মামলা ও গ্রেপ্তার আতঙ্কে কর্মস্থলে নেই ৮০০ পুলিশ সদস্য

কামরুজ্জামান খান
প্রকাশ: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ছবি: সংগৃহীত
৫ আগস্টের পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটের পর এখনো কাজে যোগ দেয়নি অনেক পুলিশ সদস্য। এর মধ্যে বিভিন্ন মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছেন বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা ও সদস্য। ১৫ আগস্টের মধ্যে সব পুলিশ সদস্যকে কর্মস্থলে যোগদানের নির্দেশ দেয়া হলেও এখনো ৮ শতাধিক সদস্য কাজে যোগ দেননি। এদের মধ্যে পদস্থ কর্মকর্তা থেকে অধিনস্ত সদস্য পর্যন্ত রয়েছেন। তাদের অনেকের বিরুদ্ধে থানা ও আদালতে হত্যাসহ বিভিন্ন অভিযোগে মামলা দায়ের হয়েছে। কয়েকজন কর্মকর্তাসহ পুলিশ সদস্য এর মধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছেন। মূলত গ্রেপ্তার আতঙ্কে পুলিশের এই সদস্যরা কাজে যোগ না দেয়ায় কর্মস্থলে অনুপস্থিত সদস্যদের তালিকা তৈরির কাজ করছে পুলিশ সদর দপ্তর। তালিকা চূড়ান্ত হওয়ার পর তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হবে বলে জানা গেছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার মো. মাইনুল হাসান বলেছেন, পুলিশের মনোবল ফেরানোর কাজ চলছে। অনেকেই স্বাভাবিক কাজ শুরু করেছেন। ডিএমপির ৪৫ জন সদস্য এখনো কাজে যোগ দেয়নি। তাদের মধ্যে অনেকে চাকরি ছেড়ে দেয়ার কথা জানিয়েছে। আবার অনেকে বিদেশে চলে যাওয়ার কথাও বলেছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
পুলিশ সদর দপ্তরের সূত্র বলেছে, সারাদেশে ৬৬৪টি থানার মধ্যে ৪৫০টির বেশি থানায় হামলা হয়েছে। দুর্বৃত্তরা কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। থানা থেকে লুট হয়েছে পাঁচ হাজার ৮২৯টি আগ্নেয়াস্ত্র ও ছয় লাখ ছয় হাজার ৭৪২ রাউন্ড গুলি। এর মধ্যে তিন হাজার ৭৬৩টি বন্দুক ও দুই লাখ ৮৬ হাজার ৮২ রাউন্ড গুলি উদ্ধার হয়েছে। বাকিগুলো এখনো পাওয়া যায়নি। এর মধ্যে ৪ সেপ্টেম্বর থেকে অস্ত্র উদ্ধারে শুরু হওয়া যৌথ বাহিনীর অভিযানে শুক্রবার রাত পর্যন্ত উদ্ধার হওয়া ১৪৪টি আগ্নেয়াস্ত্রের মধ্যে ৮টি রিভলবার, ৪১টি পিস্তল, ১১টি রাইফেল, ১৭টি শটগান, ৫টি পাইপগান, ১৯টি শুটারগান, ১০টি এলজি, ২২টি বন্দুক, ১টি একে ৪৭, ১টি গ্যাসগান, ১টি চাইনিজ রাইফেল, ১টি এয়ারগান, ৩টি এসবিবিএল, ৩টি এসএমজি ও ১টি টিয়ার গ্যাস লঞ্চার রয়েছে।
এদিকে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন পর্যায়ে কাজ করতেন এমন ৯৯ জন পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে ২৮২টি মামলা হয়েছে। আসামিদের মধ্যে পুলিশের সাবেক তিন মহাপরিদর্শকও রয়েছেন। কনস্টেবল থেকে শুরু করে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেও অভিযোগ আনা হয়েছে। আসামিদের মধ্যে আটজন অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক, সাতজন উপমহাপরিদর্শক, ১২ জন পুলিশ সুপার, ১৪ জন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, ছয়জন সহকারী পুলিশ সুপার, ১২ জন ওসি, আটজন পরিদর্শক, ১০ জন উপপরিদর্শক ও একজন সহকারী উপপরিদর্শক রয়েছেন। ঢাকার বাইরে রংপুর, সাভার, আশুলিয়াসহ একাধিক থানা এলাকায় পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে মামলা রুজু হয়েছে। যার বেশির ভাগ মামলাই ছিল হত্যা কিংবা বিস্ফোরক দ্রব্য আইন ও অস্ত্র আইনে করা হয়েছে। এ অবস্থায় ছুটি ছাড়া এখনো কর্মস্থলে অনুপস্থিত রয়েছেন ৭০০-৮০০ পুলিশ কর্মকর্তা। তাদের মধ্যে কিছু ক্যাডার কর্মকর্তা রয়েছেন। অবশ্য সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি মনিরুল ইসলাম, মোহাম্মদ আলী, খন্দকার লুৎফুল কবীর, আতিকুল ইসলাম, কৃষ্ণ পদ রায়, হাবিবুর রহমান, আ খ ম মহিদ উদ্দিন, এ কে এম হাফিজ আক্তার, আনোয়ার হোসেন, ডিআইজি মোজ্জাম্মেল হক, মনিরুজ্জামান, আসাদুজ্জামান, ইমাম হোসেন, অতিরিক্ত ডিআইজি মীর রেজাউল আলম, চৌধুরী মঞ্জুরুল কবির, রকিবুল ইসলাম, গাজী মোজাম্মেল হকসহ বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোয় তাদের কাজে যোগ দেয়ার সুযোগ নেই।
প্রাপ্ত তথ্য মতে, ঢাকা মহানগর পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত উপকমিশনার মো. হারুন অর রশীদের নামে ৩৮টি, সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের নামে ৩৬টি, ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমানের নামে ৩৩টি ও ডিএমপির সাবেক যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকারের নামে এ পর্যন্ত ২৭টি মামলা হয়েছে। এছাড়া, সারাদেশে বিভিন্ন পর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ডজনখানেক মামলা দায়ের হয়েছে। এ পর্যন্ত ১৭ জন উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক ও এবং ঢাকার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আব্দুল্লাহিল কাফী গ্রেপ্তার হয়েছেন। চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন আত্মসমর্পণ করেছেন। বিপ্লব কুমার সরকার লালমনিরহাট সীমান্ত দিয়ে পালিয়েছেন এমন গুঞ্জন রয়েছে। অতিরিক্ত ডিআইজি মারুফ হোসেন সরদার, প্রলয় কুমার জোয়ার্দার, রাশিদুল হক, মশিউর রহমান, শাহেদুল ইসলাম, ঢাকার ওয়ারীর সাবেক ডিসি ইকবাল হোসাইন, ডিবির সাবেক ডিসি রাজীব আল মাসুদ, মাহফুজুল আল রাসেল, হায়াতুল ইসলাম, আশরাফুল আজিম, হাফিজ আল ফারুক, এইচ এম আজিমুল হক, মাহাবুব উজ জামান, জাফর হোসেন, আব্দুল্লাহ হিল কাফি, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার নূরুল আমীন, গোবিন্দ চন্দ, শাহীন শাহ মাহফুজ, হাফিজ আল আসাদ, আসাদুজ্জামান, মোহিদ কবির সেরনিয়াবাদ, জুয়েল রানা, হাসান আরাফাত, নাজমুল ইসলাম, সাব্বির রহমান, আফজাল হোসেন টুটুল, ফজলে এলাহী, রওশানুল হক সৈকত, শাকিল মো. শামীম, এএসপি রিফাতুল ইসলাম রিফাত, শাহীনুর রহমান, শহিদুল হক, মিজানুর রহমান, তানজীল আহমেদ, গোলাম রুহানি, ইন্সপেক্টর আমিনুল ইসলাম, শাহীনুর রহমান শাহীন, খন্দকার হেলাল উদ্দিন, মাহাবুব রহমান, ফরমান আলী, মাহফুজুল হক ভূঁইয়া, শিকদার মো. শামীম হোসেন, সেলিমুজ্জামান, মাজহারুল ইসলাম, প্রলয় কুমার সাহা, আতিকুর রহমান, মশিউর রহমান, নাজমুল হাসান, রনেজিৎ রায়, মেহেদী হাসান, জাকির হোসেন, আতিকুল হক, রবিউল ইসলাম, তোফাজ্জল হোসেন, আবুল বাশার, শাহাবুদ্দিন হাওলাদার, এসআই শাহারিয়ার আলম, কনস্টেবল মাহাবুব আলম, আব্দুর রশিদ, রমজান মোল্যাসহ অনেক পুলিশ সদস্যের নামে মামলা রুজু হয়েছে। তারা নতুন কর্মস্থলে যোগ দেননি। সহিংসতার সময় আহত পুলিশ সদস্যদের মধ্যে যারা এখনো স্ব স্ব ইউনিটে যোগ দিতে পারেননি তাদের ব্যাপারে সদর দপ্তর অবগত।
আরো পড়ুন: বিএনপিকে বাদ দিয়ে রাজনীতি করা এত সহজ হবে না
জানা গেছে, পুলিশের সংখ্যা প্রায় দুই লাখ ১৩ হাজার। ৫ আগস্টের পর পুলিশের মধ্যে নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি হয়। তারা নিরাপত্তা নিশ্চিত, সংস্কারসহ বিভিন্ন দাবিতে কর্মবিরতি শুরু করে। ৮ আগস্ট সন্ধ্যার মধ্যে সব ইউনিটের সদস্যকে কাজে যোগদান করতে নির্দেশ দেন আইজিপি মো. ময়নুল ইসলাম। এতে সাড়া না মেলায় ১১ আগস্ট কর্মবিরতিতে থাকা পুলিশ সদস্যদের কাজে যোগ দেয়ার আহ্বান জানিয়ে তৎকালীন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বিগ্রেডিয়ার (অব.) সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ১৫ আগস্টের মধ্যে পুলিশ সদস্যদের নিজ নিজ কর্মস্থলে যোগ দিতে হবে। যারা নির্ধারিত সময়ে যোগ দেবে না তাদের চাকরি থাকবে না। তার এই হুঁশিয়ারির পর অধিকাংশ পুলিশ কাজে ফিরলেও ফিরেননি অনেকে।