চার বছরেও হয়নি বিধিমালা

কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২২ অক্টোবর ২০২২, ০৮:৩২ এএম

প্রতীকী ছবি
সড়কে থামছে না নৈরাজ্য, সড়ক পরিবহন আইন পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের তাগিদ
চার বছরেও সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ এর বিধিমালা প্রণীত হয়নি। আইনের কিছু কিছু ধারা আংশিক বাস্তবায়ন করা হলেও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন না হওয়ায় সড়কের সার্বিক অবস্থার এখনো কোনো পরিবর্তন হয়নি। এখনো সড়কে দুর্ঘটনা, প্রাণহানি, নৈরাজ্য, হয়রানিসহ নানান অব্যবস্থাপনা অব্যাহত রয়েছে। এসব কারণে ২০১৮ সালে নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের নজিরবিহীন আন্দোলনের সুফল ও সড়ক নিরাপত্তা ব্যবস্থা এখনো অধরা রয়ে গেছে। এই বাস্তবতার মধ্যেই পালিত হচ্ছে ‘জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস ২০২২’।
নিরাপদ সড়কের দাবিতে ২০১৭ সালে রাস্তায় নেমে শিক্ষার্থীদের ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ স্লোগান এখন অনেকেই ভুলে গেছেন। অথচ ওই স্লোগানের দাপটেই সড়ক স্তব্ধ হয়েছিল। সরকার সড়ক আইন নতুন করে পাস করেছিল। কিন্তু এর সুফল এখনো পাওয়া যায়নি। সড়ক, মহাসড়ক ও যানবাহনে আজো শৃঙ্খলা ফেরেনি। জাতিসংঘ সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম যে ৫ কারণ চিহ্নিত করেছে এরমধ্যে সড়ক নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা, ঝুঁকিমুক্ত যানবাহন, সড়ক ব্যবহারে সচেতনতা অন্যতম। ৫টি ঝুঁকিপূর্ণ বিষয় হচ্ছে গতি, হেলমেট, সিটবেল্ট, মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি না চালানো ও শিশু আসন সংরক্ষণ করা। এগুলোর কোনোটিই পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন হয়নি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, বিশ্বে প্রতি বছর ১০ লাখ ৩৫ হাজার মানুষ দুর্ঘটনায় মারা যায়। ৫০ লাখ মানুষ পঙ্গুত্ব বরণ করে। এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ২৫ হাজার মানুষ মারা যায়। জাতিসংঘ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ২০৩০ সালের মধ্যে মৃত্যুহার ৫০ শতাংশে কমিয়ে আনতে প্রতিটি দেশকে তাগিদ দিয়েছে। অথচ এখানে বাংলাদেশ পিছিয়ে আছে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) এক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের হিসাব বলছে, গত ৩ বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১ লাখ ৯ হাজার কোটি টাকা। কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা যদি নির্ভরশীল মানুষের তুলনায় বেশি হয়, তাকে জনসংখ্যা বোনাস বা ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বলা হয়। বাংলাদেশ এ ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের জন্য গর্ব করে। কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনা এই গর্বের জায়গাতেই বেশি আঘাত হানছে।
সড়ক যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. শামছুল হক বলেন, সড়ক পরিবহন আইন পুরোপুরি এবং কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। যেসব দুর্ঘটনা ঘটছে তা আমাদের নিজেদের তৈরি। যারা সড়ক ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে আছেন, তাদের আন্তরিকতার অভাবেই সড়কে শৃঙ্খলা ফিরছে না। পুরনো সড়ক ব্যবস্থাপনা বহাল রেখে শৃঙ্খলা ফেরানো যায় না। সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে বিআরটিএর অনেক দায়িত্ব রয়েছে। চালকদের উচ্চতমানের প্রশিক্ষণ দেয়া, লাইসেন্স দেয়া, গাড়ির ফিটনেস দেয়ার ক্ষেত্রে বিআরটিএ’র অনেক দায়িত্ব রয়েছে। তাদের আরো বেশি সচেতন হতে হবে। চালকরা আরো দক্ষ ও প্রশিৃিক্ষত না হলে দুর্ঘটনা আরো বাড়বে।
‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলনের চেয়ারম্যান ও চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, নিরাপদ সড়কের দাবিতে আমরা গত ২৯ বছর ধরে আন্দোলন করে আসছি। সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ আইন হয়েছে। আইনটি পাস হওয়ার পর দেশের জনগণের মধ্যে স্বস্তি ফিরে আসে। কিন্তু দুঃখের বিষয় ৪ বছরেও বিধিমালা প্রণীত হয়নি। যার ফলে আইনটি অকার্যকর হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ কেউই আইনের বাস্তবায়নে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারছে না। আমরা বিধিমালা চূড়ান্ত করতে এবং তা দ্রুত অনুমোদনের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে স্মারকলিপি দিয়েছি। রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া সড়ক আইনের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন সম্ভব না বলেই মনে হচ্ছে।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান বলেন, দীর্ঘ প্রতীক্ষিত ‘সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮’ পাস হওয়ার প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। অদ্যাবধি আইনটির পুরোপুরি বাস্তবায়ন না হওয়া জাতির জন্য দুঃখজনক। আইন পুরোপুরি বাস্তবায়নে সরকার এবং রাষ্ট্রের সদিচ্ছার অভাব দৃশ্যমান বলেই আমরা মনে করি। ১১১টি সুপারিশ বাস্তবায়ন করা হলেই সড়ক নিরাপদ হবে।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, সড়ক আইনের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের জন্য আমরা বার বার সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে আসছি। কিন্তু আইন পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি। দুর্ঘটনায় প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি কমাতে জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিল কার্যকর করতে হবে। সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ অনুযায়ী সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তির পরিবারকে ৫ লাখ টাকা ও আহত ব্যক্তিকে ৩ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়ার বিধান রয়েছে। কিন্তু আইন প্রণয়নের ৪ বছর পরও ক্ষতিপূরণ দেয়ার কার্যক্রম শুরু হয়নি। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের হিসাবে, সড়ক দুর্ঘটনায় একজন কর্মক্ষম ব্যক্তি প্রাণ হারানোর কারণে ২৪ লাখ ৬২ হাজার ১০৬ টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়। সেই হিসেবে প্রত্যেক নিহত ব্যক্তির পরিবার এই পরিমাণ অর্থ রাষ্ট্রের কাছে প্রাপ্য।
ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম বলেন, রাজধানীর সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে ট্রাফিক পুলিশ সাধ্যমত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। রাজধানীর সড়ক ব্যবস্থাপনার জন্য সবচেয়ে আগে পুলিশকে দায়ী করা হয়। কিন্তু সবাইকে বাস্তবতা বুঝতে হবে। পুলিশের একার পক্ষে সব শৃঙ্খলা ফেরানো সম্ভব না। আইন মানার মানসিকতা নগরবাসীর মধ্যে গড়ে তুলতে হবে। যাত্রী, চালক, পথচারী সবাইকে সচেতন হতে হবে।
পুলিশের তথ্যভাণ্ডার বিশ্লেষণ করে বুয়েটের এক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট বলছে, গত এক দশকে দেশের সড়ক-মহাসড়কে দুর্ঘটনায় নিহতদের ৫৪ শতাংশের বয়স ১৬ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে। আইনে থাকার পরও সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতদের আর্থিক সহায়তা কার্যক্রম চালু হয়নি। জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলের কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই। ৬২ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান কারণ হচ্ছে চালকদের বেপরোয়া আচরণ ও অনিয়ন্ত্রিত গতি। এছাড়া অপরিকল্পিতি সড়ক ব্যবস্থাপনা, চালকদের অদক্ষতা, দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, সরকারি সংস্থা বিআরটিএর সক্ষমতার ঘাটতির কারণেও সড়কে শৃঙ্খলা ফিরছে না।