ড. ইউনূস-আনোয়ার ইব্রাহিম বৈঠক
ঢাকায় পুরনো বন্ধুত্ব ঝালাই

কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৫ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ছবি : সংগৃহীত
ড. ইউনূস ও আনোয়ার ইব্রাহিমের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক অনেক পুরনো। ঢাকায় মুখোমুখি বসার সুযোগে সেই সম্পর্ক ঝালাই করে নিলেন দুই নেতা। পরস্পরকে প্রতিশ্রুতি দিলেন দুদেশের মধ্যে ব্যবসা ও বিনিয়োগ বাড়িয়ে সম্পর্ক আরো সুদৃঢ় করার। এছাড়া অ্যাসোসিয়েশন অব সাউথইস্ট এশিয়ান নেশন্সের (আসিয়ান) সেক্টরাল ডায়ালগ পার্টনার হতে বাংলাদেশের জন্য মালয়েশিয়ার সমর্থন চাইলেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। গতকাল শুক্রবার রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পর মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমের সঙ্গে যৌথ প্রেস ব্রিফিংয়ে এই সহযোগিতা চান তিনি। ব্রিফিংয়ে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী সেদেশে যেতে না পারা বাংলাদেশি শ্রমিকদের সহযোগিতা করার ঘোষণা দেন।
এর আগে দুপুর ২টায় সংক্ষিপ্ত এক সফরে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এসে পৌঁছান মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম। এ সময় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস তাকে স্বাগত জানান। বিমানবন্দরে আনোয়ার ইব্রাহিমকে গার্ড অব অনার দেয়া হয়। এরপর বিমানবন্দরেই মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সংক্ষিপ্ত বৈঠক করেন প্রধান উপদেষ্টা। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে জানানো হয়, ‘পুরনো বন্ধু’ আনোয়ার ইব্রাহিমকে বাংলাদেশে স্বাগত জানাতে পেরে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস ‘খুবই আনন্দিত’। দুই নেতার একান্ত বৈঠকে ড. ইউনূস ছাত্রদের নেতৃত্বে অভ্যুত্থান সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত ধারণা দেন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীকে। অভ্যুত্থানে ছাত্র-নাগরিকের আত্মদান ও তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের ব্যাপক ‘হত্যাযজ্ঞের’ বর্ণনা দেন তিনি। সাক্ষাৎকালে মালয়েশিয়ার কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ও সেদেশের নেতাদের সঙ্গে দীর্ঘ যোগাযোগের বিষয়গুলো তুলে ধরেন প্রধান উপদেষ্টা। ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর ঢাকায় এটাই কোনো সরকারপ্রধানের প্রথম সফর।
বিমানবন্দরে সংক্ষিপ্ত বৈঠক শেষে দুই বন্ধু একই গাড়িতে ওঠেন। সেখান থেকে দুই নেতাকে আনুষ্ঠানিক মোটর শোভাযাত্রাসহ হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে ওয়ান-টু-ওয়ান বৈঠক করেন। দুই নেতা দ্বিপক্ষীয় পর্যায়ে আলোচনা করেন। সফরে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ৫৮ সদস্যের প্রতিনিধি দলে ছিলেন সেদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, বাণিজ্য ও বিনিয়োগমন্ত্রী, পরিবহন উপমন্ত্রী, ধর্মবিষয়ক উপমন্ত্রী, দুজন সংসদ সদস্য এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাসহ সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের প্রতিনিধি।
এদিকে যৌথ ব্রিফিংয়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস বলেন, আমরা ২০২৫ সালে আসিয়ানের আসন্ন সভাপতি পদে মালয়েশিয়াকে অভিনন্দন জানাই। আমরা আসিয়ানের সেক্টরাল ডায়ালগ পার্টনার হিসেবে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছি। আঞ্চলিক ফোরামে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তির জন্য মালয়েশিয়ার সক্রিয় ভূমিকার অপেক্ষায় রয়েছি। দুদেশের বিদ্যমান বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের কথা স্মরণ করে মালয়েশিয়াকে বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের বন্ধু উল্লেখ করে ড. ইউনূস বলেন, আনোয়ার ইব্রাহিমের সফর বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
দুই মাস আগে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর কোনো দেশের প্রধানমন্ত্রীর এটি হচ্ছে প্রথম বাংলাদেশ সফর। এই সফর বর্তমান সরকারের প্রতি মালয়েশিয়ার সমর্থনের স্বীকৃতি। দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় আমরা উভয়েই দীর্ঘদিনের দ্বিপক্ষীয় ইস্যুগুলোকে জোরদার করতে প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছি।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আলোচনায় বাংলাদেশের দ্বিতীয় বিপ্লব নজিরবিহীন গণআন্দোলন বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। শিক্ষার্থীরা তাদের স্বাধীনতা ও বৈষম্যমুক্ত নতুন বাংলাদেশ গড়তে তাদের জীবন বিসর্জন দিয়েছে। আমাদের সরকার একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও ন্যায়বিচারপূর্ণ বাংলাদেশ গড়তে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তিনি বলেন, জনগণের আশা-আকাক্সক্ষা পূরণে আমরা আমাদের ভ্রাতৃপ্রতিম দেশ মালয়েশিয়ার অবিচল সমর্থন ও সহযোগিতার প্রশংসা করি। অভিন্ন মূল্যবোধ, আস্থা ও জনগণের কল্যাণের স্বীকৃতির মাধ্যমে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক জোরদারের কথা উল্লেখ করে ইউনূস বলেন, আমরা সহযোগিতা, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ এবং সংস্কৃতির ক্ষেত্র নিয়ে আলোচনা করেছি। রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমারে নিরাপদ প্রত্যাবাসন করার বিষয় নিয়েও কথা বলেছি। ইস্যুটি সমাধানে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীকে এই ইস্যুটি আসিয়ান ফোরামে নিয়ে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেছি। এছাড়া পররাষ্ট্র উপদেষ্টা ও পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ে নিয়মিত দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করার বিষয়েও সম্মত হয়েছি।
এ সময় ঢাকায় অনুষ্ঠেয় চতুর্থ যৌথ কমিশনের বৈঠকের কথা উল্লেখ করে ড. ইউনূস দুদেশের মধ্যে একটি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরের ওপর জোর দেন। তিনি বলেন, কৃষি, জ্বালানি, যোগাযোগ, সুনীল অর্থনীতি, বিজ্ঞান, উদ্ভাবন ও প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে সহযোগিতার সম্ভাবনা অন্বেষণ এবং মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি শ্রমিকের সংখ্যা বাড়ানোর বিষয়েও আলোচনা করেছি।
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, আমরা আমাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে একটি নতুন উচ্চতায় উন্নীত করতে নিবিড়ভাবে কাজ করতে আমাদের দৃঢ় অঙ্গীকার ও সংকল্প ব্যক্ত করেছি।
এদিকে যৌথ ব্রিফিংয়ে সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেও নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজে যোগ দিতে না পারা প্রায় ১৮ হাজার বাংলাদেশিকে মালয়েশিয়ায় যাওয়ার সুযোগ করে দেয়ার ঘোষণা দেন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম। দুদেশের অর্থনীতিতে প্রবাসী বাংলাদেশিদের অবদানের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, যখন আপনারা আমাদের কাছে আহ্বান জানিয়েছেন, ৭ হাজার বা তার বেশিদের বিষয় বিবেচনার জন্য, যারা নিবন্ধন করেও রাজনৈতিক অবস্থা, এখানকার অভ্যুত্থানের কারণে যাওয়ার সুযোগ হারিয়েছে, আমি তাৎক্ষণিকভাবে সেটা বিবেচনা করেছি। এই সংখ্যা ১৮ হাজার হওয়ার কথা ড. ইউনূস মনে করিয়ে দিলে ইব্রাহিম বলেন, প্রথম ধাপে ৭ হাজার জনের যাওয়ার উদ্যোগ দ্রুত নেয়া হবে। সব সন্তোষজনক হলে বাকিদেরও ক্রমান্বয়ে নেয়া হবে।
চলতি বছর নতুন-পুরান বিদেশি কর্মীদের কাজে যোগ দিতে ৩১ মে পর্যন্ত সময় বেঁধে দেয় মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। বিমানের টিকেট স্বল্পতাসহ বিভিন্ন কারণে ওই সময়ের মধ্যে যেতে পারেননি প্রায় ১৮ হাজার বাংলাদেশি। বেঁধে দেয়া সময়ের মধ্যে যেতে না পারা এই কর্মীদের নিতে মালয়েশিয়া সরকারকে অনুরোধ জানিয়ে আসছিল বাংলাদেশ। সংক্ষিপ্ত সফরে ঢাকায় এসে সরকারের আহ্বানে সাড়া দেয়ার কথাই জানালেন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী। শ্রমিকদের ক্ষেত্রে বিভিন্ন নিয়ম কঠোরভাবে মেনে চলার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ওই ১৮ হাজার কর্মী সব ধরনের প্রক্রিয়া অবলম্বন করেছে। এটা যেতে না পারা তাদের দোষ নয়। সুতরাং প্রয়োজনীয় সমন্বয় ও পরিবর্তন করা আমাদের দায়িত্ব।
মালয়েশিয়ায় কর্মী নিয়োগে ‘সিন্ডিকেটের তৎপরতা’ নিয়ে করা এক প্রশ্নের জবাবে আনোয়ার ইব্রাহিম বলেন, এক্ষেত্রে অতীতের পদ্ধতি ভেঙে দিয়েছি আমরা। এখন ‘স্বচ্ছ’ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নিয়োগ হচ্ছে। কোম্পানিগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা আমাদের উদ্বেগের বিষয় নয়। আমাদের মাথাব্যথা হলো এটা নিশ্চিত করা- আমরা যে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, সেটা যেন ঠিকমতো মানা হয়। আমাদের শ্রমিক দরকার এবং তাদের প্রতি যেন ‘আধুনিক দাসের’ মতো আচরণ করা না হয়।
সব দেশের কর্মীদের ক্ষেত্রে একই নিয়ম থাকার কথা তুলে ধরে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী বলেন, তার মানে হচ্ছে, প্রক্রিয়াটা স্বচ্ছ হতে হবে এবং তথাকথিত ‘সিলেক্টেড’ লোকদেরও কঠোরভাবে নীতি মানতে হবে। শ্রমিকদের আবাসনের ব্যবস্থা ও কাজের ক্ষেত্রে কোনো ব্যত্যয় কেউ ঘটালে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথা তুলে ধরে ইব্রাহিম বলেন, আমরা তাদের বাদ দিয়ে দেয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছি এবং বাদও দিয়েছি। অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গেলে যে সমালোচনা হয়, সেটা ‘উচিত নয়’ বলেও মন্তব্য করেন তিনি। তিনি বলেন, অনুগ্রহ করে নিশ্চিত থাকুন যে, আমি নিজেও এই বাজে সিস্টেম ও নির্যাতনের সিস্টেমের ভুক্তভোগী। সুতরাং এটাকে চলতে দেয়ার কিংবা কোনোভাবে উপেক্ষা করার সরকার আমরা নই।
এরপর রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে বঙ্গভবনে যান মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী। ৫ ঘণ্টার বাংলাদেশে সংক্ষিপ্ত সফর শেষে সন্ধ্যায় কুয়ালালামপুরের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেন আনোয়ার ইব্রাহিম। বিমানবন্দরে তাকে বিদায় জানান প্রধান উপদেষ্টা। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানান, মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী সন্ধ্যা ৭টার দিকে ঢাকা ত্যাগ করেন।