আনার হত্যা
কে এই আ.লীগ নেতা সাইদুল করিম মিন্টু?

কাগজ ডেস্ক
প্রকাশ: ১৩ জুন ২০২৪, ০৪:৩১ পিএম

ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনার ও ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টু। ছবি: সংগৃহীত
কলকাতার পশ্চিমবঙ্গে ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনারকে হত্যা মামলায় ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টুকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে সোপর্দ করে ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করেছে পুলিশ।
বৃহস্পতিবার (১৩ জুন) দুপুর ২টার দিকে তাকে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করে মামলার সুষ্ঠু তদন্তের জন্য তাকে ১০ দিনের রিমান্ডে নিতে আবেদন করেন ডিবি পুলিশের সিনিয়র সহকারী কমিশনার মাহফুজুর রহমান।
ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে এ রিমান্ড শুনানি অনুষ্ঠিত হবে।
এদিকেি এমপি আনার হত্যার ঘটনায় নতুন করে সামনে এসেছে পাঁচ প্রশ্ন। এসবের উত্তর জানতে ঝিনাইদহ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টুকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ।
কলকাতার নিউ টাউনের সঞ্জীভা গার্ডেন থেকে খুনের এক সপ্তাহ আগে ৬ মে কেনো হত্যা মিশনের প্রধান দুই সদস্য মিন্টুকে ফোন করলেন? যাদের সঙ্গে মিন্টুর এ কথোপকথন হয়েছে, তারা হলেন– মূল পরিকল্পনাকারী যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে যাওয়া আক্তারুজ্জামান শাহীন ও তার বেয়াই চরমপন্থি নেতা শিমুল ভূঁইয়া ওরফে আমানুল্লাহ। দু’পক্ষের মধ্যে আলাপ হয় টাকার অঙ্ক নিয়ে। দেশে ফিরে ওই বিষয়ে জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক কাজী কামাল গিয়াস আহমেদ বাবুর সঙ্গে যোগাযোগ করতে শাহীন ও শিমুলকে নির্দেশ দেন মিন্টু। অনেক দিন ধরে বাবু এলাকায় মিন্টুর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত।
আরো পড়ুন: আনার হত্যায় আ.লীগ নেতা মিন্টু ৮ দিনের রিমান্ডে
বুধবার (১২ জুন) তদন্ত সংশ্লিষ্ট একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
মঙ্গলবার (১১ জুন) ধানমন্ডির একটি এলাকা থেকে মিন্টুকে আটক করে ডিবি। এরপর তাকে ডিএমপির গোয়েন্দা কার্যালয় মিন্টো রোডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। সেখানে পুলিশ হেফাজতে আগে থেকেই রয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের আরেক নেতা বাবু। বুধবার পর্যন্ত মিন্টুকে আটকের কথা আনুষ্ঠানিকভাবে পুলিশের পক্ষ থেকে স্বীকার করা হয়নি। তবে একটি সূত্র বলছে, বাবুর মুখোমুখি করেও মিন্টুকে কিছু প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছেন গোয়েন্দারা।
বুধবার সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, সংসদ সদস্য আজীম হত্যার তদন্ত বাধাগ্রস্ত করতে তদবির বা কোনো চাপ নেই। সঠিক পথেই তদন্ত এগোচ্ছে। তদন্তে যা বেরিয়ে আসবে, সেভাবেই বিচার প্রক্রিয়া এগিয়ে যাবে।
তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দু’জন কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, আজিম হত্যায় জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মিন্টুর জড়িত থাকার বিষয়টি প্রথমে সামনে আসে শিমুল ভূঁইয়াকে জিজ্ঞাসাবাদের পর। শিমুল ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিতে তার নাম বলেছেন। এ ছাড়া বাবুর নামও ফাঁস করেন শিমুল। এরপর গোয়েন্দারা খুঁজতে থাকেন– কেন, কীভাবে, কী কারণে এ হত্যাকাণ্ডে মিন্টুর নাম সামনে আসছে। এর উত্তর মেলাতে গিয়ে গোয়েন্দাদের তদন্তে সন্দেহভাজন কিছু বিষয় ঘুরপাক খায়। আজিম হত্যার বিষয়টি জানাজানি হওয়ার আগে কেনো বাবুর ফোন থেকে ছবি দেখে তা নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা করেছিলেন মিন্টু। নিজ জেলার একজন সংসদ সদস্যকে হত্যা করার মতো লোমহর্ষক ঘটনার ক্লু পেয়েও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানাননি তিনি। ওই সময় আজিমের পরিবারের সদস্যরা নানা জায়গায় তাকে খোঁজাখুঁজি করেছিলেন। যখন অনেকেই জানতেন আজিম হয়তো ‘নিখোঁজ’, তখন মিন্টু নিশ্চিত হয়ে যান আজিমকে হত্যা করা হয়েছে। কলকাতা থেকে লাশ উদ্ধারের আগেই কেনো হঠাৎ বাবুর তিনটি মোবাইল ফোন গায়েব! এ ঘটনায় থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন তিনি। পরে এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে বাবু দাবি করেন, তার ব্যবহৃত তিনটি মোবাইল ফোন নিয়ে গেছেন মিন্টু। এসব নষ্ট করে ফেলা হতে পারে।
আরো পড়ুন: দেশে ১০ শিশুর ৯ জনই পারিবারিক সহিংসতার শিকার : ইউনিসেফ
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ওই ফোনে খুনের অনেক আলামত ছিল। সবকিছু সামনে আসার শঙ্কায় তিনটি মোবাইল ফোন সরিয়ে ফেলা হয়। এ ব্যাপারে মিন্টুকে এখন জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। এ ছাড়া কেনো খুনের এক সপ্তাহ আগে ৬ মে সঞ্জীভা গার্ডেনস থেকে মিন্টুকে ফোন করেন শাহীন ও শিমুল। গোয়েন্দাদের ভাষ্য মতে, অগ্রিম ২০ লাখ টাকা দেয়ার কথা বলা হয়েছিল। আর হত্যা মিশন সফল করতে টাকার অঙ্ক ছিল ২ কোটির বেশি। এমনকি হত্যা মিশন সফল করে ১৫ মে ঢাকায় আসেন শিমুল। এর পর টাকা পরিশোধের জন্য বাবুকে ফোন করেন। দিন ও তারিখ ঠিক হওয়ার পরও শেষ পর্যন্ত টাকা পরিশোধ করেননি তিনি। আজিম হত্যার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যায় ২২ মে। এর পরই হত্যা মিশনের সদস্যরা একে একে গা-ঢাকা দেন। তবে ২০ মে দেশ ছাড়েন শাহীন। কারও কারও ভাষ্য, আজীম হত্যার তদন্তে যে প্রশ্ন সামনে আসছে, তার সদুত্তর দিতে না পারলে আজকালের মধ্যে মিন্টুকে এ মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হতে পারে। গোয়েন্দারা নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা করছেন, রাজনৈতিকভাবে লাভবান হতে এ হত্যার ছকে মিন্টু ছিলেন কিনা। কারণ সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনে ঝিনাইদহ-৪ আসন থেকে মনোনয়ন প্রত্যাশী ছিলেন সাইদুল করিম মিন্টু।
এমপি কন্যা ডরিনের অভিযোগ
এদিকে আজিমের মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন বলেছেন, ‘অপরাধীদের বাঁচাতে তদবির হচ্ছে। কোনো তদবিরের চাপে বাবা হত্যার বিচার যেনো নষ্ট না হয়।’ বুধবার সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে বাবা হত্যার বিচার চেয়েছেন ডরিন। এরপর সাংবাদিকদের ডরিন বলেন, ‘স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে বলেছি, আমার বাবাকে হত্যা করা হয়েছে, এ ঘটনার যেনো সঠিক বিচার হয়। জড়িত সন্দেহে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য অনেককে আটক করা হয়েছে। আমি শুনেছি, অপরাধীদের বাঁচাতে অনেক জায়গা থেকে তদবির হচ্ছে। তাদের যেনো ছেড়ে দেয়া না হয়।’
তিনি বলেন, ‘বাবু নামে যাকে আটক করা হয়েছে, তিনি বাবার প্রতিপক্ষ নন। আমাদের সঙ্গে তার কোনো শত্রুতাও নেই। আমার মনে অনেক প্রশ্ন জাগছে। আমার কথা হলো, এ খুনে টাকার জোগানদাতা কে? আপনারা দেখেছেন, তাকে আটকের আগে থানায় তিনি জিডি করেছেন। তার তিনটি মোবাইল ফোন হারিয়েছে বলে দাবি করেন। একই দিনে একজন মানুষের তিনটি ফোন কীভাবে হারিয়ে যায়– সেটাও আমার প্রশ্ন।’
ডরিন আরো বলেন, ‘মিন্টুকেও জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডিবি নিয়ে গেছে। অবশ্যই তাদের কাছে কোনো তথ্যপ্রমাণ আছে, সেটা আমি নিজেও জানি। আমি বিশ্বাস করি, অপরাধীকে তিল পরিমাণ ছাড় দেন না প্রধানমন্ত্রী।’
আরো পড়ুন: শুক্রবার থেকে লম্বা ছুটিতে যাচ্ছে সরকারি চাকরিজীবীরা
সদুত্তর না পেলে ব্যবস্থা
গতকাল (বুধবার ১২ জুন) বিকেলে রাজধানীর মিন্টো রোডের নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশীদ বলেছেন, ডিবির কাছে হত্যার বিষয়ে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত আছে। এর ভিত্তিতে মিন্টু যদি সদুত্তর দিতে না পারেন, তাহলে তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে। তিনি বলেন, বাবুর কাছে পাওয়া তথ্য-উপাত্ত বিচার-বিশ্লেষণের পরই জিজ্ঞাসাবাদের জন্য মিন্টুকে ডাকা হয়েছে। মিন্টুর কাছে তথ্যগুলো জানতে চাওয়া হবে।
তিনি বলেন, মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার কাছে যদি মিন্টু সদুত্তর দিতে পারেন, তবে তাকে ছেড়ে দেয়া হবে। আর যদি কোনো প্রশ্নের সদুত্তর দিতে না পারেন, তদন্তের ধারাবাহিকতায় যা করার তাই করা হবে। জিজ্ঞাসাবাদে বাবু অকপটে শিকার করেন, শিমুল ভূঁইয়ার সঙ্গে তার বৈঠক হয়েছিল। শিমুল ভূঁইয়া তাকে এমপি আজিমকে হত্যার পর ছবি দেখান।
ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার হারুন বলেন, এমপি আজিম হত্যায় এ পর্যন্ত দুই রাজনীতিকের সম্পৃক্ততা পেয়েছি। বাবু রিমান্ডে রয়েছেন, মিন্টুর জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। এ ছাড়া অনেকের সম্পর্কে তথ্য-প্রমাণ রয়েছে। ধীরে এগোচ্ছি। কারো প্ররোচনায় কোনো নিরপরাধ ব্যক্তিকে হয়রানি করা হবে না।
ঝিনাইদহে মানববন্ধন
ঝিনাইদহ প্রতিনিধি জানান, আজিম হত্যায় জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মিন্টুকে আটকের ঘটনায় ঝিনাইদহে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিল হয়েছে। গতকাল (বুধবার) দুপুরে জেলা আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের আয়োজনে শহরের পায়রা চত্বরে এ কর্মসূচি পালিত হয়। এদিকে মিন্টুর শাস্তি দাবিতে কালীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগ আলাদা কর্মসূচি পালন করে। কালীগঞ্জের পৌর মেয়র ও পৌর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আশরাফুল আলম আশরাফ বলেন, প্রাণপ্রিয় নেতার খুনের সঙ্গে জড়িতদের আটক ও বিচার না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন অব্যাহত থাকবে।
আরো পড়ুন: উদ্ধার মাংসের টুকরো ও হাড়গোড় ‘পুরুষ মানুষের’
উল্লেখ্য, গত ১২ মে এমপি আনার চিকিৎসার উদ্দেশে কলকাতায় যান। সেখানে বন্ধু গোপাল বিশ্বাসের বাসায় ওঠেন। পর দিন দুপুরে চিকিৎসার উদ্দেশ্যে যাচ্ছেন বলে ওই বাসা থেকে বের হলেও তিনি যান কলকাতা নিউটাউনের একটি আলিশান ফ্ল্যাটে। সেদিন ওই ফ্ল্যাটে হত্যার শিকার হন এমপি আনার। মরদেহ টুকরো টুকরো করে ট্রলি ব্যাগে নিয়ে বিভিন্ন স্থানে ফেলে দেয় হত্যাকারীরা। ওইদিন ফ্ল্যাটে ছিলেন আমানুল্লাহ সাইদ ওরফে শিমুল ভূঁইয়া ওরফে শিহাব ওরফে ফজল মোহাম্মদ ভূঁইয়া, তানভীর ভূঁইয়া, শিলাস্তি রহমান, জিহাদ হাওলাদার, সিয়াম হোসেন, মোস্তাফিজুর রহমান, ফয়সালসহ অন্যরা।
আর এই হত্যার মূল পরিকল্পনা করেন এমপি আনারের বন্ধু যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক আক্তারুজ্জামান শাহীন। যিনি হত্যার চূড়ান্ত ছক কষে আনার কলকাতা যাওয়ার আগেই দেশে ফিরে আসেন। হত্যার খবর ছড়িয়ে পড়লে বাংলাদেশ থেকে দিল্লি, কাঠমান্ডু, দুবাই হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান শাহীন। বর্তমানে তিনি সেখানেই অবস্থান করছেন।