×

জাতীয়

এক মাসেও নামেনি বন্যার পানি, দুর্ভোগে বাসিন্দারা

Icon

কাগজ ডেস্ক

প্রকাশ: ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৯:৩৫ এএম

এক মাসেও নামেনি বন্যার পানি, দুর্ভোগে বাসিন্দারা

জলাধারগুলোর ন্যাচারাল প্রবাহ বা আন্তঃসংযোগ নষ্ট হয়ে গেছে। ছবি : সংগৃহীত

   

সম্প্রতি দেশের পূর্বাঞ্চলের ১১টি জেলা বিশেষ করে ফেনী, কুমিল্লা, নোয়াখালীতে যে ভয়াবহ বন্যা দেখা দিয়েছিল, সেই পরিস্থিতির এখনো অবসান হয়নি। এসব অঞ্চলের খাল-বিল আর শাখা নদীগুলো তথা সব ধরনের জলাধারের বেশিরভাগই দখল হয়ে যাওয়ায় প্রায় মাস পেরিয়ে গেলেও পানি নামেনি পুরোপুরি। ১১ জেলাজুড়ে এখন ভেসে উঠেছে ক্ষতচিহ্ন; যা আছে তাই নিয়ে, সরকারি-বেসরকারি সহায়তা যতটুকু মিলছে, সেসবের ওপর ভর করে সেখানকার মানুষ ঘুরে দাঁড়াবার চেষ্টা করছে। তবে পানি পুরোপুরি মেনে গেলে হয়ত এতদিনে আরেকটু কর্মচাঞ্চল্য বাড়তো বানভাসা বিস্তৃর্ণ জনপদে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবান ও রিজিওনাল প্ল্যানিং বিভাগের অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, আগেও বন্যা ছিল। এটা আনকমন না, আনকমনটা হল- এবার বন্যার এতদিন পরেও পানি আটকে থাকাটা। এর মূল কারণ হচ্ছে, জলাধারগুলোর ন্যাচারাল প্রবাহ বা আন্তঃসংযোগ নষ্ট হয়ে গেছে।

বন্যা উপদ্রুত জেলার বাসিন্দারাও বলছেন, বন্যার পানি এত দিন আটকে থাকার জন্য খাল, শাখা নদী ও জলাধারগুলো ভরাট হওয়া এবং সেগুলোর আন্তঃসংযোগ বন্ধ হওয়ায়ই কারণ। এ জন্য ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও ধারণার চেয়ে বেশি।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ উপদেষ্টা ফারুক ই আজম বীর প্রতীক ক্ষয়ক্ষতির একটি হিসাব তুলে ধরে বলেন, সাম্প্রতিক বন্যায় ১১ জেলায় ১৪ হাজার ২৬৯ কোটি ৬৮ লাখ ৩৩ হাজার ৫২২ টাকা সমমূল্যের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বন্যায় ক্ষতির শিকার হওয়া মানুষের সংখ্যা ৯ লাখ ৪২ হাজার ৮২১ জন, যাদের মধ্যে মারা গেছেন ৭৪ জন, আহত হয়েছেন ৬৮ জন। ২,৩০৮ কোটি ৬ লাখ ২৯ হাজার ৭৪০ টাকার ফসল বন্যায় সম্পূর্ণভাবে এবং ৭১৮ কোটি ৫৭ লাখ ৫৬ হাজার ৬১০ টাকার ফসল আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ২৮ হাজার ৩৮৬টি ঘর সম্পূর্ণরূপে এবং ৩ লাখ ১৯ হাজার ২১৯টি ঘর আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে; ক্ষতির পরিমাণ যথাক্রমে ৪২৬ কোটি ১১ লাখ ২০ হাজার টাকা ও ১৯৮১ কোটি ১৯ লাখ ৪৮ হাজার ৫০০ টাকা।

এবারের বন্যায় ২ হাজার ২৩২ দশমিক ৯২ কিলোমিটার পাকা রাস্তা সম্পূর্ণভাবে এবং ৩ হাজার ৯৮৪ দশমিক ৩৪ কিলোমিটার আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে ক্ষতি হয়েছে যথাক্রমে ১ হাজার ৬৬৯ কোটি ৯০ লাখ ৬২ হাজার ১২৩ টাকা এবং ১ হাজার ৮৭৩ কোটি ৪৪ লাখ ১৬ হাজার ৭৫ টাকা।

আরো পড়ুন : কার্যকর পদক্ষেপ নিতে না পারলে ফের ভয়াবহ বন্যার মুখে পড়তে পারে দেশ

ক্ষয়ক্ষতি পুষিয়ে নিতে দ্রুত ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়াতে এখনো বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে আটকে পড়া বন্যার পানি। পানি নেমে যাওয়ার সব পথেই রয়েছে বাধা।

চলতি বছরের আগস্টের মাঝামাঝিতে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় ফেনীতে ২৯ জনের প্রাণহানি ঘটে। জেলা প্রশাসনের হিসাবে জনস্বাস্থ্য, অবকাঠামো, শিক্ষা, কৃষি, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ, বিদ্যুৎ, মোবাইল টাওয়ার, মসজিদ-মন্দিররসহ বিভিন্ন স্থাপনার নিরিখে বিপুল পরিমাণ অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে। ভয়াবহ বন্যায় এই বিপুল ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে, তার মূলে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলেছে ফেনীর ছয় উপজেলার অন্তত ২৪৪টি খাল ও শাখা নদীর দখল-দূষণ। এবারের বন্যায় দুর্ভোগে পড়েছে জেলার অন্তত ১৭ লাখ মানুষ।

শুধু এবারের বন্যাই নয়, প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে ভারী বর্ষণ ও ভারতীয় উজানের পানিতে সৃষ্ট বন্যায় মানুষজনের পাশাপাশি ক্ষতির শিকার হয় ঘর-বাড়ি, কৃষিজমি, পুকুর-খামার ও গবাদিপশু। পানি উন্নয়ন বোর্ড ও পৌর কর্তৃপক্ষ দফায় দফায় উদ্যোগ নিয়েও খাল ও শাখা নদীগুলোর অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করতে পারেনি, খালও সংস্কার করতে পারেনি বলে তথ্য দিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।

ফেনী সদরের দাউদপুর খাল ও পাগলিছড়া খালের পাশে প্রতিনিয়ত ময়লা-আবর্জনা ফেলে খাল দখল করা হয়েছে। আঁড়তের ময়লায় শুধু খালের পানি দূষণই হচ্ছে না, সেই সঙ্গে বন্ধ হচ্ছে পানি প্রবাহ।

দীর্ঘদিন পানিবন্দি ছিল দাগনভূঞার রাজাপুর ইউনিয়ন। এ ইউনিয়নের রাজাপুর বাজার-সংলগ্ন ‘দত্তের খাল’টি দীর্ঘদিন সংস্কার না হওয়ায় এবং আশপাশের ময়লা-আবর্জনা ফেলায় এবং দখল-দূষণের কারণে বর্তমানে অস্তিত্ব হারাতে বসেছে।

নোয়াখালীতে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা ও জলাবদ্ধতায় প্রায় এক মাস ধরে পানিবন্দি হয়ে ছিল অন্তত ১৩ লাখ মানুষ। নিরুপায় হয়ে অর্ধলক্ষ মানুষ বাড়িঘর ছেড়ে আশ্রয় নেয় বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। এক মাস হতে চললেও বাড়িঘর থেকে পানি না নামার কারণে আশ্রয়কেন্দ্রও ছাড়তে পারছেন না বন্যা কবলিত বিপুল সংখ্যক মানুষ।

এমন দুর্ভোগের জন্য স্থানীয় বাসিন্দারা খাল, নদী দখলকে দায়ী করছেন। নোয়াখালীর বিভিন্ন উপজেলায় যে খালগুলো দিয়ে বৃষ্টি অথবা বন্যার পানি মেঘনা নদীতে যায়, সেসব খালের বিভিন্ন জায়গা দিনের পর দিন দখল করে রেখেছে প্রভাবশালী চক্র। খালের ওপর এবং এর দুই পাশে নির্মাণ করা হয়েছে বিভিন্ন অবৈধ স্থাপনা। ফলে বন্যার পানি সরতে সময় লাগছে।

দেশের যে ১১টি জেলা সাম্প্রতিক ভয়াবহ বন্যার আঘাতে ধুকছে, সেগুলোর মধ্যে কুমিল্লাও রয়েছে। জেলার গোমতী নদীর বাঁধ বিভিন্ন পয়েন্টে ভেঙে জেলার ১৭টি উপজেলার মধ্যে ১৪টিতেই বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। কিন্তু অন্যাবারের মত পানি দ্রুত নামছে না। অন্যান্য উপজেলাগুলোর তুলনায় কুমিল্লার দক্ষিণাঞ্চলের তিন উপজেলা মনোহরগঞ্জ, লাকসাম ও নাঙ্গলকোটে বানের পানি সেভাবে নামছে না। এ তিন উজেলায় এখনো ৫ লাখের বেশি মানুষ পানিবন্দি।

ডাকাতিয়া নদী গড়ে ২২০ ফুট প্রস্থ থাকার কথা থাকলেও বর্তমানে এ অঞ্চলের অনেক স্থানে নদীর প্রস্থ ৩০ ফুটও খুঁজে পাওয়া যায় না। গ্রামীণ ছোট-বড় খালগুলোও অনেক প্রভাবশালীরা দখল ও ভরাট করেছেন। অনেক স্থানে খালের মধ্যে আড়াআড়ি বাঁধ দিয়ে রাস্তা করা হয়েছে। কোথাও আবার নদী ও বিভিন্ন খালে বাঁধ দিয়ে ভেসাল জালসহ বিভিন্নভাবে মাছ ধরছে এক শ্রেণির মানুষ। এতে পানি নামার পথ সংকুচিত হয়ে ধীরগতিতে সরছে বন্যার পানি।

শুধু রাজনৈতিক ব্যক্তি ও প্রভাবশালীরাই নন, বিগত সময়ে খাল ভরাট করে এই অঞ্চলের মানুষ ও কৃষির বারোটা বাজিয়েছে সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানও। ‘খাল কেটে’ নয় বরং ‘খাল ভরাট করে কুমির আনার মত সর্বনাশা’ কাজ করছে কুমিল্লা সড়ক ও জনপথ বিভাগ।

২০২০ সালের শুরু থেকেই কুমিল্লা-নোয়াখালী আঞ্চলিক মহাসড়ক চার লেন প্রকল্পে কোনো নিয়মের তোয়াক্কা না করে ভরাট করা হয়েছিল শত বছরের প্রাচীন ‘বেরুলা’ খালটি।বেরুলা খালটির দৈর্ঘ্য ছিল প্রায় ৬০ কিলোমিটার। ডাকাতিয়া নদীর কুমিল্লার লাকসামের দৌলতগঞ্জ বাজারের দক্ষিণাংশের ফতেপুর গ্রামে এর উৎসমুখ। লাকসাম, নাঙ্গলকোট ও মনোহরগঞ্জ হয়ে খালটি মিশেছে নোয়াখালীর চৌমুহনী খালে গিয়ে। এরপর সেখান থেকে এই পানি যেত বঙ্গোপসাগরে। কিন্তু ভরাটের ফলে এ অঞ্চল থেকে পানি নামতে তীব্র সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। খালটি ভরাট হয়ে যাওয়ায় কয়েক হাজার একর কৃষিজমি ও কৃষকেরও সর্বনাশ হয়েছে। সেই সঙ্গে বন্যার পানি সরতে পারছে না বলে অভিযোগ করেছে বানভাসি মানুষ।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সরদার উদয় রায়হান বলেন, পানি কমার এই হারকে ধীর থেকে মাঝারি বলা যায়। অন্যান্যবারের আকস্মিক বন্যার তুলনায় এবার পানি কমার হার ধীর।

কেন এতদিন পরেও পানি নামছে না- জানতে চাইলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবান ও রিজিওনাল প্ল্যানিং বিভাগের অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, বাংলাদেশ নদীবিধৌত এলাকা। এ দেশে আগেও বন্যা ছিল। এটা আনকমন না কিন্তু, যেটা আনকমন- এবার বন্যার এতদিন পরেও পানি আটকে থাকাটা। এর মূল কারণ হচ্ছে, জলাধারগুলোর ন্যাচারাল প্রবাহ বা আন্তসংযোগ নষ্ট হয়ে গেছে। এর কারণ ভরাট এবং দূষণ। যে ওয়াটার চ্যানেল আছে, পানি বের হওয়ার ক্ষেত্রে সেগুলোরও একই অবস্থা।

টাইমলাইন: ভারতের ঢলে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি

আরো পড়ুন

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সহজ ও গতিশীল করার সুপারিশ

আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সহজ ও গতিশীল করার সুপারিশ

আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি ছানোয়ারসহ ৩ নেতা রিমান্ডে

আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি ছানোয়ারসহ ৩ নেতা রিমান্ডে

অপারেশন ডেভিল হান্ট : সারাদেশে আরো ৫২৯ জন গ্রেপ্তার

অপারেশন ডেভিল হান্ট : সারাদেশে আরো ৫২৯ জন গ্রেপ্তার

হত্যা মামলায় মেনন, ইনু,ফারজানা ও শাকিল রিমান্ডে

হত্যা মামলায় মেনন, ইনু,ফারজানা ও শাকিল রিমান্ডে

সব খবর

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App