পঙ্গু হাসপাতাল
চিকিৎসাধীন ৭৬ জন অধিকাংশই শ্রমজীবী

সেবিকা দেবনাথ
প্রকাশ: ২৯ জুলাই ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

দুপুর তখন প্রায় ১টা। তখনো হাসপাতালের ক্যাজুয়ালিটি ব্লকে চলছে রোগীদের ড্রেসিংয়ের কাজ। ফ্লোরজুড়ে তুলা, গজ, ব্যান্ডেজ ছড়ানো-ছিটানো। প্রতিটি বেডের পাশে দাঁড়ানো অসহায় স্বজন। তাদের চোখে-মুখে আতঙ্ক আর অনিশ্চয়তার ছাপ স্পষ্ট। চিকিৎসক, নার্স, ওয়ার্ডবয়, ক্লিনার, রোগীর আত্মীয়-স্বজনদের চলাচল। সবকিছুই যেন থমকে যাচ্ছে রোগীদের থেমে থেমে আর্তনাদে। চলতে গিয়েও অনেকে খানিকটা গতি শ্লথ করে ঘুরে তাকিয়ে দেখে নিচ্ছেন কোন বেড থেকে এলো এমন গগন বিদারি আর্তনাদ।
সব মিলিয়ে পরিবেশটা যেন কেমন ভারি অনুভূত হয়। জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (নিটোর) বা পঙ্গু হাসপাতালের ক্যাজুয়ালটি ব্লকের পরিবেশটা গতকাল রবিবার এমনই ছিল। হাসপাতালে কর্তব্যরত চিকিৎসক, নার্স, ওয়ার্ডবয়রা জানান- এখানকার প্রতিদিনের চিত্র প্রায় এমনই। তবে গত কয়েকদিন যাবত যে বিভৎসতা দেখছেন তাতে তারাও স্তম্ভিত। আহতদের অধিকাংশই শ্রমিক, দিনমজুর ও রিকশাচালক। কিছু শিক্ষার্থীও আছে, আছে শিশুও।
হালকা-পাতলা গড়নের ছেলে ৯ বছরের রিফাত। পেছনে রাখা কয়েকটা বালিশে পিঠ ঠেকিয়ে হাসপাতালের ক্যাজুয়ালটি ১ নম্বর ওয়ার্ডের ৪৭ নম্বর বেডে বসেছিল। বাম হাত ও বাম পা সাদা গজ ব্যান্ডেজে মোড়ানো। পায়ের মধ্যে তিনটা রড ঢুকানো। কিছুক্ষণ আগেই তার হাত ও পায়ের ড্রেসিং করা হয়েছে। শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে ‘মা’কে ডেকে সেই যন্ত্রণা সইবার চেষ্টা করছিল। আর থেমে থেমে বলছিল, ‘আমি ব্যথা পাই, আমি ব্যথা পাই। রড আর রশি খুইলা দাও’।
পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বাবা সোহাগ হাওলাদার ছেলের কষ্টে কুঁকড়ে যাচ্ছিলেন। পেশায় পাঠাওচালক সোহাগের দুই ছেলের মধ্যে রিফাত বড়। থাকেন মিরপুর ১৩ নম্বরে। রিফাত শেরেবাংলা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র। সোহাগ ভোরের কাগজকে বলেন, ‘শুক্রবার আমি বরিশাল থেকে বাসায় ফিরছি। দোকান থেকে পেঁয়াজু কিনে আনবে বলে বাসা থেকে বের হয়েছিল ছেলেটা। কিন্তু গোলাগুলির মধ্যে পড়ে হাতে ও পায়ে গুলি লাগছে। হাতের গুলি এখনো ডাক্তার বের করতে পারে নাই। ডাক্তার পরিষ্কার করে কিছু বলছেও না। আক্ষেপ করে তিনি বলেন, শনিবার প্রধানমন্ত্রী হাসপাতালে আসলেন। কিন্তু এই ওয়ার্ডে আসেননি। আমার ছেলেটাকে যদি তিনি একটু দেখে যাইতেন’।
পাশের ৪৬ নম্বর বেডে ব্যান্ডেজ মোড়ানো বাম পা নিয়ে বসে ছিল রবিউল (১১)। কী ঘটে গেছে এখনো যেন ঠিক বুঝে ওঠতে পারছে না সে। অসহায় দৃষ্টিতে আশপাশের বেডে থাকা রোগীর যন্ত্রণা দেখে রবিউল যেন কথা বলাই ভুলে গেছে। তার মা মাহমুদা বেগম ছেলের বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে চোখ মুছছেন। বড় বোন ভাইয়ের গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করছিল। মাহমুদা জানান, মিরপুর-১ টোলারবাগে থাকেন তারা। মডেল একাডেমি স্কুলের ছাত্র রবিউল। নিষেধ করার পরও সাইকেল নিয়ে বাসা থেকে বের হয়েছিল আইসক্রিম আনার জন্য। তখনই বাম পা দিয়ে গুলি ঢুকে ডান পা দিয়ে বের হয়ে যায়।
ক্যাজুয়ালটি ২ নম্বর ওয়ার্ডের ৩৬ নম্বর বেডে চিকিৎসা নিচ্ছেন ইমরান। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ছেলে ইমরান ঢাকা কলেজের ৪র্থ বর্ষের ছাত্র। থাকেন রায়েরবাগে। ১৯ জুলাই বাসা থেকে বের হয়েছিলেন। এ সময় মাকে ফোনে জানিয়েছিলেন, কলেজ বন্ধ। ঢাকার পরিস্থিতিও ভালো নয়। শনিবারই বাড়ি চলে আসবেন। ওপাশ থেকে মা মীর্জা হাবিবাও ছেলের কথায় সায় দিয়েছিলেন। কিন্তু বাম পায়ে হাঁটুর নিচে গুলি লাগে ইমরানের। গুলিতে তার পা এতটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে- হাটুর নিচের পুরো অংশটাই যেন দুই দিকে ছড়িয়ে গেছে। রড লাগিয়ে তা খাটের স্ট্যান্ডের সঙ্গে পা ঝুলিয়ে ড্রেসিং করা হচ্ছিল। জোরে চিৎকার করে ‘আল্লাহ’ বলে পাশে বসা মায়ের কোলে মুখ গুজে যেন কষ্ট কিছুটা কমাতে চাইছিল ইমরান। আর ছেলের মাথায় ডান হাত রেখে মুখে ওড়না গুজে দিয়ে বাম হাত দিয়ে তা ধরে কাঁদছিলেন হাবিবা।
কাঁচপুরের একটি পোশাক কারখানায় অ্যাম্ব্রয়ডারির কাজ করতেন চাঁদপুর জেলার ছেলে নাজিম হোসেন (১৬)। ২০ জুলাই বিকালে চিটাগাং রোডের ডাচ-বাংলা ভবন এলাকায় গুলিবিদ্ধ হন তিনি। পথচারীরা তাকে প্রথমে একটা প্রাইভেট হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানে শুধু রক্তপাত বন্ধের ব্যবস্থা করা হয়। পরে আহতের পরিবার তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে নিয়ে গেলে সেখানে গুলি বের করে পঙ্গু হাসপাতালে পাঠায়। তিনি এখন আছেন ক্যাজুয়ালটি-২ ওয়ার্ডে। নাজিম বলেন, ‘শনিবার বিকাল ৫টার দিকে কাজ শেষে বাসায় ফিরছিলাম। চিটাগাং রোডে গোলাগুলি হচ্ছিল। চারদিকে মানুষ দৌড়াচ্ছিল। হেলিকপ্টার থেকেও গুলি ছোড়া হচ্ছিল। আমার বাম পায়ে একটা গুলি লাগে। আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। আমাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেয়া হয়।
নাজিমের মা মরিয়ম খাতুন ভোরের কাগজকে জানান, তার স্বামী রিকশাচালক। অভাব ঘুচাতে নাজিম অল্প বয়সে কাজে যোগ দেয়। তিন ভাইয়ের মধ্যে নাজিম পরিবারের বড় সন্তান। মরিয়ম খাতুন বলেন, পোলাডার কতইবা বয়স। এই বয়সে তার একটা পা কাটা গেল। পোলাডার বাকি জীবন কীভাবে চলব?’
ক্যাজুয়ালটি-২ এর ৩২ নম্বর বেডে আছেন বাড্ডা আলাতুন্নেছা উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী মোহাম্মদ রিফাত। ১৯ জুলাই সকাল ১০টার দিকে রামপুরায় টেলিভিশন সেন্টারসংলগ্ন ইউ লুপের কাছে তার ডান পায়ের হাঁটুর উপরে গুলি লাগে। তাকে রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখে স্থানীয় কয়েকজন ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যায়। সেখান থেকে তাকে পাঠানো হয় পঙ্গু হাসপাতালে। চিকিৎসক অস্ত্রোপচার করে রিফাতের ডান পায়ের হাঁটুর উপর থেকে কেটে ফেলেছেন। হাঁটুর উপরে এক পাশে গুলি লেগে অন্য পাশ দিয়ে বের হয়ে গেছে। পায়ের সব রগই ছিঁড়ে আলাদা হয়ে গিয়েছিল।
ক্যাজুয়ালটি-২ ওয়ার্ডে বেডে শুয়ে আছেন পা হারানো কিশোর রাকিব। গজ-ব্যান্ডেজে মোড়ানো কাটা পা যেন আড়াল করতে চাইছে রাকিব। তাই হয়তো গামছা দিয়ে সেই পা ঢেকে রেখেছে। পাশে বসা মা রীনা বেগম জানান, তাদের বাড়ি কুমিল্লার বরুড়া। নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে তার স্বামীর একটি ছোট মুদি দোকান আছে। দুই ছেলের মধ্যে রাকিব বড়। বিদেশ যাবার জন্য পাঁচ মাস ধরে সেলুনে কাজ শিখছিল রাকিব। বিদেশ যাবার জন্য সব কাগজপত্রও তৈরি হয়ে গিয়েছে। কিছুদিনের মধ্যেই বিদেশে যাওয়ার কথা ছিল রাকিবের। রাকিব বলেন, ২০ জুলাই বিকালে চিটাগাং রোড গলির ভেতরে ছিলাম। কোন দিক থেকে এসেছে বলতে পারব না। টের পেলাম ১টা গুলি এসে পায়ে লাগছে।
২ নম্বর ওয়ার্ডের ১৭ নম্বর বেডে শুয়ে ছিলেন নূর ইসলাম (২০)। ১৯ জুলাই সাভারের উলান এলাকায় গুলিবিদ্ধ হন এই গার্মেন্টসকর্মী। বাবা মমিনুর ইসলাম বলেন, চার সন্তানের মধ্যে নূরই বড়ই। নূরের পায়ে ২টা অপারেশেন হইছে। মঙ্গলবার আবার অপারেশন হবে। ছেলেটার পা থাকবে কিনা তা নিয়েই ভয়ে আছি। আল্লাহ যেন এমন দিন কাউরে না দেয়।
পঙ্গু হাসপাতালের ক্যাজুয়ালিটি ব্লকের তথ্য অনুযায়ী, ১ নম্বর ওয়ার্ডে ১৭ জন, ২ নম্বর ওয়ার্ডে ৫৩ জন, ৩ নম্বর ওয়ার্ডে ৫ জন আর কেবিনে একজন চিকিৎসাধীন আছেন। যারা কোটা সংস্কার আন্দোলনে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ ও সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। তাদের কারো লেগেছে একটি গুলি, কারো একাধিক, ছররা গুলিও শরীরে নিয়ে বিছানায় কাতরাচ্ছেন অনেকে।
কর্তব্যরত নার্স-ওয়ার্ডবয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৭ জুলাই থেকে যারা এই হাসপাতালে এসেছেন তাদের বেশির ভাগ গুলিবিদ্ধ অবস্থায় এসেছেন। মিরপুর, মোহাম্মদপুর, উত্তরা, বাড্ডা, নারায়ণগঞ্জ, যাত্রাবাড়ী, রামপুরাসহ বিভিন্ন এলাকার রোগীদের চাপ ছিল এখানে। আর চিকিৎসাধীন রোগীদের বেশির ভাগের দাবি, তারা বিক্ষোভ কিংবা সংঘর্ষে অংশ নেননি, জরুরি কাজে কিংবা জীবিকার তাগিদে বাসা থেকে বের হয়ে সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে কিংবা নিরাপদ আশ্রয় খুঁজতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন তারা।
চিকিৎসকরা জানান, চিকিৎসাধীন অনেকের কাটা হাত-পায়ে সেলাই করতে হবে আরো পরে। কেননা কাটা জায়গা থেকে রস পড়বে। তা শুকাতে হবে। ফলে অনেক রোগীকে হাসপাতালে দীর্ঘসময় থাকতে হবে। তারা আপ্রাণ চেষ্টা করছেন হাত-পা যাতে কেটে ফেলতে না হয়। তবুও অনেকের শেষ রক্ষা হবে কিনা তা নিশ্চিত নয়।
চিকিৎসাধীনদের সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. কাজী শামীম উজ্জামান ভোরের কাগজকে বলেন, গুলিতে আহত হয়ে এই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২৭২ জন। ২৬ জুলাই আইসিইউতে চিকিৎসাধীন এক ব্যক্তি মারা গেছেন। বর্তমানে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন ৭৬ জন। এদের মধ্যে ৬ জনের অবস্থা সংকটাপন্ন। বুলেটের কারণে রক্তনালী ছিড়ে যাওয়ায় তাদের কারোর হাত, কারোর পা কেটে ফেলা হয়েছে। বাকিদের শারীরিক অবস্থা স্থিতিশীল। যারা হাসপাতালে রয়েছেন, তাদের প্রতিদিন ফলো-আপ করা হচ্ছে। বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা আর শরীরের অবস্থা দেখেই কার কী প্রয়োজন, আরো অস্ত্রোপচার লাগবে কিনা তা বুঝা যাবে। আমরা আমাদের সাধ্যমতো রোগীদের সর্বোচ্চ সেবাটাই দেয়ার চেষ্টা করছি। শুক্রবার প্রধানমন্ত্রী আহতদের দেখতে হাসপাতালে এসেছিলেন। তিনি আহতদের চিকিৎসার ভার নিয়েছেন।