আইএসের পতাকা নিয়ে মিছিল ঘিরে তোলপাড়, তৎপর পুলিশ

কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৮ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

আইএসের পতাকা নিয়ে মিছিল। ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় তথাকথিত আইএসের পতাকা নিয়ে মিছিলের ঘটনায় তোলপাড় শুরু হয়েছে। তদন্তে নেমেছে পুলিশ ও গোয়েন্দারা। স্কুল-কলেজ ও বেসরকারি ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা রাস্তায় এসব মিছিল করছে। মিছিল থেকে ফিলিস্তিনে গণহত্যা বন্ধ, ইসলামের নবী মুহাম্মদকে কটূক্তির প্রতিবাদ কিংবা ইসলামী খেলাফত কায়েমেরও দাবি তোলা হচ্ছে। বাংলাদেশে ইসলামী খেলাফত কায়েম করতেই তারা এই পতাকা নিয়ে মিছিল করছে বলে দাবি করছে।
রবিবার বিকালে ঢাকার অফিসার্স ক্লাবের সামনের রাস্তাসহ কয়েকটি এলাকায় বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কয়েকশ শিক্ষার্থী এমন পতাকা হাতে মিছিল করেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, যারা কালো পতাকা নিয়ে মিছিল করছে তারা নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন হিযবুত তাহ?রীরের সদস্য। রাজধানীতে কালো পতাকা নিয়ে মিছিলে যাদের অংশ নিতে দেখা গেছে তাদের বেশির ভাগই ঢাকার নামিদামি স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী। আর কিশোরগঞ্জের মিছিলে কারা কথিত আইএসের পতাকা ব্যবহার করেছে সেটি এখনো শনাক্ত করতে পারেনি পুলিশ। আইএসের পতাকা হাতে প্রকাশ্যে মিছিল ও তৎপরতার বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দিয়েছে।
সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক বলেছেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সূত্র ধরে ঐক্যবদ্ধভাবে রাষ্ট্র সংস্কারের যে কাজ শুরু হয়েছে সেটিতে বিভাজন সৃষ্টি করার চেষ্টা করছে একটি মহল। এই ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে ওই চক্রান্তকারী মহলের কেউ কেউ শিক্ষার্থীদের হাতে আইএস পতাকা প্রদর্শন করছে, বিভিন্ন বিতর্কিত স্লোগান দেয়াচ্ছে। বাস্তবতা হলো- যে শিক্ষার্থীদের দিয়ে এই কাজগুলো করানো হচ্ছে, এত অল্প বয়সে তাদের বোঝার কথা নয়; তারা কী মারাত্মকভাবে রাষ্ট্রীয় নীতির বিপক্ষে গিয়ে কাজগুলো করছে। এর থেকে পরিত্রাণ পেতে সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও অভিভাবকদের সচেতন হওয়ার বিকল্প নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সাইফুল আলম চৌধুরী বলেছেন, সাম্প্রতিক সময়ে মিছিলগুলোতে কালেমা তাইয়্যেবা ও আইএসের পতাকা প্রদর্শন করতে দেখা গেছে। দুইটা পতাকাই কালো রঙের। আগে বাংলাদেশে খুব কমই এই ধরনের পতাকার প্রদর্শন দেখা গেলও এখন হঠাৎ কেন এটি বেড়েছে সেটি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শাফি মো. মোস্তফা জানান, সাম্প্রতিক সময়ে এই পতাকা ব্যবহার করতে দেখি কথিত ইসলামিক স্টেট বা আইসিস গোষ্ঠীকে। সুতরাং বাংলাদেশে এখন এই ধরনের পতাকার ব্যবহার করলে এক ধরনের ট্যাগিংয়ের শিকার হওয়ার সম্ভাবনা থাকবেই।
এ প্রসঙ্গে পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মো. ময়নুল ইসলাম গতকাল সোমবার বলেছেন, তথাকথিত আইএসের পতাকা নিয়ে যারা ঝটিকা মিছিল করেছে এমন তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গণঅভ্যুত্থানের পর বিভিন্ন কারাগার থেকে অনেক জঙ্গি ও শীর্ষ সন্ত্রাসী পালিয়ে গেছে। কিছু নিষিদ্ধ সংগঠন মিছিল করেছে, সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেকেই দাবি করছে আইএসের পতাকা নিয়ে তারা মিছিল করছে। তিনি বলেন, এরই মধ্যে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন হিযবুত তাহরীরের মিডিয়া সমন্বয়ককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তথাকথিত পতাকা নিয়ে যারা ঝটিকা মিছিল করেছে এমন তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। যারা নিষিদ্ধ সংগঠন, তাদের বিরুদ্ধে পুলিশের তৎপরতা অব্যাহত আছে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার মাইনুল হাসান বলেন, হিযবুত তাহরীর নিষিদ্ধ ঘোষিত হওয়ার কারণে তারা প্রকাশ্যে মাঠে নামতে পারছে না বলেই অতর্কিতভাবে নামার চেষ্টা করছে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযান চলছে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান মো. মাসুদ করিম বলেন, আমরা এই বিষয়টি নিয়ে ক্লোজ মনিটরিং করছি। এর সঙ্গে কারা জড়িত থাকতে পারে সেটাও তদন্ত করছি। তিনি বলেন, যারা ধরা পড়ছে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। এমন অনেকে আছে যাদের আমরা ওয়াচে রেখেছি।
জানা গেছে, মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে ইসরায়েলি হামলার প্রতিবাদে শুক্রবার জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম থেকে একটি মিছিল বের করে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। ওই মিছিল থেকে তিনজনকে আটক করা হয়। রবিবার রাজধানীর কয়েকটি কয়েক জায়গায় স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের কালো পতাকা নিয়ে মিছিল করতে দেখা গেছে। ঢাকার জাতীয় সংসদ ভবনের সামনে এমন একটি মিছিল দেখা যায়। সেই মিছিল বের করে সেখানকার একটি স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থীরা। ‘সচেতন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা, সেন্ট জোসেফ হাইয়ার সেকেন্ডারি স্কুল’ ব্যানার নিয়ে এই মিছিলটিতে বিভিন্ন সেøাগান, প্ল্যাকার্ড ও কালেমা লেখা পতাকা ছিল। তাদের হাতে বাংলাদেশের পতাকা, ফিলিস্তিনের পতাকা এবং কালেমা লেখা পতাকাও ছিল। তারা যে ব্যানার নিয়ে মিছিল করছিল সেখানে লেখা ছিল ইসলামের নবীকে ভারতীয় পুরোহিত কর্তৃক কটূক্তি ও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের জবাবে তাদের প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ মিছিল। সেই মিছিলে তাদের সেøাগান দিতে শোনা যায়, ‘মুক্তির এক পথ, খিলাফত-খিলাফত’, ‘তুমি কে আমি কে, মুসলমান-মুসলমান’। একইদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় টিএসসি এলাকায় একই রকমভাবে একটি মিছিল দেখা যায়। যেই মিছিলে শিক্ষার্থীদের হাতে আইএসের পতকার আদলে কালো ও সাদা পতাকা দেখা যায়। গত সপ্তাহে ঢাকার নটর ডেম কলেজ, ঢাকা কলেজ, উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের শিক্ষার্থীদের রাজধানীতে আলাদা আলাদা মিছিল করতে দেখা যায়। যেখানে তাদের কারো কারো হাতে অভিন্ন কালো পতাকা দেখা যায়। কেউ কেউ আবার কালো কাপড়ে কালেমা লেখা পতাকা নিয়েও মিছিল করেন। গত শুক্রবার কিশোরগঞ্জের একটি মিছিলের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ইসলামের নবীকে কটূক্তির প্রতিবাদে তৌহিদি জনতার ব্যানারে কিশোরগঞ্জ শহীদি মসজিদ থেকে ওই মিছিলটি বের হয়েছিল। ফ্যাক্ট চেকার কদরুদ্দিন শিশির কিশোরগঞ্জের মিছিলের ওই ভিডিওর তথ্য যাচাইয়ের পর ফেসবুকে ভিডিও থেকে নেয়া একটি ছবি শেয়ার করে জানান, ওই দিন সেই মিছিলে কথিত ইসলামিক স্টেট বা আইসিসের পতাকা উড়ানো হয়েছে। শিশির বলেন, কিশোরগঞ্জের মিছিলে কালো কালেমার পতাকার বাইরেও একটি আলাদা পতাকা ব্যবহার হয়েছে যেটি সম্পূর্ণ আলাদা। এই পতাকা শুধু আইসিসই ব্যবহার করে থাকে। যেটির সঙ্গে জঙ্গিগোষ্ঠী আল কায়েদার পতাকারও মিল রয়েছে। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের দুই দিন পর গত ৭ আগস্ট সংসদের সামনে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন হিযবুত তাহ?রীর কর্মসূচি পালন করেছে। গত মঙ্গলবার মোহাম্মদপুর এলাকায় মিছিল করেছে তারা।
পুলিশ কর্মকর্তারা বলেছেন, ঢাকাসহ দেশে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা যে মিছিল করছে তা শুধু হিযবুত তাহ?রীরের নয়। এখানে একটা সালাফি গ্রুপও রয়েছে হয়তো। যারা খেলাফাতের কথা বলে, সরাসরি সামনে আসছে না। তারা এভাবে মিছিল করে কী অর্জন করতে চায় তা গোয়েন্দাদের খুঁজে বের করতে হবে। স্কুলের বাচ্চাদের হাতে পতাকা দিয়েছে পরে তারা মিছিলে নেমে গিয়ে স্লোগান দিয়েছে, বিষয়টি যত সহজ ভাবা হচ্ছে ঠিক ততটা সহজ নয়।
প্রসঙ্গত, ২০০৯ সালের ২২ অক্টোবর সরকার জঙ্গি ও সন্ত্রাসী সংগঠন উল্লেখ করে হিযবুত তাহরীর নিষিদ্ধ করে। এরপরও নানাভাবে তারা তৎপর ছিল। গত ৫ সেপ্টেম্বর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের আবেদন করেছে হিযবুত তাহ?রীর।