আর্থিক খাতে পুকুরচুরির ইতিবৃত্ত
ব্যাংক ধ্বংসের কারিগর নজরুল

মরিয়ম সেঁজুতি
প্রকাশ: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

নজরুল ইসলাম মজুমদার
নজরুল ইসলাম মজুমদার। ব্যাংকিং খাতের সবাই যাকে এক নামে চেনে। তিনি বেসরকারি ব্যাংক মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) সভাপতি। এর বাইরে নাসা শিল্প গ্রুপের কর্ণধার এবং এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যানও। গত দেড় দশকে সালমান এফ রহমানের পাশাপাশি ব্যাংকিং খাতে ব্যাপক প্রভাবশালী ছিলেন এই ব্যক্তি। আওয়ামী লীগ সরকারের প্রায় পুরো মেয়াদেই তিনি বিএবির চেয়ারম্যান ছিলেন। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে তার ছিল ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। প্রধানমন্ত্রীর বিভিন সহায়তা তহবিল এবং সরকারের নানা আয়োজনে ব্যাংক থেকে অর্থ সংগ্রহ করতেন তিনি। সেই সুযোগে ব্যাংক ব্যবস্থাকে নিজের মতো ব্যবহার করেছেন। তার বিরুদ্ধে বন্ড সুবিধার অপব্যবহার ও আমদানি-রপ্তানির আড়ালে অর্থ পাচারের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। ক্ষমতার দাপটে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে সীমার অতিরিক্ত শত শত কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন এই মজুমদার। সরকারি-বেসরকারি অন্তত ১৩টি ব্যাংকে নাসা গ্রুপ ও এর অঙ্গ প্রতিষ্ঠানের ঋণ আছে। এর মধ্যে আটটি ব্যাংক থেকে সীমার অতিরিক্ত ঋণ নেয়া হয়েছে। সেখান থেকে শত শত কোটি টাকা নগদে উত্তোলন করেছেন। যুক্তরাজ্যসহ কয়েকটি দেশে কমপক্ষে ২১০ কোটি টাকা পাচারের অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এসব কাজে নিজের মালিকানাধীন এক্সিম ব্যাংককে ব্যবহার করেছেন।
নজরুল ইসলাম মজুমদারের বিরুদ্ধে অর্থ পাচার, ঋণ অনিয়মসহ নানা অভিযোগ তদন্ত করছে গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশ ফিনান্সিয়াল ইনটেলিজেন্স ইউনিট- বিএফআইইউ। এরই মধ্যে নজরুল ইসলাম ও তার পরিবারের সদস্যদের ব্যাংক হিসাব তলব করা হয়েছে। এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যানের পদ থেকেও তাকে সরিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। পুনর্গঠন করা হয়েছে এক্সিম ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ। একই সঙ্গে নজরুল ইসলাম ও প্রতিষ্ঠানের অবৈধ সম্পদ অর্জন এবং কর ফাঁকি নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেল (সিআইসি)। আয়কর আইন, ২০২৩ ও মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২-এর অধীনে কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে না দেয়া কর উদ্ধারের পাশাপাশি অভিযুক্তের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে।
সরকার পরিবর্তনের পর বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে যোগ দিয়ে আহসান এইচ মনসুর সাংবাদিকদের বলেছিলেন, যারা ব্যাংকের টাকা নিয়ে ফেরত দেননি, তাদের ছাড় দেয়া হবে না। টাকা উদ্ধারে আইনগত যত পন্থা আছে, সবই অনুসরণ করা হবে। দুর্বল ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেয়া হবে। নতুন গভর্নর হিসেবে আহসান এইচ মনসুর যোগ দেয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত সাতটি ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে পুনর্গঠন করা হয়েছে।
জানা গেছে, ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ লুট হলেও তা আড়াল করতে ভূমিকা রেখেছেন সালমান এফ রহমান ও নজরুল ইসলাম মজুমদার। তাদের ভূমিকার কারণেই বিভিন্ন কেলেঙ্কারিতে জড়িত ব্যাংক মালিক, ব্যাংকার ও ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর না হয়েও উল্টো বিভিন্ন সময়ে সিআরআর কমানো, এক পরিবার থেকে চার পরিচালক নিয়োগ, সহজ শর্তে ঋণ পুনঃতফসিল করাসহ নানা সুবিধা দিয়েছে সরকার। নজরুল ইসলাম মজুমদারের ভিন্ন এক পরিচয়ও উঠে এসেছে। ক্ষমতার বিশেষ প্রভাববলয় ব্যবহার করে জমি দখলেরও অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। যদিও প্রভাবশালী এই ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যাকিং খাতসহ প্রশাসনের অনেকেই মুখ খুলতে ভয় পেতেন। জাদুর কাঠির ছোঁয়ায় নানা কৌশলে বিশেষ ক্ষমতার অধিকারি হন তিনি।
তথ্য সূত্রে জানা গেছে, বৈধ-অবৈধ নানা উপায়ে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী নজরুল ইসলাম মজুমদার। আয়কর নথিতেই তার সম্পদের পরিমাণ ১১২৭ কোটি টাকা। চাঁদাবাজি, কর ফাঁকি, অর্থ পাচারসহ নানা অপরাধে নাম জড়িয়েছে গার্মেন্টস খাতের এই উদ্যোক্তার। অর্থ পাচারের অভিযোগ তার মেয়ের বিরুদ্ধেও রয়েছে। আয়কর নথিতে ৫৩২ কোটি টাকার অকৃষি সম্পদ, ব্যাংকে এফডিআর ৪৪০ কোটি টাকা, বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ারের দাম ৯৮ কোটি, ব্যবসার মূলধন ২৬ কোটি, নগদ ৩০ কোটি টাকা দেখান নজরুল ইসলাম। বিপরীতে ব্যক্তিগত ঋণ ৩শ কোটি টাকা। হাজার কোটি টাকার এই মালিক গত অর্থবছরে কর পরিশোধ করেন মাত্র সাড়ে ১১ কোটি টাকা।
প্রায় ১৫ বছর ধরে ব্যাংক মালিকদের সংগঠন বিএবির চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার। প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলের জন্য চাঁদা তোলা, মালিকদের হয়ে সরকারের প্রতি আনুগত্য, হোটেলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈঠক ডাকা- এমন নানা কারণে সমালোচিত তিনি। অভিযোগ আছে, প্রভাব খাটিয়ে ব্যাংকগুলোতে নিয়মিত চাঁদাবাজি করতেন তিনি। বিশেষ করে সিএসআরের অর্থে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে অনুদান দিতে বাধ্য করতেন। মুজিব শতবর্ষে খেলাধুলাসহ নানা আয়োজনে ব্যাংকগুলোকে চাঁদা দিতে বাধ্য করেন নজরুল ইসলাম। আওয়ামী লীগ সরকার পতনে আত্মগোপনে আছেন নজরুল ইসলাম মজুমদার। ফলে এ বিষয়ে তার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলে তার নাম্বারটি বন্ধ পাওয়া গিয়েছে।
গার্মেন্টস ব্যবসার আড়ালে নজরুল ইসলামের বিরুদ্ধে শুল্ক ফাঁকি দেয়ার অভিযোগ পুরনো। তবে রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে তার বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেয়নি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। অভিযোগ আছে, শুল্কমুক্ত সুবিধায় কাঁচামাল এনে খোলাবাজারে বিক্রি, আমদানি-রপ্তানিতে মূল্য কখনো কম; কখনো বেশি দেখিয়ে অর্থ পাচার করেছেন তিনি। ২০২০ সালেও তার এ জালিয়াতি বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচার হয়। তবে তার প্রভাবে আবার ঢাকা পড়ে যায়। সেই সময়ের এক তদন্ত প্রতিবেদনে দেখা গেছে, অন্যান্য ব্যাংকের মতো শরিয়াহভিত্তিক একটি বড় বেসরকারি ব্যাংকেরও গ্রাহক নাসা গ্রুপ। কিন্তু ব্যাংকের একটি শাখায় গ্রুপের বৈদেশিক বাণিজ্য সংশ্লিষ্ট অর্থায়নে নানা অনিয়ম পরিলক্ষিত হয়েছে। গ্রুপটি নানাভাবে প্রভাব খাটিয়ে এ ধরনের অনিয়ম করেছে। শরীয়াাহভিত্তিক ওই ব্যাংকের প্রতিবেদনের শিরোনামে বলা হয়েছে, ‘প্রতারণার মাধ্যমে ফান্ড ডাইভারশনের বিশ্লেষণ।’ এরপর প্রতিবেদনের শুরুতে বলা হয়, ‘শাখার গ্রাহক নাসা গ্রুপের বৈদেশিক বাণিজ্য সংশ্লিষ্ট অর্থায়নে অনিয়ম পরিলক্ষিত হয়েছে। গ্রাহকের বিগত ৪ বছরের আমদানি ও রপ্তানি এবং ঋণসীমা ও ঋণ বিতরণের তুলনামূলক আলোচনায় দেখা যায়, প্রায় প্রতি বছরই গ্রাহকের (নাসা গ্রুপ) ঋণ সীমার অতিরিক্ত বিতরণ করা হয়েছে এবং আমদানির তুলনায় রপ্তানি কম করা হয়েছে।’ ব্যাংকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা নাসা গ্রুপের টেক্সটাইল ইউনিটের ঋণ পারফরম্যান্স সংক্রান্ত তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৫ সালে গ্রুপের ঋণসীমা ছিল ১৪৫ কোটি টাকা। কিন্তু নানাভাবে প্রভাব খাটিয়ে ঋণ নিয়েছে ৩৫৪ কোটি টাকা। এতে সীমার চেয়ে ২০৯ কোটি টাকা বেশি নিয়েছে। একই বছর ওই ব্যাংকের মাধ্যমে ১৭৫ কোটি টাকার পণ্য আমদানি করেছে গ্রুপটি। কিন্তু রপ্তানি করে মাত্র ১৫৩ কোটি টাকার। অর্থাৎ আমদানির তুলনায় রপ্তানি ২১ কোটি টাকা কম।
২০১৬ সালে গ্রুপের ঋণসীমা ছিল ১৫০ কোটি টাকা। কিন্তু গ্রুপটি ঋণ নিয়েছে ১৭৯ কোটি টাকা। এতে সীমার চেয়ে ২৯ কোটি টাকা বেশি নিয়েছে। একই বছর ওই ব্যাংকের মাধ্যমে ১৬১ কোটি টাকার পণ্য আমদানির বিপরীতে রপ্তানি করেছে ১৮৯ কোটি টাকার। এই বছরে তারা আমদানির চেয়ে রপ্তানি কিছুটা বেশি করে। ২০১৭ সালে ওই ব্যাংকের মাধ্যমে ২৪১ কোটি টাকার পণ্য আমদানির বিপরীতে রপ্তানি করেছে মাত্র ১৯৩ কোটি টাকার পণ্য। আমদানির তুলনায় রপ্তানি কম করেছে ৪৭ কোটি টাকা। ২০১৮ সালেও আমদানির তুলনায় রপ্তানি কম হয়েছে ৩৭ কোটি টাকার।
উল্লিখিত চার বছরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, শুধু খাতাকলমেই আমদানির বিপরীতে ১০৫ কোটি টাকা কম রফতানি করেছে। যেখানে অর্থনীতির নিয়মানুযায়ী রপ্তানি আয় আমদানির থেকে বেশি হওয়ার কথা। ফলে এখানে আমদানি-রপ্তানির আড়ালে অর্থ পাচারের সুস্পষ্ট আলামত বহন করে। এ বিষয়ে একটি বেসরকারি ব্যাংকের একজন এমডি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ব্যাংক সেক্টরের প্রভাবশালীরা যেভাবে ব্যাংক লুটপাট করছেন তার কাছে এ চিত্র খুবই সামান্য। তিনি বলেন, নজরুল ইসলাম মজুমদারসহ এ সারির অনেকে বিদেশে কোথায় কী পরিমাণ সম্পদ করেছেন, সেটি তদন্ত হওয়া সময়ের দাবি। এটি একমাত্র এই সরকারের পক্ষেই সম্ভব।
যুক্তরাজ্যের সরকারি ওয়েবসাইটে নজরুল ইসলাম ও তার মেয়ের অর্থ পাচারের তথ্য পাওয়া যায়। লন্ডনে অন্তত চার কোম্পানিতে আনিকার মালিকানার প্রমাণ মেলে। এগুলো হলো- নাসা প্রপারটিস লিমিটেড, এএনডব্লিউ প্রপারটিস লন্ডন লিমিটেড, এএনডব্লিউ অ্যাসোসিয়েটিস লন্ডন লিমিটেড এবং এক্সিম এক্সচেঞ্জ কোম্পানি লিমিটেড। সবগুলো কোম্পানি লন্ডনে নিবন্ধিত। এসব কোম্পানি আর্থিক ও আবাসন খাতের ব্যবসায় জড়িত। এএনডব্লিউ নামের কোম্পানিটিতে মেয়ের সঙ্গে পরিচালক ছিলেন নজরুল ইসলাম। সমালোচনার মুখে গত বছর তিনি পদত্যাগ করেন। নজরুল ইসলাম মজুমদারের মেয়ে আনিকা ইসলামের বয়স ২৫ বছর। জাতীয়তা ব্রিটিশ। কোম্পানি নিবন্ধনে ব্যবহার করেছেন এসেক্সের ঠিকানা। তার নামে লন্ডনের বিলাসবহুল এলাকা কেনসিংটনে একাধিক বাড়ির খবর গণমাধ্যমে আসে গত বছর। যার মূল্য আড়াইশ কোটি টাকার বেশি। সৌদি আরবেও নজরুল ইসলামের বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের অভিযোগ আছে।
অবৈধ সম্পদ গোপন ও কর ফাঁকি দিতে পদে পদে জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছেন আলোচিত এ ব্যবসায়ী। ভুয়া দলিল তৈরি করে মাছের খামার থেকে দুইশ ১৫ কোটি টাকা আয় দেখিয়েছেন এক্সিম ব্যাংকের সাবেক এই চেয়ারম্যান। অনুসন্ধানে এমন তথ্য উঠে এসেছে। অভিযোগ মিলেছে, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আয়কর কর্মকর্তাদের যোগশাসজে অনিয়ম করেন তিনি। ২০১৯-২০ অর্থবছরের আয়কর রিটার্নে নিজেকে মাছের খামারি দাবি করেন নজরুল ইসলাম মজুমদার। কোম্পানির নাম মজুমদার ফিশারিজ। খুলনার দাকোপ ও সাতক্ষীরায় সাড়ে ১১শ হেক্টর জমিতে চিংড়ি ও কার্প জাতীয় মাছ ছাষ করার তথ্য দেন রিটার্নে। মাছ বিক্রি করে এক বছরেই আয় দেখান দুইশ দুই কোটি টাকা। যেখানে খরচ হয় ৯১ কোটি টাকা।
২০২০-২১ অর্থবছরেও মৎস্য খামার থেকে ১৩ কোটি টাকা আয় দেখান মজুমদার। এনবিআর কর্মকর্তারা জানান, মৎস্য চাষের মাধ্যমে বিশাল অঙ্কের অর্থ বৈধ করার বিষয়ে আপত্তি তোলেন অনেকেই। বিষয়টি গড়ায় আয়কর আপিল ট্রাইব্যুনালে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ছাড় পান মজুমদার। এসব অভিযোগ খতিয়ে দেখছে এনবিআরের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইসি। এরই মধ্যে মজুমদারের কর নথি সংগ্রহ করেছেন গোয়েন্দারা। চলছে যাচাই-বাছাই। সম্প্রতি এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, কেউ ছাড় পাবেন না। ধীরে ধীরে গুরুত্বের সঙ্গে কর ফাঁকি তদন্ত করা হবে।