অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য দরকার রাজনৈতিক সমঝোতা

কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৭ এপ্রিল ২০২৩, ০৮:৪৭ এএম

ছবি: বিবিসি
অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ রাজনৈতিক সংকট- সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়ালের এমন বক্তব্যে রাজনৈতিক সমঝোতাকেই সমাধান হিসেবে দেখছেন রাজনীতিবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, বিগত দুটি সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হলেও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হয়নি। এর প্রধান কারণ ছিল রাজনৈতিক সমাঝোতার অভাব। যে কারণে জ্বালাও-পোড়াও, অগ্নিসন্ত্রাসের রাজনীতি জনগণ ও রাষ্ট্রের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। বহির্বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছে। নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক হবে বলে একাধিকবার মন্তব্য করেছেন সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা। যদিও নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ছাড়া নির্বাচনে যাবে না বলে সাফ জানিয়েছে সাবেক বিরোধী দল বিএনপি।
একই দাবিতে দেশব্যাপী নানা কর্মসূচিও পালন করছে দলটি। সিইসির বক্তব্য নিয়েও প্রকাশ্যে কোনো কথা বলতে রাজি হননি বিএনপি নেতারা। তবে সিইসির বক্তব্য প্রকারান্তরে তাদের পক্ষেই গেছে এমন মনোভাব তাদের। যদিও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ক্ষেত্রে তেমন চ্যালেঞ্জ দেখছে না ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। বিএনপি নির্বাচনে আসবে- এ ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েই ভোটের মাঠ গোছাচ্ছে তারা।
সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, ইভিএম বা ব্যালট কিন্তু আমাদের নির্বাচনের মোটেই বড় চ্যালেঞ্জ নয়। আমাদের নির্বাচনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, যে রাজনৈতিক সংকট বিরাজ করছে, প্রধান দলগুলো অংশগ্রহণ করবে কি করবে না, সেটা হচ্ছে অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। আমরা প্রথম থেকে বলেছি সব দল নির্বাচনে অংশ নিক। সে লক্ষ্যে আমাদের প্রয়াস শেষ পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। সংকট সরকারের সঙ্গে দলগুলোর হয়ে থাকে। বা সরকারি দলের সঙ্গে রাজনৈতিক দলের হয়ে থাকে। আমরা বলব রাজনৈতিক সেই সংকটগুলো আপনারাই নিরসন করে নির্বাচনকে সহজ এবং নির্বাচন কমিশনের জন্য অনুকূল করে দিন।
‘মাথাব্যথা’ নেই বিএনপির
বিএনপি এরই মধ্যে জানিয়ে দিয়েছে তারা এই কমিশনের অধীনে নির্বাচনে যাবে না। তাই নির্বাচন কমিশন নিয়েও তাদের ভাবনা নেই। নিরপেক্ষ এবং নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন চান
তারা। তবে সিইসির গতকালের বক্তব্যে খুশি বিএনপির নেতাকর্মীরা। যদিও এ ব্যাপারে প্রকাশ্যে কথা বলতে রাজি হননি কেউ। নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির একজন সাংগঠনিক সম্পাদক ভোরের কাগজকে বলেন, সিইসির এই বক্তব্যেই প্রমাণিত হয়, দেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ নেই। সিইসি স্বীকার করেছেন, দেশে রাজনৈতিক সংকট রয়েছে। নির্দলীয় সরকার ছাড়া এই সংকট কাটবে না।
এদিকে রাজনৈতিক সংকট সমাধানে ইসির নসিহত নিয়ে কথা বলতে চান না বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এ বিষয়ে মতামত দিতে অনাগ্রহ প্রকাশ করে মির্জা ফখরুল বলেন, এটার দায় সম্পূর্ণ সরকারের। এর দায় নিয়ে তাদের পদত্যাগ করা উচিত, এটা আমি আগেও বলেছি।
‘চ্যালেঞ্জ’ দেখছে না আওয়ামী লীগ
সিইসির এমন বক্তব্য আর বিএনপির আস্ফালনে পাত্তা দিচ্ছে না ক্ষমতাসীনরা। দলীয় সূত্র জানিয়েছে, বিএনপি নির্বাচনে আসবে- এটি নিশ্চিত বলে মনে করে আওয়ামী লীগ। এছাড়া আওয়ামী লীগ রাজপথে আধিপত্য বিস্তারে বিএনপির আন্দোলনের পাল্টা কর্মসূচি দিলেও নির্বাচনে অংশ নেয়া নিশ্চিত করতে বিরোধী দলের সঙ্গে পর্দার আড়ালে আলোচনা করার কথা বিবেচনা করছে। দলটির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য এডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক ভোরের কাগজকে বলেন, নির্বাচনকে সামনে রেখে সিইসি যথার্থ বলেছেন। আওয়ামী লীগ সব সময় নির্বাচনমুখী দল। কিন্তু বিএনপি সব সময় নির্বাচন ভণ্ডুল করতে চায়। নির্বাচন ভণ্ডুলে তাদের অগ্নিসন্ত্রাসের দিনগুলো জনগণ ভুলে যায়নি।
তিনি বলেন, সব দলকে নির্বাচনে নিয়ে আসার চেষ্টা করবে ইসি। এটি তাদের দায়িত্ব। তারা যদি এটি না করে তাহলে তারা ব্যর্থ হবে। সব দলকে নির্বাচনে আনার উদ্যোগ ইসিকেই নিতে হবে। ইসি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান, সরকার ইসির ওপর কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করবে না। আর আওয়ামী লীগ সব সময় অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চায়।
দলটির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম ভোরের কাগজকে বলেন, সিইসির এমন বক্তব্যে আমরা কোনো চ্যালেঞ্জ দেখছি না। সব দল নির্বাচনে অংশ নেবে, এটি আমাদের বিশ্বাস। বিএনপি যতই লাফালাফি করুক নির্বাচনে ঠিকই আসবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একাধিকবার বলেছেন সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন হবে। এজন্য প্রস্তুতি নিতে তিনি নির্দেশ দিয়েছেন, সে অনুযায়ী সবাই কাজ করছে।
রাজনৈতিক সমঝোতাই সমাধান
সাম্প্রপ্তিক মাসগুলোতে পশ্চিমা দেশ, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জাপান ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচন বিষয়ে সমালোচনামূলক মন্তব্য করেছে এবং সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের তাগিদ দিয়েছে। সব দলকে নির্বাচনে আনা বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাও। এ দলগুলোর আস্থা অর্জনে কমিশনকে আইন অনুযায়ী ক্ষমতা প্রয়োগ করতে হবে বলেও মনে করেন তারা। তবে ঘরে বাইরে চাপের চেয়েও উন্নয়ন তুলে ধরতে পারলে এই ধারাবাহিকতা রক্ষায় সুষ্ঠু নির্বাচনেও বিপুল ভোটে নৌকা জিতবে- এমন আশাবাদী শেখ হাসিনা। এজন্য সব দলের অংশগ্রহণেই নির্বাচন চান তিনি- এমনটা বলছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতারা। এক্ষেত্রে বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে কিছুটা ছাড় দেয়া হবে বলেও জানিয়েছেন তারা।
এদিকে বিশ্লেষকরা বলছেন, সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন না হলে পুরো নির্বাচন ব্যবস্থাই প্রশ্নবিদ্ধ হবে। সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ টি এম শামসুল হুদা বলেন, এবারের নির্বাচনে সব দল যদি না আসে, তাহলে এটা গ্রহণযোগ্য হবে না। সুতরাং ইসি কীভাবে আনবে, কী অফার করবে, তার ওপর নির্ভর করবে। আমার সময়ও ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি ওয়াজ প্রবলেমেটিক (সমস্যা ছিল)। তাদের আনতে অনেক সময় ব্যয় করতে হয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান ভোরের কাগজকে বলেন, সমঝোতা ইসি কিংবা সিইসির পক্ষে সম্ভব নয়। রাজনৈতিক দলগুলোর সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করে। তারা কে কাকে কতটুকু ছাড় দেবে তার ওপর নির্ভর করে। তাদের মধ্যে সমঝোতা করেই নির্বাচনে আসতে হবে।
সুজন (সুশাসনের জন্য নাগরিক) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার ভোরের কাগজকে বলেন, সব দলের সমঝোতা হলেই এই সংকট কাটানো সম্ভব। দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন অসম্ভব। গত নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হয়েছে কিন্তু প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হয়নি।