‘জামায়াত-শিবিরকে রক্তের হলি খেলা বন্ধ করতে হবে’

কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৩ আগস্ট ২০২৪, ০৯:১০ পিএম

সন্ত্রাস-সহিংসতার বিরুদ্ধে সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান সম্প্রীতি বাংলাদেশের। ছবি: সংগৃহীত
কোটা সংস্কার আন্দোলনের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা করছে একটি মহল। তারা শিক্ষার্থীদের আবেগ ও গুজবকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে সারাদেশকে অচল করে দিতে সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করছে। অপচেষ্টাকারী ওই মহল আবার মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধীদের হাতে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশকে তুলে দিতে চায়।
তারা দেশে আবারো সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপন করতে চায়। ওই অপশক্তির নেতৃত্ব দেয়া জামায়াত ও শিবিরকে রুখে দিতে সবাইকে সম্প্রীতির বন্ধনে একত্রিত হয়ে এগিয়ে আসতে হবে। কোনোভাবেই তাদেরকে আর রক্ত দিয়ে হলি খেলা চালিয়ে যেতে দেয়া যাবে না। সবাই একত্রিত থাকলে-২০৪১ সালের উন্নত বাংলাদেশ উপহার পাবে সবাই। আর সাম্প্রদায়িক শক্তির কাছে পরাজিত হলে আবারো পথ হারাবে বাংলাদেশ। শনিবার রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত ‘সন্ত্রাস-সংঘাত-সহিংসতা নয়, চাই শান্তি সম্প্রীতির বাংলাদেশ’ শীর্ষক মত বিনিময় সভায় বক্তারা এসব কথা বলেন।
সম্প্রীতি বাংলাদেশের আহ্বায়ক পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সভাপতিত্বে, সদস্য সচিব অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহাতাব স্বপ্নিলের সঞ্চালনায় সভায় অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন, সম্প্রীতি বাংলাদেশের যুগ্ম আহ্বায়ক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা লে. জে. (অব.) মোহাম্মদ আলী শিকদার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) অধ্যাপক ড. চন্দ্রনাথ পোদ্দার, বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি বাসুদেব ধর, নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর (অব.) আফিজুর রহমান, মিরপুর ব্যাস্টিস্ট চার্চের প্রধান পুরোহিত রেভারেন্ড মার্টিন অধিকারী, বাংলাদেশ বুদ্ধিস্ট ফেডারেশনের সিনিয়র সহ-সভাপতি বুদ্ধানন্দ মহাথেরো, শিশু বিশেষজ্ঞ স্কয়ার হাসপাতালের চিকিৎসক ড. ইউসুফ রাজা, প্রতিদিনের বাংলাদেশের সম্পাদক মোস্তাফিজ শফি, আলোর ঠিকানার সম্পাদক সিদ্দিকুর রহমান, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সন্তান সংসদের সভাপতি মো. সোলায়মান, নাট্যকর্মী সাঈদ হোসেন প্রমুখ।
সম্প্রীতি বাংলাদেশের আহ্বায়ক পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে চলমান সঙ্কট নিয়ে সংলাপের সুযোগ শেষ হয়ে যায়নি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে চেয়েছেন, এটি একটি সুসংবাদ।
তিনি বলেন, মনে রাখতে হবে বাংলাদেশ মৃত্যুপুরী হওয়ার মতো রাষ্ট্র নয়। নাশকতায় কোনো সাধারণ শিক্ষার্থী অংশ নিচ্ছে না। কারণ কোনো ছাত্র কারাগার থেকে আসামি ছিনিয়ে নিবে না, অস্ত্র লুট করবে না, অস্ত্র হাতে ঘুরে বেড়াবে না। সুতরাং গ্রেপ্তারের সময় উপযুক্ত তথ্য প্রমানসহ আইনের আওতায় আনতে হবে। পাশাপাশি মহামারীর মতো ভয়াবহ হুমকি হয়ে ওঠা গুজবের বিষয়ে সবাইকে সচেতন থাকতে হবে। সবারই মনে রাখতে হবে- নবীন ও প্রবীণ হাত মিলিয়ে পথ চলতে পারলে বাংলাদেশ কখনো পথ হারাবে না।
বীর মুক্তিযোদ্ধা লে. জে. (অব.) মোহাম্মদ আলী শিকদার বলেন, ১৯৭১ সালে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছিলাম, নতুন প্রজন্মের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য। রণাঙ্গনে যখন সহযোদ্ধারা আহত হয়, তারা আমাদের একটি কথাই বলেছে, আমরা যদি বেঁচে ফিরি তাদের সন্তানদের যেন দেখে রাখি। কিন্তু দুঃখের বিষয়- মুক্তিযুদ্ধের এতোবছর পর যা দেখছি, যা শুনছি সেটির জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। ২০১৮ সালে একবার দেখেছি-কিছু যুবক নিজেদের রাজাকার বলে প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়িয়েছে। আর এখন নিজেকে রাজাকার বলে স্লোগান দিচ্ছে। অথচ আমি ভাবতাম নতুন প্রজন্ম যে মতেরই হোক- মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তাদের উপলব্ধি কাজ করবে। সুতরাং আমরা প্রত্যাশা করিনা কেউ নিজেকে রাজাকার বলুক। পাশাপাশি কোনো সহিংসতাও চাই না। যাদের প্রাণ গিয়েছে তাদের প্রতি সমবেদনা জানাই। যারা আন্দোলন করছে তাদের উদ্দেশ্যে বলবো- রাষ্ট্রের সম্পদ কোনো দলের নয়। পদ্মা সেতু ও মেট্রোরেলের মতো সম্পদগুলো দেশের মর্যাদা বাড়িয়েছে। অথচ একটি মহল আন্দোলনের মধ্যে ঢুকে এগুলো ধ্বংস করার পায়তারা করছে। এদিকে সবারই খেয়াল রাখতে হবে।
তিনি আরো বলেন, রাষ্ট্র, সরকার, সুপ্রিমকোর্ট মানি না, রাতারাতি সব মেনে নেয়ার দাবি ওঠানো হচ্ছে। এমন অসুস্থ চিন্তার তৃতীয় কোনো পক্ষ যেন সুযোগ না নিতে পারে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। দাবি আদায়ে আন্দোলন সংগ্রাম করতে হবে। তবে অন্যের চলাফেরার স্বাধীনতা খর্ব করে অবরোধ করা গণতন্ত্র নয়, এটাও ভাবতে হবে।
অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহাতাব স্বপ্নিল বলেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে গুজব ছড়ানোর পাশাপাশি কিছু মিডিয়াও মানুষকে ভুল সংবাদ পরিবেশন করছে। অনেকে ফেসবুকে ছড়ানো গুজব প্রচার করে দিচ্ছেন। যা আরো অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে। গণমাধ্যমের প্রতি অনুরোধ করবো- সত্যিকার অর্থে যা ঘটছে সেগুলো প্রচার করতে।
উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, উত্তরায় গত শুক্রবার পুলিশের পিটুনিতে আন্দোলনকারী নিহতের একটি মিথ্যা খবর প্রচার করা হলো কয়েকটি মিডিয়াতে। অথচ হবিগঞ্জে একজন এমপির বাড়িতে হামলা হলো- সেটি কিন্তু সেভাবে প্রচার করা হয়নি।
ঢাবির অধ্যাপক ড. চন্দ্রনাথ পোদ্দার বলেন, আমরা ৪ শতাধিক শিক্ষক শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মাঠে নেমেছি। শুধু কোটা সংস্কার আন্দোলন নয়- শিক্ষার্থীদের যেকোনো যৌক্তিক আন্দোলনে আমরা সবসময় পাশে আছি এবং থাকবো। দুঃখের বিষয়- এবারের আন্দোলনে তৃতীয় পক্ষ ঢুকে তাদের নীল নকশা বাস্তবায়নের চেষ্টা করছে। কোনো ছাত্র সহিংসতার সঙ্গে জড়িত নয়। এরপরও অনেকের প্রাণ গেছে। সরকারকে এই প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের বিচার করার আহ্বান জানাচ্ছি। সে সঙ্গে কোনো সাধারণ শিক্ষার্থী যেন কারাগারে না থাকে- সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি বাসুদেব ধর বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হৃদয়ে ধারণ করেনি, কিন্তু স্বার্থের জন্য বঙ্গবন্ধু বলতে অজ্ঞান ছিলো এমন লোকের অভাব বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশাতেও ছিলো না- এখনো নেই। বর্তমান পরিস্থিতিতে তেমন লোকের উৎপাতই বেশি।
তিনি বলেন, বর্তমান সময়ের তাণ্ডবের মাধ্যমে জামায়াত কতটা ভয়াবহ- সেটি নতুন প্রজন্ম দেখতে পেয়েছে। তারা ১৯৭১ সালে কতটা ভয়াবহ ছিলো সেটি সহজেই অনুমেয়। এই অপশক্তিতে শক্ত হাতে প্রতিহত করতে সবাইকে আরো একটি পরীক্ষা দিতে হবে।
মিরপুর ব্যাস্টিস্ট চার্চের প্রধার পুরোহিত রেভারেন্ড মার্টিন অধিকারী বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে বলেছিলেন- দেশের প্রধানমন্ত্রীত্ব চাই না, আমরা মানুষের অধিকার চাই। এরপরই রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমের অন্যায়, অবিচার ও অন্ধকার থেকে নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিলো। বঙ্গবন্ধু অসাম্প্রদায়িক দর্শনে সবাইকে এক সুতোয় গেঁথেছিলেন। এখন যদি কোনো পক্ষ ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ানোর অপতৎপরতা করে- সেটি জাতির পিতাকে অপমান করা হবে।
আরো পড়ুন: শিক্ষার্থীদের কাছে দায়িত্বশীল আচরণ আশা করলেন ওবায়দুল কাদের
শিশু বিশেষজ্ঞ ড. ইউসুফ রাজা বলেন, যখনই কোনো অস্থিতিশীল অবস্থা দীর্ঘায়ত হয়, তখন স্বার্থান্বেষী মহল ঘোলা পানিতে মাছ শিকারে নেমে যায়। জামায়াত শিবিরও তাই করছে। তাদের রক্ত দিয়ে এই হলি খেলা বন্ধ করতে হবে। এজন্য সম্প্রীতির সম্পর্ক অটুট রাখতে হবে।