×

জাতীয়

সংস্কারের উদ্যোগ

দুদকের দাঁতে ফিরবে ধার!

Icon

এস এম মিজান

প্রকাশ: ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

দুদকের দাঁতে ফিরবে ধার!

ছবি: সংগৃহীত

   

দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) বলা হয় ‘দন্তহীন বাঘ’। প্রতিষ্ঠানটি স্বাধীন হলেও কতটুকু স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে, সে প্রশ্ন যেমন আছে; তেমনি দুদকের কর্মকর্তাদের সাহস ও সততা নিয়েও প্রশ্ন এবং সংশয় কম নেই। ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আবারো আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে দুদক। দুর্নীতি নির্মূলে ২০০৪ সালে দুর্নীতি দমন ব্যুারো থেকে স্বাধীন কমিশন গঠন করা হলেও বিগত দুই দশকে দুদক কি দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরতে পেরেছে? এ প্রশ্ন বর্তমানে সব জায়গায় ঘুরপাক খাচ্ছে। কমিশন গঠনের ২০ বছর পর প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির হিসাব কষলে জনপ্রত্যাশা পূরণে দুদক অনেকটাই ব্যর্থ হয়েছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। এ অবস্থায় জনপ্রত্যাশা পূরণে দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) আরো কার্যকর, শক্তিশালী ও যুগোপযোগী করতে আইনি স্বাধীনতা নিশ্চিতের পাশাপাশি সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানটিকে রাজনৈতিক প্রভাব মুক্ত রাখা জরুরি বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

গত ১১ সেপ্টেম্বর রাতে জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস রাষ্ট্র সংস্কারের তাগিদে কয়েকটি কমিশন গঠনের ঘোষণা দেন। তারই অংশ হিসেবে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামানকে দুদক সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে ঘোষণা দেন।

দুদক সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অভিমত, প্রতিটি সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহিষ্ণুতা দেখানোর ঘোষণা দিলেও সব সময় আইন নিজস্ব গতিতে চলেনি। নানা সীমাবদ্ধতার কারণে স্বাধীন এ সংস্থা দুর্নীতি দমন ও প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি, বরং দলীয় প্রভাবের বৃত্তেই ঘুরপাক খেয়েছে। যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে, সে দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে আনা মামলা বছরের পর বছর অনিষ্পন্ন থাকে। আর বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের নামে আনা মামলার বিচার দ্রুত হয়। এ কারণে দুর্নীতিবাজরা রাতারাতি ভোল পাল্টে ক্ষমতাসীনদের দলে ভিড়ে যায়। আবার আইনগত ত্রæটির কারণেও অনেক দুর্নীতিবাজ পার পেয়ে যান। এ কারণেই প্রতিষ্ঠানটির একজন সাবেক চেয়ারম্যান নিজেই দুদককে ‘দন্তহীন বাঘ’ বলে অভিহিত করেছিলেন। আবার দুদক সংশ্লিষ্ট এক মামলার শুনানিতে হাইকোর্ট দুদককে সতর্ক করে বলেছেন, দুদককে দুর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে দন্তহীন বাঘের মতো আচরণ বা দন্তহীন বাঘ হলে চলবে না। দুদককে দুর্নীতি নির্মূলে আরো তৎপর হতে হবে।

এ অবস্থায় জরুরিভিত্তিতে দুদককে ঢেলে সাজানোর জন্য বেশ কয়েকটি পরামর্শ এসেছে বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে। তারা বলছেন- কমিশন গঠনে বাছাই কমিটির স্বচ্ছতা, প্রয়োজনীয়সংখ্যক প্রসিকিউটরের সমন্বয়ে কমিশনের অধীনে নিজস্ব একটি স্থায়ী প্রসিকিউশন ইউনিট, কর্মকর্তাদের কাজের স্বাধীনতা নিশ্চিতে চাকরি বিধিমালা ও কমিশনের আইন ও বিধির বিতর্কিত ধারা সংশোধন, প্রেষণে আসা আমলাতন্ত্র প্রথা বন্ধ করা, দুদকে আসা অভিযোগ যাচাই-বাছাই কমিটিকে (যাবাক সেল) দুষ্টচক্র থেকে রক্ষা করা, বিদেশে পাচার করা সম্পদ ফিরিয়ে আনতে মানিলন্ডারিং ইউনিটকে শক্তিশালী করা, যুগোপযোগী ও আধুনিকায়ন করতে দুদককে পূর্ণাঙ্গ ডিজিটাল করা, কাজে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা আনতে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কার্যক্রম কঠোরভাবে মনিটরিংয়ের জন্য দুদকের অভ্যন্তরে পৃথক ইন্টেলিজেন্স সেল গঠন করা, দুদককে শক্তিশালী করতে ও আরো সক্ষমতা বাড়াতে ৬৮টি জেলা কার্যালয় স্থাপন সংক্রান্ত অর্গানোগ্রাম অনুমোদন ও কর্মকর্তাদের কাজে উৎসাহ দিতে নিয়মিত পদোন্নতি, পরিবহন সমস্যার সমাধানসহ প্রণোদনার ব্যবস্থা রাখাসহ দুদকের অন্যান্য সক্ষমতা বাড়ানো জরুরি। তারা বলছেন- সংস্থাটির প্রয়োজনীয় সংস্কারের এখনই উপযুক্ত সময়। যথাসময়ে এ সংস্কারকাজ করা না গেলে স্বাধীন এ সংস্থা কখনো জনগণের প্রত্যাশা পূরণে সক্ষম হবে না।

দুদক সংস্কারের বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির সাবেক মহাপরিচালক ও সাবেক জেলা জজ মো. মঈদুল ইসলাম বলেন, দুদকের গোড়াতেই গলদ রয়েছে। দেশকে দুর্নীতির রাহুগ্রাস থেকে বাঁচাতে হলে রাষ্ট্রীয় এ সংস্থার আমূল সংস্কারের এখনই সময়। দুদক সংস্কারের প্রথম কাজ হবে কমিশন পুনর্গঠন করা। দক্ষ, অভিজ্ঞ, বিচক্ষণ ও স্বচ্ছ মানুষ দিয়ে কমিশন পুনর্গঠন করা জরুরি। নেতৃত্ব এখানে বড় একটি বিষয়। আর গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, দুর্নীতির মামলায় বিচার দ্রুত সম্পন্নের ব্যবস্থা করা। দ্রুত বিচার করতে না পারলে ভালো ফলাফল অর্জন করা সম্ভব নয়। সেক্ষেত্রে নি¤œ থেকে আপিল আদালত পর্যন্ত শুধু দুদকের জন্য পৃথক আদালত গঠন এবং নিজস্ব প্রসিকিউশন ইউনিট চালু করতে হবে। বিষয়টি সময়সাপেক্ষ, তারপরও বাস্তবায়ন করা জরুরি।

দুর্নীতির বিস্তার ও সরকারি সেবার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে অন্তত ৬৪ জেলায় দুদকের অফিস স্থাপন করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, দুদক যদি সঠিকভাবে কাজ করে এবং সরকার যদি কাজ করার মতো যথেষ্ট পরিবেশ রাখে, তাহলে বড় বড় দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া

যাবে। এর সঙ্গে আদালত থেকে দ্রুত সাজা নিশ্চিত করতে হবে। কর্মকর্তাদের দক্ষতা বাড়ানোয় জোর দিয়ে দুদকের সাবেক এ মহাপরিচালক বলেন, কোয়ালিটি অনুসন্ধান ও তদন্ত করার ক্ষেত্রে অবশ্যই বিশেষভাবে দক্ষ জনবল প্রয়োজন। এখানে প্রেষণে আসা জনবল যদিও প্রয়োজন হয়, সেটা হতে পারে খাতভিত্তিক দক্ষ জনবল। কিন্তু দুদকে সবসময় দেখেছি, প্রশাসন ক্যাডারের আধিপত্য। এর মাধ্যমে দুদককে দুর্বল করে দেয়া হয়েছে, এটা বন্ধ করা উচিত। এর কোনো প্রয়োজনীয়তা আছে বলে মনে করছি না।

দুদক সংস্কার বিষয়ে সংস্থাটির সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান ভোরের কাগজকে বলেন, আমি এক সময় বলেছিলাম, দুর্নীতি দমন কমিশন হলো ‘দন্তহীন বাঘ’। এ দন্তহীন বাঘকে যদি আইন সংস্কার করে দন্তযুক্ত বাঘে পরিণত করা যায়, তাহলেই দুর্নীতির কিছুটা লাগাম টানা যাবে। তিনি বলেন, এর আগে ২০০৯ সালে দুদককে শক্তিশালী করতে আইন সংস্কার করার একটা উদ্যোগ ছিল। কিন্তু আমি চেয়ারম্যান থাকাকালীন চার বছরের মেয়াদে অনেক চেষ্টা করেও আমি আইনটির সংশোধন করতে পারিনি। আমার বিদায়ের পর পার্লামেন্টারি কমিটিতে আইনটি এমনভাবে সংশোধন করা হয়েছিল, দুদক শক্তিশালী হওয়ার বদলে উল্টো আইনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটিকে অকার্যকর করে দেয়া হয়। ২০০৯ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত দুদকের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে থাকা গোলাম রহমান বলেন, আমি মনে করি, দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কারের আগে দেশের সাংবিধানিক আইন, প্রচলিত ফৌজদারি আইন ও বিচার ব্যবস্থার সংস্কার প্রয়োজন। গোলাম রহমান বলেন, দুদককে শুধু আইনি সংস্কার করে খুব একটা শক্তিশালী করা যাবে, তা নয়। দুদককে শক্তিশালী করতে হলে মামলার দীর্ঘসূত্রিতা, দ্রুততার সঙ্গে মামলার নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করতে হবে। এ সংস্কারগুলো তো দুর্নীতি দমন কমিশনের মধ্যে হবে না, এটার জন্য দেশের আইন-কানুন, রীতিনীতি এবং পদ্ধতির সংস্কার করতে হবে। তিনি মনে করেন, দুর্নীতির মামলা দ্রুত সময়ে নিষ্পত্তি করার ব্যবস্থা নেয়া গেলে এক্ষেত্রে ফল পাওয়া যাবে। তা হলে দুর্নীতির লাগাম টানা যাবে, কিন্তু মামলা নিষ্পত্তি বর্তমানে ১০-২০ বছরেও শেষ হয় না।

এ বিষয়ে দুদক সংস্কার কমিশনের প্রধান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান ভোরের কাগজকে বলেন, দুদককে ঢেলে সাজানোর এখনই উপযুক্ত সময়। জন্মলগ্ন থেকে সরকারদলীয় লোকদের সংস্থাটির চেয়ারম্যান ও দুই কমিশনার হিসেবে বসানো হয়েছে। ফলে দুদক সরকারের উচ্চ পর্যায়ে হাত দেয়নি। কমিশনে এমন লোকদের বসাতে হবে, যারা দলীয় প্রভাবমুক্ত, পেশাগত দক্ষতা ও যোগ্যতার জন্য সুপরিচিত ও প্রতিষ্ঠিত; যারা সরকারের উচ্চ পর্যায়ের লোকদের দুর্নীতিতে হাত দেয়ার সাহস রাখেন। তিনি বলেন, দুদক এখনো আমলাতন্ত্রের কাছে জিম্মি। আমলাতন্ত্রের প্রভাব থেকে দুদককে মুক্ত করতে হবে। আইনের সংস্কারের পাশাপাশি দুদকের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের উপযুক্ত সাজা নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া দুদকের অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা চিহ্নিত করে এর সমাধান করতে হবে। নয়তো স্বাধীন এ সংস্থা কখনোই জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারবে না।

টাইমলাইন: অন্তর্বর্তীকালীন সরকার

আরো পড়ুন

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সহজ ও গতিশীল করার সুপারিশ

আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সহজ ও গতিশীল করার সুপারিশ

আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি ছানোয়ারসহ ৩ নেতা রিমান্ডে

আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি ছানোয়ারসহ ৩ নেতা রিমান্ডে

অপারেশন ডেভিল হান্ট : সারাদেশে আরো ৫২৯ জন গ্রেপ্তার

অপারেশন ডেভিল হান্ট : সারাদেশে আরো ৫২৯ জন গ্রেপ্তার

হত্যা মামলায় মেনন, ইনু,ফারজানা ও শাকিল রিমান্ডে

হত্যা মামলায় মেনন, ইনু,ফারজানা ও শাকিল রিমান্ডে

সব খবর

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App