রেমাল পরবর্তী দীর্ঘমেয়াদী প্রকল্প বাস্তবায়নে বিশেষজ্ঞদের মতামত

হরলাল রায় সাগর
প্রকাশ: ০৬ জুন ২০২৪, ১০:২৪ পিএম

ছবি: সংগৃহীত
প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় রেমাল উপকূলীয় অঞ্চলে রেখে গেছে তার দীর্ঘস্থায়ী ক্ষত চিহ্ন। ইতোমধ্যে এর বিরূপ প্রভাব প্রত্যক্ষ করছেন উপকূলের মানুষ। বিশেষ করে লবণ পানিতে দীর্ঘ মেয়াদী ক্ষতির মুখে পড়ছেন উপকূলবাসী। সুপেয় পানির সংকট দেখা দিয়েছে অনেক এলাকায়। রয়েছে পানিবাহিত রোগ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা। পেশা হারিয়েছেন উপকূলের বহু মানুষ ।
এমন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে সরকারি-বেসরকারিভাবে পর্যাপ্ত ত্রাণ পৌঁছানো, খাবার ও পানি সরবরাহ, ঘর মেরামতে অর্থসহ জিনিসপত্র দিয়ে সহযোগিতা ছাড়াও যারা পেশা হারিয়েছেন তাদের ক্ষুদ্র ঋণ দেয়ার মতামত দিয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, এ মুহূর্তে ক্ষতিগ্রস্ত পাশে দাঁড়ানোই বড় কাজ। এছাড়া উপকূল রক্ষায় টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণে সেনাবাহিনীর মাধ্যমে দীর্ঘস্থায়ী প্রকল্প গ্রহণে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তারা।
এদিকে ঘূর্ণিঝড় রেমালে খুলনা অঞ্চলের তিন জেলায় ৬১ কিলোমিটার, বরিশাল অঞ্চলে কমপক্ষে ৪০০ জায়গায় বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নোয়াখালী এবং চট্টগ্রাম অঞ্চলে বহু জায়গায় বেড়িবাঁধ ভেঙে গেছে। ফলে জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হয়েছে ১৯ জেলার অনেক নিম্নাঞ্চল। এতে উপকূলের নদ-নদীর পাশাপাশি লোকালয়ে ঢুকে গেছে লবণ পানি। নষ্ট করে দিয়েছে মিষ্টি জলের আধার পুকুরসহ খাল ও ডোবা। এছাড়া জলোচ্ছ্বাস ও ঘূর্ণিঝড়ে ভেসে গেছে মাছের ঘের। সরকারি হিসাবেই ঘরবাড়ি সম্পূর্ণভাবে বিধ্বস্ত হয়েছে ৩৫ হাজার ৪৮৩টি। আংশিকভাবে বিধ্বস্ত হয়েছে এক লাখ ১৪ হাজার ৯৯২টি ঘরবাড়ি। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা ৩৭ লাখ ৫৮ হাজার ৯৬ জন। ২৬ মে রাত ৮টায় প্রবল ঘূর্ণিঝড় রেমাল উপকূলে আঘাত হানলেও এর প্রভাব শুরু হয় আগের দিন সন্ধ্যা ৬টা থেকেই। আঘাত হানার পরের দিন (২৭ মে) সন্ধ্যা পর্যন্ত রেমালের প্রভাব খাটায় গোটা দেশে। দীর্ঘ ব্যাপ্তির এ ঘূর্ণিঝড়ে দীর্ঘ মেয়াদী ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়ছেন উপকূলের বাসিন্দারা।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় এনভায়রনমেন্টাল সাইন্স ডিসিপ্লিন বিভাগের অধ্যাপক ড. আব্দুল্লাহ হারুন চৌধুরী ভোরের কাগজকে বলেন, ঘূর্ণিঝড়ে রেমালের স্থায়ীত্ব ও ব্যাসার্ধ (জায়গা) বেশি থাকলেও এর শক্তি সিডর বা আইলার চেয়ে অনেক কম ছিলো। সিডর-আইলায় অনেক মানুষ মারা গেছে। সে তুলনায় রেমালে মৃত্যু সংখ্যা খুবই কম, যদিও একটা মৃত্যুও কাম্য নয়। কিন্তু রেমালের ব্যাপ্তি প্রায় ৫০ ঘণ্টার মতো বিদ্যমান থাকায় ক্ষয়ক্ষতি বেশি হয়েছে। তিনি বলেন, প্রাথমিকভাবে সরকারি-বেসরকারিভাবে সামর্থ্য অনুযায়ী দুর্গত মানুষকে তাৎক্ষণিক সহযোগিতা বিশেষ করে খাবার পানি ও খাবার দেয়া দরকার। দ্বিতীয়ত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিৎ করা দরকার। এ সময়ে পানিবাহিত অনেক রোগ ছড়িয়ে পড়ার আশংকা থাকে। খাবার ও অপুষ্টি মিলিয়ে মানুষ রোগাক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই সব মহল থেকে স্বাস্থ্য ঝুঁকি মোকাবেলায় ব্যবস্থা নেয়া জরুরি।
পাশাপাশি যারা ক্ষতিগ্রস্ত তাদের পুনরায় দাঁড়ানোর জন্য সহযোগিতা করা উচিৎ বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, সেটা অর্থনৈতিক হতে পারে, জিনিসপত্র, বিভিন্ন রকমরে ত্রাণ সামগ্রী কিংবা ঘর মেরামতের জিনিসপত্র হতে পারে। তিনি আরো বলেন, এছাড়া অনেকের পেশাগত সমস্যা হয়েছে। তাকে তার পেশায় ফিরিয়ে আনতে ক্ষুদ্র ঋণ সহায়তা দেয়া যেতে পারে।
ভেঙ্গে যাওয়া বাঁধগুলো যত দ্রুত সম্ভব মেরামতের উদ্যোগ নিতে হবে মন্তব্য করে আব্দুল্লাহ হারুণ চৌধুরী বলেন, এক্ষেত্রে স্থানীয় মানুষের সহযোগিতা নেয়া প্রয়োজন। আর এ বেড়িবাঁধ মেরামত কিংবা নির্মাণে সেনাবাহিনীকে নিয়োগ দেয়া উচিৎ। দীর্ঘ স্থায়ী প্রকল্প করতে পারলে দেশের জন্য মঙ্গল।
এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, সিডর-আইলাসহ বিভিন্ন দুর্যোগে দেখা গেছে সরকারিভাবে করতে দিলে কিছু অসৎ রাজনৈতিক ব্যক্তির প্রভাব থাকে। এতে তাদের সহসা বাধ মেরামতে সদিচ্ছা কম থাকে। তাদের কেউ কেউ আবার বাঁধ ভেঙে ফেলে (সিডর-আইলায় খুলনার কয়রা অঞ্চলে দেখা গেছে)। বাঁধগুলো যত বেশি ভাঙা থাকবে, মানুষের বিপদ-ভোগান্তি বেশি থাকবে- এটা দেখিয়ে তারা আবার বিভিন্ন পর্যায় থেকে ত্রাণ সামগ্রী বেশি নিতে পারবে।
এ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ বলেন, যে ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধগুলো মেরামত বা বাঁধ নির্মাণ করা হয়, তার ডিজাইন বা প্লান বহু জায়গায় সঠিকভাবে করা হয় না। যার কারণে বাঁধগুলো টেকে না। টেকসই বাধের ব্যাপারে যথাযথ উদ্যোগ নিতে হবে। টেকসই বাঁধ মানেই কংক্রিট বা ইটের বাঁধ নয়, মাটির বাঁধও টেকসই হতে পারে।
বরগুণাসহ বিভিন্ন জায়গায় এরকম বাঁধ আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাঁধগুলো হতে হবে ঢালু। এতে পানির চাপ সহনীয় হয়। বাধ ভাঙতে পারে না। কিন্তু বাঁধ খাড়া হলে তা অল্পেতেই পানির চাপে ভেঙে যায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই খাঁড়া বাঁধ নির্মাণ করা হয়। এক্ষেত্রে সরকারকে দৃঢ় তদারকি করতে হবে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ গওহর নঈম ওয়ারা বলেন, রেমাল একটি মধ্যম মানের ক্রান্তীয় বা গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ঝড়। তারপরও এর এতো দীর্ঘ স্থায়িত্বকাল দেখে অনেকেই অবাক হয়েছেন। কারণ এটি উপকূলে আঘাত হানার পর থেকে প্রায় ৫০ ঘণ্টা পর্যন্ত বাংলাদেশে অবস্থান করেছে। একইসঙ্গে ঘূর্ণিঝড়ের কারণে বাঁধ সংলগ্ন নিচু এলাকা উপচে লোকালয়ে লবণাক্ত পানি ঢুকেছে। তিনি বলেন, খুলনা, বরিশাল, নোয়াখালী ও চট্টগ্রাম অঞ্চলে বহু জায়গায় বেড়িবাঁধ ভেঙে লোকালয়ে নোনাজল ঢুকে মিষ্টি জলের আধারগুলো নষ্ট করে দিয়েছে। অনেক জায়গায় ভাটার টানে পানি বেরিয়ে যাওয়ার পথ বন্ধ হয়ে গেছে। জলখালাসির পদ বিলুপ্তির পর থেকেই দেশের বেশিরভাগ জলকপাট রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে কোথাও ভেঙে গেছে কোথাও দেবে গেছে কপাট।
এবারের ঘূর্ণিঝড়ে বেড়িবাঁধের ক্ষতি এক দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতের সৃষ্টি করতে যাচ্ছে মন্তব্য করে গহর নঈম ওয়ারা বলেন, এ মুহূর্তে দ্রুত ভেঙ্গে যাওয়া বাঁধগুলো মেরামত করতে হবে। এজন্য জনগণকে সম্পৃক্ত করে জনগণের মালিকানায় বাঁধ নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করতে হবে। প্রয়োজনে বর্তমান নীতি-কৌশল পরিবর্তন করে এটা করতে হবে। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডকে চরফ্যাশন মডেল নিয়েই এগুতে হবে।
তিনি আরো বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় ভিআইপিদের চলাচল সীমিত করতে হবে। ত্রাণ কাজে মনোনিবেশ না করে প্রশাসনকে প্রটোকলে সময় দিতে হয়। ফলে ত্রাণ কাজ বাধাগ্রস্ত হয়। ফটোসেশন মানবাধিকারের সঙ্গে যায় না, এধরণের প্রবণতা পরিহার বাঞ্ছনীয়।
এ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ বলেন, এ মুহূর্তে খাদ্য নিরাপত্তার নিশ্চিত করতে মিঠাপানির জলাশয় থেকে দ্রুত লবণাক্ত পানি অপসারণ করতে হবে। সামনের আমন মৌসুম ধরতে হলে মাঠ ও জলাশয় থেকে দ্রুত নোনাজল বের করার ব্যবস্থা নিতে হবে। পাম্প করে এ পানি বের করার ব্যবস্থা করা যায়। ১৯৯১ সালের সাইক্লোন এবং ২০০৭ সালের সিডরের পর এটা করা হয়েছিলো।
পরিবেশ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. আহমেদ কামরুজ্জমান মজুমদার বলেন, সরকার ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষয়-ক্ষতির কোনো হিসাবও ঠিকমত রাখে না। দেশের ন্যাচার উপযোগী হলিষ্টিক এপ্রোচ নিয়ে কাজ করা উচিত। উপকূলীয় জেলাগুলোতে দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য পর্যাপ্ত সাইলো ব্যবস্থা চালু করার দাবী জানান তিনি।