বিশ্বমানচিত্রের এক লৌহমানব

কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৪ আগস্ট ২০২০, ০৮:১৮ পিএম

জাতির পিতা
শোকাবহ আগস্ট১৯৩৮ সালের ১৬ জানুয়ারি। অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক এবং তার শ্রমমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী গোপালগঞ্জ পরিদর্শনে যান। তাদের আগমনে কৃষক-প্রজা পার্টি ও মুসলিম লীগ বিরাট সংবর্ধনার আয়োজন করে। মিশন স্কুল পরিদর্শন শেষে প্রধানমন্ত্রী শেরে বাংলা ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী যখন বাংলোতে ফিরে যাচ্ছিলেন তখন রোগা-পাতলা একটি বালক তাদের পথ আগলে দাঁড়ান। হতভম্ব সব ছাত্র ও শিক্ষক। প্রধান শিক্ষক বারবার ধমক দিচ্ছেন, কিন্তু জেদি, একরোখা, লিকলিকে ছেলেটি নাছোড়বান্দা। প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে দাবি আদায় না করে রাস্তা ছাড়বেন না বলে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। বাংলার বাঘ খ্যাত প্রধানমন্ত্রীও অবাক। এতটুকুন ছেলে, অথচ কি অসম সাহসী, যে কি না শেরে বাংলার পথ আগলে দাঁড়ায়! তবুও কণ্ঠে মাধুর্য্য এনে বললেন, ‘কী চাও তুমি খোকা?’ লিকলিকে বালকের সপ্রতিভ উত্তর, ‘আমাদের স্কুলের একমাত্র ছাত্রাবাসের ছাদ নষ্ট। পানি পড়ে টপটপ করে। ছাত্রদের বিছানাপত্র নষ্ট হয়ে যায়। এ কাজে প্রয়োজন মাত্র বারোশ টাকা। এটা সারাবার ব্যবস্থা না করে দিলে আমি পথ ছাড়বো না।’ অসম্ভব সাহসী, বিনয়ী আর পরোপকারী ছাত্রটির কথায় মুগ্ধ প্রধানমন্ত্রী সঙ্গে সঙ্গে সরকারি ত্রাণ তহবিল থেকে বারোশ টাকা মঞ্জুর করে দেন। সেদিনের সেই লিকলিকে হৃদয়বান বালকটিই বাংলার রাজনীতির মহানায়ক শেখ মুজিবুর রহমান। ছোটবেলা থেকেই বঙ্গবন্ধুর চরিত্রের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক ছিল- তার অসামান্য ব্যক্তিত্ব আর হিমালয়ের মতো দৃঢ় সাহস। তার কট্টর সমালোচকও তার সামনে সমালোচনা ভুলে গুণমুগ্ধে পরিণত হতেন। আইয়ুব-মোমেনশাহীর ক্ষমতার গদিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ১৯৬৬ সালের ৭ জুন ঘোষণা করেছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের বাঁচার দাবি- যা ইতিহাসের ম্যাগনাকার্টা নামে পরিচিত। শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষিত ছয়দফা দাবির পক্ষে দেশব্যাপী তীব্র গণআন্দোলনের সূচনা হয়। আওয়ামী লীগের ডাকা হরতালে টঙ্গী, ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে পুলিশ ও ইপিআরের গুলিতে মনু মিয়া, শফিক ও শামসুল হকসহ নিহত হন ১০ বাঙালি।
ইতিহাসের রাখাল রাজা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবঅন্যদিকে, ছয়দফা কর্মসূচি প্রকাশ হওয়ার পর পাকিস্তানি সরকার ও দক্ষিণপন্থী প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া শুরু হয়। কেউ কেউ এর অপব্যাখ্যা দিয়ে আওয়ামী লীগকে বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে চিহ্নিত করে জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে। কিন্তু বাংলার জনগণ এসব প্রতিক্রিয়াশীল ও অপব্যাখ্যাকারীকে প্রত্যাখ্যান করে। আইয়ুব খান ছয়দফার বিরুদ্ধে অস্ত্রের ভাষা ব্যবহারের হুমকি দেয়। তবুও অকুতোভয় শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ও নির্দেশে দলীয় কর্মীদের মাধ্যমে সারাদেশে প্রচারিত হয় সাধারণ মানুষের বাঁচার ছয়দফা দাবি। পাকিস্তানি সরকার ভীতসন্ত্রস্ত ও ক্ষিপ্ত হয়ে বঙ্গবন্ধু ও তার সহকর্মীদের গ্রেপ্তার করে। বিক্ষোভের আগুন ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। এই বিক্ষোভ বানচাল করার হীন ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠে পশ্চিমারা। পূর্ব পাকিস্তানের স্বার্থ ও প্রগতিবাদী আন্দোলনকে চিরতরে স্তব্ধ করে দেয়ার লক্ষ্যে শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রধান আসামি করে আরো ৩৪ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ এনে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা করা হয়। [caption id="attachment_235022" align="aligncenter" width="726"]

অতঃপর বাঘের সেই ঐতিহাসিক গর্জন, ‘ফয়েজ, বাংলাদেশে থাকতে হলে শেখ মুজিবের সাথেই কথা বলতে হবে।’ ...স্তম্ভিত কোর্ট, সমস্ত আইনজীবী ও দর্শকসহ সরকারি অফিসাররা তার এই সুষ্পষ্টভাবে উচ্চারিত কণ্ঠস্বর শুনতে পেলেন। প্রধান বিচারপতি একবার ডানদিকে ঘাড় বাঁকা করে শেখ মুজিব ও অন্যান্য অভিযুক্ত ব্যক্তির দিকে তাকালেন। কিছুই বললেন না। কোনো সতর্ক উচ্চারণ ছিল না। তিনি বোধহয় ভেবেছিলেন যে, শেখ মুজিব এমন কারাগার, ভয়ভীতি, শঙ্কা ও ট্রাইব্যুনালের বিচারের মধ্যেও শেখ মুজিবই রয়ে গেছেন।’ ফয়েজ আহমদ ‘আগরতলা মামলা, শেখ মুজিব ও বাংলার বিদ্রোহ’ গ্রন্থে (পৃষ্ঠা ১৭)।ওইসময় প্রথম সন্তান শেখ হাসিনার বিয়েতেও তাকে উপস্থিত থাকতে দেয়নি আইয়ুব সরকার। কন্যার বিয়েতেও পিতা থাকতে পারেননি, তবুও কন্যার বিয়ে হয়েছে অত্যন্ত সাদামাটাভাবে, তবে বিয়ের মিষ্টি এসেছিল আদালত কক্ষে। দৈনিক আজাদের ২৯ ডিসেম্বর ১৯৬৮ সালে প্রকাশিত সংবাদের ভাষ্য, ‘গত রবিবার রাত্রে শেখ মুজিবের প্রথমা কন্যার (শেখ হাসিনা) বিবাহ নিরানন্দময় পরিবেশে সম্পন্ন হইয়াছে। উক্ত বিবাহে শেখ ছাহেবকে উপস্থিত থাকিবার অনুমতিদানের প্রার্থনা করিয়া প্যারোলে মুক্তির আবেদন করা হইয়াছিল। শেখ ছাহেব উক্ত বিবাহে উপস্থিত ছিলেন না।’ রিপোর্টের বাক্য গঠনের কৌশল থেকেই বুঝা যায়, জালিম সরকার কন্যার বিয়েতে উপস্থিত থাকার অনুমতি দেয় নি। অবশ্য খুব বেশিদিন তাকে আটকে রাখতে পারেনি আইয়ুব সরকার। ‘জেলের তালা ভাঙব/ শেখ মুজিবকে আনব’ স্লোগানে প্রকম্পিত হয় পুরো বাংলা। ফুঁসে ওঠা জনগণের আন্দোলনের তোড়ে শেষ পর্যন্ত মামলাই উঠিয়ে নিতে বাধ্য হয় পাকিস্তান সরকার। শুধু তাই নয়, জেনারেল আইয়ুব খান ও তার দোসর মোনায়েম খানকে জানুয়ারিতেই (১৯৬৯) অত্যন্ত অপমানজনকভাবে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে হয়। রয়েল বেঙ্গল টাইগারের গর্জনের কাছে লেজ গুটিয়ে পালাতে হয় লৌহমানব খ্যাত আইয়ুব খানকে। [caption id="attachment_221999" align="aligncenter" width="700"]

বর্বর পাকিস্তানিদের কারাগারে নয়মাস মৃত্যুর প্রহর গুনেছেন তবুও মাথানত করেননি বঙ্গবন্ধু। চোখের সামনে কবর খোঁড়া হচ্ছে দেখেও মৃত্যুঞ্জয়ী মুজিবের দৃঢ় উচ্চারণ, ‘আমি প্রথমত বাঙালি, দ্বিতীয়ত মুসলমান। আমরা একবারই মরি, বারবার নয়। বাঙালি মুসলমানরা আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে ভয় পায় না।’ বিজয়ের পর ১৯৭২ সালের ৯ জানুয়ারি ব্রিটিশ সংবাদপত্র দ্য সানডে টেলিগ্রাফে ‘শেখ মুজিব ফ্লাইস ইন এন্ড সিজ হিথ, প্লিয়া ফর এইড’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানের কারাগারে ফাঁসি কার্যকর করা থেকে রক্ষা করতে একজন জেলার দু’দিন তার ব্যক্তিগত এ্যাপার্টমেন্টে তাকে লুকিয়ে রেখেছিলেন।গতরাতে লন্ডনে একজন বাংলাদেশি কর্মকর্তা বলেছেন, শেখ মুজিব জেলারের সহায়তায় মৃত্যুদণ্ডাদেশ থেকে রক্ষা পেয়েছেন। জেলার জানতেন, ইয়াহিয়া খান তাকে বাঁচতে দেবে না। এ জন্য তিনি ঝুঁকি নিয়ে দু’দিন তার বাসায় শেখ মুজিবকে লুকিয়ে রাখেন। খবরে আরো বলা হয়, কারাগারে শেখ মুজিবের সেলের পাশে একটি কবর খোঁড়া হয়েছে। ইয়াহিয়া খানের এক্সিকিউশন স্কোয়াড ভূয়া কাগজপত্র নিয়ে এসেছিল। এতে বলা হয়েছিল অক্টোবরের শেষের দিকে শেখ মুজিবকে ফাঁসি দেয়া হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর উদ্ধৃতি দিয়ে রিপোর্টে বলা হয়, আমি মরতে প্রস্তুত ছিলাম। আমি কারাগারে গিয়েছিলাম। আমি জানতাম না সেখানে আমার কী হবে, আমি বাঁচবো না মরবো? তবে, আমি জানতাম, বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই। গোপালগঞ্জের স্রোতস্বিনী বাইগার আর হিজল-তমালের স্নেহের ছায়ার রাখাল রাজা খোকা। স্বৈরশাসক আইয়ুব খেদানোর পর তিনি হয়ে ওঠেন সাড়ে সাত কোটি বাঙালির নয়নের মণি। ঊনসত্তরের গণঅভ্যূত্থানের উত্তাল দিনে মুজিব তখন বঙ্গবন্ধু। সুন্দরবন আর বঙ্গোপসাগরের গর্জে ওঠা ঊর্মিমালা পেরিয়ে তার নাম ছড়িয়ে পড়ে সাড়ে সাতশ কোটি মানুষের হৃদয়ে। শোষিত প্রাণে জাগে মুক্তির দোলা। বাংলার অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান পরিণত হন এশিয়ার, বিশ্বের মানচিত্রে এক লৌহমানবে। একাত্তরের অগ্নিঝরা মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের পর বিশ্ববাসীর দৃষ্টি কাড়ে বাংলাদেশ। আর বঙ্গবন্ধু পরিণত হন স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতীক রূপে। আরো পড়ুন-