অক্টোবরের সেই স্মৃতি কুঁড়ে কুঁড়ে খায় আজো

কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১৫ অক্টোবর ২০২২, ০৯:৩৩ এএম
‘আমরা তন্ময় হয়ে টিভিতে নাটক দেখছিলাম। নাটকটির নাম শুকতারা। হঠাৎ করে একটা বিকট শব্দ। ওপর থেকে ছাদটা ধসে পড়ছে। কিছুক্ষণ পর চোখ বন্ধ করেছিলাম। এরপরে কতক্ষণ আমার জ্ঞান হারিয়ে ছিলাম মনে নাই। জ্ঞান ফিরে পেলে দেখি আমি রডের সঙ্গে গেঁথে আছি। আমি শত চেষ্টাতেও আমার শরীরটাকে কোনোভাবে নাড়াতে পারছি না। তখন পরিবার পরিজন, বিশেষ করে বাবা মার কথা মনে হচ্ছিল। বারবার মনে হচ্ছিল, আমি বোধ হয় আর বাঁচতে পারব না। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে এত কম বয়সে আমাকে এভাবে মারা যেতে হচ্ছে এরকম একটা অনুভূতি কাজ করছিল। সেই ঘটনার স্মৃতি আজো কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে আমাকে।’- এভাবেই স্মৃতিচারণ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল ট্র্যাজেডিতে বেঁচে যাওয়া তৎকালীন ভূতত্ত্ব বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী ও বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) প্রবীর কুমার সরকার।
তিনি বলেন, ১৫ অক্টোবর এলে আমি বিশেষভাবে তাড়িত হই। যে সব মেধাবী শিক্ষার্থীকে তাদের পরিবার হারিয়েছে সেসব কথা মাথায় এলে চাপা কষ্ট উথলিয়ে ওঠে। পরে টিভি দেখতে যেতেই ভয় পেতাম। ঘরের মধ্যেও টিভি দেখলে মনে হয় কোনো দুর্ঘটনা ঘটল কিনা! প্রবীর কুমার সরকারের মতোই সেদিন আরো শতাধিক শিক্ষার্থী ভাগ্যের জোরে বেঁচে যান। তবে ভুলতে পারেন না করুণ সেই ঘটনার স্মৃতি।
কী ঘটেছিল সেদিন
১৯৮৫ সালের ১৫ অক্টোবর, সেদিন ছিল মঙ্গলবার। বাংলাদেশ টেলিভিশনে সে সময় ধারাবাহিক নাটক শুকতারা প্রচার করা হত, ছাত্রদের কাছে নাটকটি খুব জনপ্রিয় ছিল।
হলের সে সময়কার ছাত্র ও কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এ হলের মূল আকর্ষণ ছিল রঙিন টেলিভিশন। এ ছাড়াও শুকতারা নাটকটি ঘিরে ছাত্রদের মাঝে বেশ আগ্রহ ছিল। সেদিন গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল। হলের তৎকালীন অনুদ্বৈপায়ন ভবনের টেলিভিশন কক্ষে রাত সাড়ে ৮টায় শুরু হয় নাটক ‘শুকতার’। অনুদ্বৈপায়ন ভবনটি জরাজীর্ণ হওয়ায় সংস্কারের কাজ চলছিল সে সময়। ভবনটির ছাদের ওপরে টিনের চালা ছিল একটি। সংস্কারের কারণে ছাদের ওপরের টিন সরানো হয় সপ্তাহ খানেক আগে। অক্টোবরের গুড়ি গুড়ি বৃষ্টিতে প্রতিনিয়ত ভিজতে ভিজতে জরাজীর্ণ ছাদটি আর সহ্য করতে পারেনি। ঠিক ১৫ অক্টোবর যে সময় ছাত্ররা নাটকটি উপভোগ করছিল সে সময় হঠাৎ করেই তাদের মাথার ওপরে পড়ে যায়। সে সময় ভেতরে টিভি দেখছিলেন দুই শতাধিক ছাত্র।
বিকট শব্দে বাকি ছাত্র ও কর্মচারীরা সেখানে গিয়ে উদ্ধার তৎপরতা শুরু করেন। একদিকে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি অন্যদিকে বিদ্যুৎ না থাকায় সেদিন অনেক কষ্ট করতে হয় উদ্ধারকারীদের। এরপর উদ্ধার কাজে যুক্ত হয় ফায়ার ব্রিগেড, ক্রেন ও এম্বুলেন্স। ফায়ার ব্রিগেড আর এম্বুলেন্সের শব্দে ঢাকা শহরের সকল ধর্ম-বর্ণ ও শ্রেণি-পেশার মানুষ দ্রুত ছুটে আসে ঘটনাস্থলে। ঘটনাস্থল থেকে মরদেহগুলো উদ্ধার করে হলের
শহীদ মিনারের সামনে এনে রাখা হয়। স্বজনদের আহাজারিতে হলের বাতাস ভারি ও স্তব্ধ হয়ে যায় সেদিন। আর আহতদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, পিজি হাসপাতালের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়। এ সময় ভ্যান ও রিকশাচালকেরা বিনা টাকায় ও স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে আহতদের হাসপাতালে নিয়ে যান।
ঘটনাস্থলেই সেদিন ৩৫ জন শিক্ষার্থী মৃত্যুবরণ করেন। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরো ৫ জন মারা যান। মোট ৪০ জন ছাত্র, কর্মচারী ও অতিথি এই ঘটনায় মারা যান। মৃতদেহগুলো পরদিন বিকাল নাগাদ যার যার গ্রামের বাড়িতে পাঠানো হয়। আহত হন শতাধিক।

সেদিনের ঘটনার আরেকজন সাক্ষী হলের বর্তমান প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. মিহির লাল সাহা। সেসময় তিনি স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী ছিলেন। ঘটনার স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, দুর্ঘটনার দিন রাতে আমারও টিভি কক্ষে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু পরীক্ষার কারণে যেতে পারিনি। রাতে বিকট শব্দে ছাদ ধসে পড়লে চিৎকার-চেঁচামেচিতে সেখানে যাই। এতগুলো মানুষের মরদেহ আর আহতদের দেখে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম। রাতের বৈরী আবহাওয়ায় ছাদ ভেঙে পড়া টিভি কক্ষের ভেতরে উদ্ধার কাজ পরিচালনা করা দুঃসাধ্য হলেও চেষ্টার কোনো ঘাটতি ছিল না। তবুও এ ঘটনায় রক্ষা করা যায়নি ৪০টি তাজা প্রাণ। যার মধ্যে ছিলেন ২৬ জন বিভিন্ন বিভাগের আবাসিক এবং ভর্তি হতে আসা শিক্ষার্থী, ১৪ জন কর্মচারী এবং অতিথি।
তৎকালীন উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের প্রথমবর্ষের শিক্ষার্থী শিবনারায়ণ দাশের স্মৃতিকে স্মরণ করে অধ্যাপক ড. মিহির লাল বলেন, মেধাবী ছাত্র শিবনারায়ণ দাশের নিথর দেহ দেখে আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি। পড়ালেখার কারণে সে প্রায়ই আমার রুমে আসত। নাটক দেখতে গিয়ে নিমিষেই নিভে গেল তার সফল উদ্ভিদবিজ্ঞানী হওয়ার সেই লালিত স্বপ্ন! শিবনারায়ণের স্বপ্ন এমনভাবে ভেঙে যাবে আমি ভাবতেই পারিনি। জানি না তার পরিবারের লোকজন এখন কেমন আছে।
হলের পরিচ্ছন্নতাকর্মী মতিলাল দাস বলেন, সেদিন আমাকে নির্মল চন্দ্র নাটক দেখার জন্য সিট রাখতে বলে। নির্মল হলের কর্মচারী ছিল। আমি তার জন্য সিট রাখি। আমি একটা কাজে হলের বাইরে গেলে সে নির্ধারিত সিটে বসে নাটক দেখে এবং ছাদ চাপা পড়ে মারা যায়। এরপর থেকে হলে সবার মধ্যে একটা উদাসীন ভাব কাজ করত। নিহতদের আত্মীয়-স্বজনের আহাজারিতে হলের পরিবেশ ভারী হয়ে থাকত। পুরো ক্যাম্পাস নিঃস্তব্ধ। দু’তিন দিন ডাইনিংয়ে রান্না হয়নি। সেই করুণ স্মৃতি আমি আজো ভুলতে পারিনি।
শুকতারা
মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ধারাবাহিক নাটক ছিল ‘শুকতারা’। এর প্রযোজক ছিলেন রোকেয়া পদকে ভূষিত বিশিষ্ট নাট্যকার বেগম মমতাজ হোসেন। প্রতি মঙ্গলবার রাত সাড়ে ৮টায় নাটকটি প্রচারিত হত। প্রতিটি পর্ব ছিল ৬০ মিনিটের। এই নাটকে অভিনয় করেছিলেন জগন্নাথ হলের ছাত্র তখনকার উদীয়মান সংগীতশিল্পী শুভ্র দেব। তার কারণইে জগন্নাথ হলের শিক্ষার্থীদের শুকতারা নাটকটি দেখার আগ্রহ একটু বেশিই ছিল।
স্মৃতি রক্ষার্থে নেয়া পদক্ষেপ
জগন্নাথ হলের বিভীষীকাময় এই ঘটনায় তখন ৩ দিন জাতীয় শোক ঘোষণা করে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রেখে ১৬ অক্টোবর সারাদেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এ ঘটনার পর থেকেই দিনটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শোক দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। এছাড়াও এই ঘটনায় নিহতদের স্মৃতি রক্ষার্থে পরবর্তী সময়ে ঘটনাস্থলে নির্মিত হয় ‘অক্টোবর স্মৃতিভবন’। তাদের স্মরণে অক্টোবর ভবনের নিচতলায় একটি ছোট জাদুঘর আছে। সেদিনের সেই টিভি রাখা আছে এই জাদুঘরে। মৃত্যুবরণ করা বেশ কয়েকজনের ছবিও আছে সেখানে। এ ছাড়া ভবনটির সামনে নিহতদের স্মরণে তাদের নাম সংবলিত একটি নামফলক স্থাপন করা হয়েছে। নামফলকের নিচে টিভি কক্ষের সিঁড়িটিকে আজো সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে। এবং টিভি কক্ষের স্থানে একটি সাদা রংয়ের শহীদ মিনার স্থাপন করা হয়েছে।
তবে বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সার্বিকভাবে সব বিষয়ে ওয়াকিবহাল আছে উল্লেখ করে রেজিস্ট্রার প্রবীর কুমার সরকার বলেন, আমরা জরাজীর্ণ ভবন কোথায় আছে সেগুলো দেখভাল করছি, যেন দুর্ঘটনা না ঘটে। আমি আশাবাদ ব্যক্ত করব বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ধরনের দুর্ঘটনা যেন না ঘটে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেন, জগন্নাথ হল ট্র্যাজেডি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক করুণ অধ্যায়। প্রত্যেক দায়িত্বশীল ব্যক্তি যদি তার নিজ জায়গা থেকে অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও নিজ দায়িত্ব পালনে সোচ্চার হতেন তবে এ ধরনের ঘটনা অনেকাংশেই কমে যেত। আমরা এই ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে যেসব জরাজীর্ণ ভবন আছে সেগুলোর বড় রকমের সংস্কার এবং যেগুলো অপসারণ করার মতো সেগুলোর জন্য সেরকম ব্যবস্থা নিয়ে এগোচ্ছি। যেন জগন্নাথ হলের মতো কোনো ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে।