রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির জেনেভা সম্মেলন
জলবায়ু ও দুর্যোগ মোকাবেলায় বাংলাদেশের ভূয়সী প্রশংসা

কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৫ নভেম্বর ২০২৪, ১২:১৪ পিএম

ছবি: ভোরের কাগজ
জেনেভায় রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া মিয়ানমারের বাস্তুচ্যুতদের (রোহিঙ্গা) কষ্ট লাঘবে রাষ্ট্র ও উন্নয়ন সহযোগীদের আর্থিক অনুদানসহ সব ধরনের সহায়তা অব্যাহত রাখার অনুরোধ জানিয়েছে বাংলাদেশ। এছাড়া সম্মেলনে জলবায়ু পরিবর্তন ও দুর্যোগ মোকাবেলায় বাংলাদেশের ভূয়সী প্রশংসা করেন অংশগ্রহণকারীরা। বিশ্বব্যাপী মানবিক সংকট মোকাবিলার বিষয়ে গুরুত্ব দেয়া হয়।
সোমবার (৪ নভেম্বর) বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব জানানো হয়েছে। পাশাপাশি জেনেভো সম্মেলনে আন্তর্জাতিক মানবিক আইন (আইএইচএল) মেনে চলার সংস্কৃতি গড়ে তোলা এবং সশস্ত্র সংঘাতের সময় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির (আইসিটি) অপপ্রচার থেকে বেসামরিক নাগরিক এবং অন্যান্য ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীকে রক্ষা করাসহ পাঁচটি রেজুলেশন গৃহিত হয়েছে বলেও জানানো হয় সংবাদ সম্মেলনে।
বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির (বিডিআরসিএস) চার সদস্যের প্রতিনিধি দলের জেনেভা সম্মেলনে যোগদান, সম্মেলনে গৃহিত সিদ্ধান্ত এবং আলোচ্য বিষয়গুলো তুলে ধরতে এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।
আরো পড়ুন: ইসলামি মহাসম্মেলন: যোগ দিতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জনতার ঢল
রাজধানীর মগবাজারে বিডিআরসিএস কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন সংস্থাটির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) মো. রফিকুল ইসলাম। এছাড়া উপস্থিত ছিলেন- বিআরসিএস’র মহাসচিব ড. কবির এম. আশরাফ আলম, উপ-মহাসচিব সুলতান আহমেদ এবং ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব রেড ক্রস এন্ড রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটিজ’র হেড অব ডেলিগেশন আলবার্তো বোকানেগ্রা। সংবাদ সম্মেলনে উপমহাসচিব সুলতান আহমেদসহ বিভিন্ন কর্মকর্তার নিয়োগ বাণিজ্য, অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগের বিষয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাব না দিয়ে এড়িয়ে যান চেয়ারম্যান।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অফ রেড ক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটিজ (আইএফআরসি) এবং আন্তর্জাতিক রেড ক্রস কমিটির (আইসিআরসি) যৌথভাবে গত ২২ থেকে ৩১ অক্টোবর সুইজারল্যান্ডের জেনেভাতে আইএফআরসির সাধারণ পরিষদ ও কাউন্সিল অফ ডেলিগেটস’র বৈঠক এবং ৩৪তম আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে বিডিআরসিএস চেয়ারম্যান ও আইএফআরসি’র গভর্নিং বোর্ডের সদস্য মেজর জেনারেল (অব.) মো. রফিকুল ইসলাম, মহাসচিব ড. কবির এম. আশরাফ আলম, উপ-মহাসচিব সুলতান আহমেদ এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের পরিচালক আরিফা এম সিনহা অংশ নেন। এছাড়া জেনেভায় জাতিসংঘের কার্যালয় ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থায় বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি এবং সুইজারল্যান্ডে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত তারেক মো. আরিফুল ইসলামের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল কাউন্সিল অব ডেলিগেটস এবং আন্তর্জাতিক সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন।
আরো পড়ুন: নির্বাচন কমিশনকে জরুরি ৯ নির্দেশনা
লিখিত বক্তব্যে জানানো হয়, আর্থ-সামাজিক সংকট ও সম্পদের সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও সাত বছর ধরে বাংলাদেশ ১২ লাখের বেশি জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মায়ানমারের নাগরিকদের জন্য প্রয়োজনীয় মানবিক সহায়তা দিয়ে আসছে বলে বাংলাদেশের তরফ থেকে আন্তর্জাতিক সম্মেলনে জানানো হয়। মায়ানমারে বাস্তুচ্যুতদের নিরাপদ প্রত্যাবর্তন না হওয়া পর্যন্ত তাদের কষ্ট লাঘবে বিশ্বব্যাপী রেড ক্রস এবং রেড ক্রিসেন্ট কর্ণধার, উপস্থিত সব রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধি ও উন্নয়ন সহযোগীদের আর্থিক অনুদানসহ সব ধরণের সহায়তা অব্যাহত রাখতে অনুরোধ জানানো হয়। বৈঠকে জলবায়ু পরিবর্তন এবং দুর্যোগ মোকাবিলায় বাংলাদেশের ভূয়সী প্রশংসা করেন অংশগ্রহণকারীরা।
সম্মেলনে বিশ্বব্যাপী রেড ক্রস রেড ক্রিসেন্ট আন্দোলনের ১৯১টি সদস্য দেশের মধ্যে বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির প্রতিনিধিদল জাতীয় সোসাইটির প্রতিনিধিত্ব করে। এ বছর সম্মেলনে ৯টি প্রস্তাব গৃহীত হয় এবং মূল প্রস্তাব চূড়ান্ত করতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল। প্রস্তাবনায় প্রয়োজনীয় মানবিক সংকট মোকাবিলায় দৃঢ় প্রতিশ্রুতির উপর জোর দেয়া হয়। একইসঙ্গে দুর্যোগে সুরক্ষা ব্যবস্থা বাড়ানো, আগাম সতর্কতা, মানবিক সাড়াদান পদ্ধতি উন্নত করা এবং অভিবাসন কৌশল ২০২৪-২০৩০ গ্রহণ করা হয়।
এছাড়া পাঁচ দফা রেজুলেশন গৃহিত হয়েছে জেনেভা সম্মলনে। এগুলো হলো-
১. আন্তর্জাতিক মানবিক আইন (আইএইচএল) মেনে চলার সংস্কৃতি গড়ে তোলা: এর প্রয়োগ জোরদার করে মানুষের দুর্ভোগ কমানোর লক্ষ্যে আইএইচএল সমুন্নত রাখার জন্য রাষ্ট্রগুলোর অঙ্গীকার পুনর্নবীকরণ করা হয়েছে।
২. সশস্ত্র সংঘাতের সময় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির (আইসিটি) অপপ্রচার থেকে বেসামরিক নাগরিক এবং অন্যান্য ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীকে রক্ষা করা: এই নতুন গৃহীত রেজুলেশনটি একটি শক্তিশালী বার্তা প্রেরণ করে, যা আইসিটি নেতিবাচক কার্যক্রম থেকে বেসামরিক জনগণকে রক্ষা করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
৩. সুসংহত আইনি ও নিয়ন্ত্রক কাঠামোর মাধ্যমে দুর্যোগের ঝুঁকি মোকাবেলাকে আরো শক্তিশালী করে তোলা: এটি নিম্ন থেকে মধ্যম আয়ের দেশগুলির উপর বিশেষ দৃষ্টি নিবদ্ধ করে ক্রমবর্ধমান বিপজ্জনক বিশ্বের প্রেক্ষাপটে দুর্যোগ আইন ও নীতিগুলির চলমান বিশ্বব্যাপী শক্তিশালীকরণ নিশ্চিত করবে। নিম্ন থেকে মধ্যম আয়ের দেশগুলির উপর বিশেষ দৃষ্টি নিবদ্ধ করে এবং আইএফআরসির নতুন দুর্যোগ ঝুঁকি পরিচালনা নির্দেশিকা হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
৪. নীতিগত মানবিক কর্মকাণ্ডে স্থানীয় নেতৃত্ব, সক্ষমতা ও বিতরণ এবং স্থিতিস্থাপকতা জোরদার করা: এই রেজুলেশনটি সমর্থন বাড়ানোর লক্ষ্যে আন্দোলনের মধ্যে স্থানীয়করণের দিকে মনোনিবেশ করবে। দুর্যোগ ঝুঁকি কমানো, জলবায়ু অভিযোজন, মহামারী প্রস্তুতি এবং সংকট পুনরুদ্ধারে কাজ করবে।
৫. জলবায়ু ও আবহাওয়ার পরিবর্তনজনিত নেতিবাচক প্রভাব থেকে মানুষকে রক্ষা করা: জলবায়ু-সম্পর্কিত বিপর্যয় এবং মানবিক চ্যালেঞ্জগুলির উপর নেতিবাচক প্রভাবের আলোকে, এই রেজোলিউশনটি রাষ্ট্রীয় পক্ষগুলো এবং রেড ক্রস রেড ক্রিসেন্ট আন্দোলনের মধ্যে সহযোগিতার জন্য কাঠামো প্রদান করে।
আরো পড়ুন: ঢাকায় ৬-১২ কিমি বেগে বাতাস প্রবাহের পূর্বাভাস
ডেলিগেট কাউন্সিলে দুর্যোগের প্রস্তুতি এবং প্রতিক্রিয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জ, বিশেষ করে মাউন্টিং বিবেচনা করা জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকি এবং এক মিলিয়নের বেশি মায়ানমারের জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত জনসংখ্যার জন্য প্রয়োজনীয় সহায়তার বিষয়ে জোর দেন রফিকুল ইসলাম। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত জনসংখ্যাকে সাহায্য করার জন্য সম্মিলিত দায়িত্বের প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি তুলে ধরে এ বিষয়ে প্রাকৃতিক উপায়ে সমাধানের উপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করেন তিনি।
জেনেভা সম্মেলন ও বৈঠকের বাইরেও বিডিআরসিএস প্রতিনিধিদল আইএফআরসি’র সভাপতি কেট ফোর্বস, মহাসচিব জাগান চাপগাইন, আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল জেভিযার কাস্তেলানোস মস্কেরাসহ আমেরিকান রেড ক্রস’র প্রেসিডেন্ট এবং সেক্রেটারি জেনারেল, ব্রিটিশ, সুইডিশ, ড্যানিশ, কাতার এবং নরওয়েজিয়ান রেড ক্রস সোসাইটির প্রধানদের সঙ্গে বেশ কয়েকটি দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেন। এসব বৈঠকে আইএফআরসি এবং দাতারা দুর্যোগ প্রস্তুতি ও সাড়াদান এবং রোহিঙ্গাদের জন্য মানবিক কার্যক্রমে বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির উদ্যোগের প্রশংসা করেন। একইসঙ্গে বিডিআরসিএস’র মানবিক প্রচেষ্টার জন্য অর্থায়ন অব্যাহত রাখার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন।