আতিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে নানান অভিযোগ
আইন ভেঙ্গে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে তৃতীয় মেয়াদে উপাচার্য নিয়োগ

কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১০:৫২ পিএম

আইন ভঙ্গ করে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (এনএসইউ) উপাচার্য অধ্যাপক আতিকুল ইসলামকে চলতি দায়িত্বে নিয়োগ দিয়েছে এনএসইউর বোর্ড অব ট্রাস্টিজ (বিওটি)
দেশে সরকারি-বেসরকারি কোনো বিশ্ববিদ্যালয়েই তৃতীয়বারের মতো উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার রেওয়াজ নেই। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুযায়ী, উপাচার্যের মেয়াদ শেষ হলে রাষ্ট্রপতি ও আচার্য নতুন উপাচার্য নিয়োগ না দেওয়া পর্যন্ত উপ-উপাচার্য বা কোষাধ্যক্ষকে চলতি দায়িত্ব দিতে হবে। তবে আইন ভঙ্গ করে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (এনএসইউ) উপাচার্য অধ্যাপক আতিকুল ইসলামকে চলতি দায়িত্বে নিয়োগ দিয়েছে এনএসইউর বোর্ড অব ট্রাস্টিজ (বিওটি)। বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ছেড়ে বিদেশি পাসপোর্টধারী আতিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে দুদকে অর্থ জালিয়াতির অভিযোগে তদন্তে চলছে। এমন সময় তাকে নতুন করে ১৮ মাসের চলতি দায়িত্ব দেয়ার পর থেকেই বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে।
এদিকে আইন অমান্য করে তৃতীয় মেয়াদে নিয়োগ দেয়ার বিষয়টি খতিয়ে দেখছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। ভোরের কাগজকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক ড. সাজ্জাদ হোসেন।
জানা গেছে, অধ্যাপক আতিকুল ইসলামকে চলতি দায়িত্ব দিয়ে এনএসইউ ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান জাভেদ মুনির আহমেদ লিখেছেন–‘এনএসইউ’র ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে আমি অধ্যাপক আতিকুল ইসলামকে উপাচার্যের অন্তর্বর্তী পদের জন্য মনোনীত করেছি, যা তিনি গ্রহণ করেছেন। এই নিয়োগ ২৩ ফেব্রুয়ারি থেকে কার্যকর হবে।’
এনএসইউ সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিয়োগ পেয়ে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে প্রথম মেয়াদে যোগদান করেন অধ্যাপক আতিকুল ইসলাম। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি দ্বিতীয় মেয়াদে নর্থ সাউথের উপাচার্য হন। গত ২৩ ফেব্রুয়ারি তার দ্বিতীয় মেয়াদ শেষ হয়। এর আগেই তাকে তৃতীয় মেয়াদে ১৮ মাসের জন্য নিয়োগ দেওয়ার আবেদন জানিয়ে বিওটি থেকে রাষ্ট্রপতির কাছে চিঠি দেওয়া হয়। রাষ্ট্রপতির কার্যালয় থেকে এটি অনুমোদন হয়ে আসছে না দেখে বিওটি স্বপ্রণোদিত হয়ে তাকে ১৮ মাসের জন্য উপাচার্যের চলতি দায়িত্ব দেয়।
অধ্যাপক আতিকুল ইসলাম গত রবিবার এক অফিস আদেশে লিখেন- ‘আমি ব্যক্তিগত কারণে ২৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ৭ মার্চ পর্যন্ত ছুটিতে থাকব। কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক আব্দুর রব খান আমার অনুপস্থিতিতে রুটিন জিনিসগুলো স্বাক্ষর করবেন।’ এই আদেশের নিচে তিনি স্বাক্ষর করেছেন ‘উপাচার্য ইনচার্জ’ হিসেবে। অনেকেরই যুক্তি, আইন অনুযায়ী বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ইনচার্জ’ নামে কোনো পদ নেই। যতক্ষণ না আচার্য কাউকে উপাচার্য ঘোষণা করছেন, উপাচার্যের অনুপস্থিতিতে উপ-উপাচার্য বা কোষাধ্যক্ষকে উপাচার্যের দায়িত্ব দেওয়া হবে। এর আগে ট্রাস্টি বোর্ড তিনজনের একটি প্যানেল রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠাবেন। রাষ্ট্রপতি সেখান থেকে একজনকে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ করবেন।
এনএসইউর বোর্ড অব ট্রাস্টিজ উপাচার্যের চলতি দায়িত্ব দিতে পারে কি না? এমন প্রশ্নের জবাবে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সদস্য অধ্যাপক ড. সাজ্জাদ হোসেন ভোরের কাগজকে বলেন, বোর্ড অব ট্রাস্টিজ এই দায়িত্ব দিতে পারে না এবং তাদের সেই ক্ষমতাও নেই। এছাড়া এটা লজিক্যালও নয়।
ইউজিসি অনিয়মের বিষয়টি খতিয়ে দেখছে উল্লেখ করে সাজ্জাদ হোসেন বলেন, আমাদের কমিশন বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে দুবারের বেশি কাউকে উপাচার্য করা স্পষ্টতই আইনের ব্যত্যয় হয়েছে। আমরা চাই প্রতিষ্ঠানটি আইন মেনে চলুক। বিশ্ববিদ্যালয় আরো যেসব প্রফেসর আছেন তাদের মধ্য থেকে কাউকে যোগ্য মনে হলে তাকে ভিসি করার প্রস্তাবনা দেয়া যেত।
অধ্যাপক আতিকুল ইসলাম ভিন দেশের নাগরিক। বিষয়টি সামনে নিয়ে এসে অধ্যাপক ড. সাজ্জাদ হোসেন বলেন, উনি (আতিকুল ইসলাম) বিদেশ থেকে এসেছেন, আবার বিদেশে চলে যাবেন। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, কেউ ভিসি হলে তাকে বাংলাদেশের নাগরিক হওয়া উচিত।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০১০-এর ৩১ (৬) ধারায় বলা হয়েছে ‘উপাচার্য কোনো কারণে তার দায়িত্ব পালনে অসমর্থ হলে, সংশ্লিষ্ট বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অস্থায়ীভাবে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করবেন। তবে সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে উপ-উপাচার্যের পদ শূন্য থাকলে কোষাধ্যক্ষ উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করিবেন।’ ১৬ (৯) ধারায় বোর্ড অব ট্রাস্টিজের ক্ষমতা ও দায়িত্ব অংশে বলা হয়েছে ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, উপ-উপাচার্য এবং কোষাধ্যক্ষ নিয়োগের জন্য যথাক্রমে, ধারা ৩১, ৩২ ও ৩৩-এর বিধান সাপেক্ষে আচার্য তথা রাষ্ট্রপতির কাছে প্রস্তাব পেশ করবেন।’
নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. আতিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে তদন্তে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)
এদিকে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. আতিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে গাড়ি ও জমি কেনার সময় অর্থ জালিয়াতির অভিযোগে নতুন করে তদন্ত শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে দুদক কর্মকর্তা আনোয়ারুল হককে। এর আগে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের কয়েকজন সদস্যের বিরুদ্ধে তদন্ত করে দুদক। সেসব অভিযোগ থেকে বর্তমান ভিসি আতিকুল ইসলামের নাম বাদ দিয়ে অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে একজন পুনরায় তদন্ত চেয়ে আবেদন করলে আবেদনের গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুদক।
ওই পুনরায় তদন্ত আবেদনে আরও উল্লেখ করা হয় যে, আতিকুল ইসলাম বর্তমানে ভিসি থাকলেও একই সঙ্গে তিনি ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যও। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনানুযায়ী ভিসি ট্রাস্টি বোর্ডে থাকতে পারবেন না। যা কিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৫ (৭) ধারা আইনানুযায়ী বেআইনি। আইনে আছে—ট্রাস্টিরা কোনও সুবিধা নিতে পারবেন না। কিন্তু উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছ থেকে বেতন নেন। চ্যান্সেলরের মাধ্যমে নিয়োগ পেয়েছেন। তিনি আবার ট্রাস্টিও। তিনি ট্রাস্টি বোর্ডের সকল মিটিংয়ে উপস্থিত থাকতেন। এর আগে যে সকল দুর্নীতির অভিযোগে ট্রাস্টি বোর্ডের অন্য সদস্যদের বিরুদ্ধে তদন্ত করা হয়েছিল সে সময় ভিসিও সম্পৃক্ত ছিলেন এবং সকল ট্রাস্টি মিটিংয়ে সিদ্ধান্তের সময় উপস্থিত থেকে সম্মতি দিয়েছেন। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে ১২টি গাড়ি কেনার সময় যে অর্থ জালিয়াতি হয়েছে, সেখানে তিনিও জড়িত রয়েছেন বলে অভিযোগপত্রে উল্লেখ রয়েছে।
এছাড়াও, ২০২২ সালে ট্রাস্টি বোর্ড সভার সম্মানী কমিয়ে ১০ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হলেও বোর্ড সদস্যরা আগের মত ৫০ হাজার টাকা সম্মানী নেন বলেও অভিযোগে উল্লেখ আছে। আগে নর্থ সাউথের একজন ট্রাস্টির সুপারিশে ৫ জন শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ ছিল এবং একজন ট্রাস্টি ৩ জন শিক্ষার্থীকে ফ্রি পড়াতে পারতেন। ২০২২ সালে নতুন ট্রাস্টি বোর্ড করার পরে সদস্যদের এ সুবিধাগুলো বন্ধ করে দেওয়ার ব্যাপারে বেশিরভাগ সদস্য একমত হলেও পরবর্তী সময়ে আবারো শিক্ষার্থী ভর্তি ও শিক্ষার্থীকে ফ্রি পড়ানোর নামে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগপত্রে জানানো হয়েছে।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে অধ্যাপক আতিকুল ইসলামের দুটি সেল নাম্বারে একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেও তিনি ফোন ধরেননি। এমনকি হোয়াটসঅ্যাপে তার সঙ্গে যোগাযোগ করেও পাওয়া যায়নি।
প্রসঙ্গত, বিভিন্ন সময়ে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থ ও অন্যান্য জালিয়াতির অভিযোগ প্রায় সময়ই উঠেছে। ২০২২ সালের অক্টোবরে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (এনএসইউ) সাবেক ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে দায়ের করা অর্থ পাচার মামলার চার্জশিট অনুমোদন দেয় দুদক। চার্জশিটে বলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন, শিক্ষা মন্ত্রণালয় অর্থাৎ সরকারের সুপারিশ বা অনুমোদনকে পাশ কাটিয়ে বোর্ড অব ট্রাস্টিজের কিছু সদস্যের অনুমোদন বা সম্মতির মাধ্যমে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস উন্নয়নের নামে ৯ হাজার ৯৬ দশমিক ৮৮ ডেসিমেল জমির ক্রয়মূল্য বাবদ ৩০৩ কোটি ৮২ লাখ ১৩ হাজার ৪৯৭ টাকা অতিরিক্ত অর্থ অপরাধজনকভাবে প্রদান বা গ্রহণ করেছে। অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিলের টাকা আত্মসাতের উদ্দেশ্যে কম দামে জমি কেনা সত্ত্বেও বেশি দাম দেখিয়ে প্রথমে বিক্রেতার নামে টাকা প্রদান করেন। পরবর্তীতে বিক্রেতার কাছ থেকে নিজেদের লোকের নামে নগদ চেকের মাধ্যমে টাকা উত্তোলন করে আবার নিজেদের নামে এফডিআর করে রাখেন। পরবর্তীতে আবার নিজেরা ওই এফডিআরের অর্থ উত্তোলন করে আত্মসাৎ করেন।
২০২১ সালের ডিসেম্বরে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ আদায়, এফডিআর করার নামে প্রতিষ্ঠানের অর্থ লোপাট, স্ত্রী স্বজনদের চাকরি দেওয়ার নামে অনৈতিকভাবে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়া, সরকারি শুল্ক ফাঁকি দিয়ে গাড়ি কেনা ও অবৈধভাবে বিলাসবহুল বাড়ির ব্যবহার এবং বিভিন্ন অনৈতিক সুযোগ সুবিধা নেওয়ার আড়ালে প্রতিষ্ঠানের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে নথি তলব করে দুদক। নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর বরাবর পাঠানো এক চিঠিতে অভিযোগ সংশ্লিষ্ট নথিপত্রে যাবতীয় অনুলিপি চাওয়া হয়। সর্বশেষ ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে শিক্ষার্থীদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ভিসি অধ্যাপক ড. আতিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে তদন্তে নেমেছে দুদক।