়ে হয়রানির অভিযোগ উঠেছে। সরকারের পক্ষ থেকেও স্বীকার করা হয়েছে। এসব মামলার কিছু দিক বিব্রতকর। তবে, এমন হয়রানি বন্ধে এখন পর্যন্ত কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেয়া হয়নি।
ঢালাও মামলার বিস্তৃতি
সরকারবিরোধী বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় বহু হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় করা মামলা নিয়ে দেখা গেছে, বাদীরাও অনেক ক্ষেত্রে জানেন না মামলার আসামিরা কারা। অনেক ক্ষেত্রেই অভিযোগ তোলা হচ্ছে যে পুলিশ বা আইনজীবীরা মামলাগুলো সাজিয়ে দিচ্ছে।
বর্তমানে অন্তত দুই ডজন আওয়ামী লীগ নেতা, ২০ জন পুলিশ কর্মকর্তা, ছয় জন উচ্চপর্যায়ের সাবেক সরকারি কর্মকর্তা এবং ৫৩ জন সাবেক সচিবকে এসব মামলায় আসামি করা হয়েছে। এছাড়াও, অনেক পেশাদার সাংবাদিককে হত্যা মামলায় জড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
সাবেক সরকারের সময়ও একই ধরনের মামলার অভিযোগ থাকলেও সরকার পরিবর্তনের পর চিত্র পাল্টায়নি। আওয়ামী লীগ ও সহযোগী দলগুলোর নেতাকর্মীদের আসামি করার পাশাপাশি মামলায় অনেক নিরীহ ব্যক্তিকেও আসামি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠছে -ইন্টারনেট
মামলার প্রসঙ্গ এবং সরকারের বিব্রতকর অবস্থান
সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্নার বিরুদ্ধে রাজধানীর খিলগাঁও থানায় করা একটি হত্যাচেষ্টা মামলা আলোড়ন তোলে। মামলার বাদী মো. বাকের গণমাধ্যমে বলেছেন, তিনি পান্নাকে চেনেন না এবং এজাহারের আসামিদের বিষয়ে অবগত নন। ব্যাপক সমালোচনার পর বাদী ‘অজ্ঞতা ও ভুলবশত’ মামলাটি দায়ের করেছেন বলে আদালতে জানান এবং পরে পান্নার নাম বাদ দেওয়া হয়।
জেড আই খান পান্নার মামলা উদাহরণ দিয়ে মানবাধিকার সংস্থা বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের নির্বাহী পরিচালক সারা হোসেন বলেন, “যদি পান্নার মামলায় এজাহার থেকে নাম বাদ দেয়া যায়, তাহলে অন্য মামলার ক্ষেত্রেও কেন একই পদক্ষেপ নেওয়া হবে না?” তিনি সরকারের পক্ষ থেকে হয়রানিমূলক মামলায় জামিনের বিরোধিতা না করার আহ্বান জানান। সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্নার বিরুদ্ধে রাজধানীর খিলগাঁও থানায় একটি হত্যাচেষ্টা মামলা হলেও সমালোচনার মুখে তার নাম বাদ দেয়া হয়। ছবি : ইন্টারনেট
বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ: কীভাবে প্রতিকার সম্ভব?
সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবীরা মনে করেন, আদালত এবং পুলিশের ভূমিকা এসব মামলার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, প্রায় সব মামলার এজাহার একরকম।
সিনিয়র আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, থানায় এজাহার গ্রহণের সময় বাদীর কাছে সরাসরি প্রশ্ন করলে অনেক মিথ্যা অভিযোগ ধরা পড়ে যাবে। পুলিশ যদি সঠিকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করে, তবে অনেক মিথ্যা মামলা রুখে দেওয়া সম্ভব।” তিনি আরও বলেন, “গায়েবি বা মিথ্যা মামলা দায়েরের জন্য দুই-চারজন বাদীর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিলে এ প্রবণতা অনেকাংশে কমে যাবে।
অন্যদিকে, আইনজীবী পান্না মন্তব্য করেন, সরকার যদি দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করে, তবে এ ধরনের মামলায় জামিন এবং প্রাথমিক তদন্তের সময় আরও সতর্ক হওয়া সম্ভব। আদালতও প্রাইমা ফেসি সত্যতা না পেলে মামলাগুলো খারিজ করতে পারে।আওয়ামী লীগের সরকার ক্ষমতায় থাকার সময়েও বিভিন্ন আন্দোলন চলার সময় অনেক সাধারণ মানুষকে আসামি করার এবং গ্রেপ্তার করার অভিযোগ ছিল। ছবি : ইন্টারনেট
সরকারের বক্তব্য ও নির্দেশনা
ঢাকার বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে এক বৈঠকে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে গায়েবি মামলা হতো। বর্তমান সরকার সরাসরি মামলা করছে না, তবে সাধারণ লোকজন বা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের পক্ষ থেকে ঢালাও মামলা দেয়া হচ্ছে, যা অত্যন্ত বিব্রতকর।
পুলিশের নবনিযুক্ত মহাপরিদর্শক বাহারুল আলম বলেছেন, মামলার নামে নিরীহ মানুষকে হয়রানি করা যাবে না। এমন ঘটলে প্রমাণ সাপেক্ষে মামলা প্রত্যাহারের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তবে এ নির্দেশের পরও হয়রানিমূলক মামলায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার নজির এখনো দেখা যায়নি।
ঢালাও মামলা বন্ধে করণীয়
বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিয়েছেন যে, সরকার থানাগুলোতে নির্দেশনা দিয়ে ঢালাও মামলা প্রত্যাখ্যান করতে পারে। আইন অনুযায়ী ষড়যন্ত্রমূলক বা মিথ্যা মামলার দায়ে বাদীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান রয়েছে। এ ধরনের মামলায় ভুক্তভোগীদের জন্য আইনগত সুরক্ষা এবং তদন্তের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। সরকারের উচিত মামলার ফরম্যাট নিরীক্ষা করা এবং অযৌক্তিকভাবে আসামি করা ব্যক্তিদের নাম দ্রুত বাদ দেওয়ার প্রক্রিয়া তৈরি করা।
ঢালাও মামলার ফলে সাধারণ মানুষ, মানবাধিকারকর্মী, এবং রাজনৈতিক কর্মীরা ব্যাপক হয়রানির শিকার হচ্ছেন। যদিও সরকার এবং পুলিশের পক্ষ থেকে হয়রানি বন্ধে কিছু নির্দেশনা দেয়া হয়েছে, তবুও কার্যকর পদক্ষেপের অভাবে সমস্যার সমাধান এখনো অনিশ্চিত। আইনগত প্রতিকার এবং নীতি-প্রণয়নের মাধ্যমে এ পরিস্থিতির উন্নতি করা সম্ভব বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।