রাতের অরক্ষিত সড়কে যত্রতত্র তোলা হয় যাত্রী

কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৬ আগস্ট ২০২২, ০৮:৩৮ এএম

ফাইল ছবি
রাতে সড়ক-মহাসড়ক অনেকটাই অরক্ষিত হয়ে পড়ে। বন্ধ আছে হাইওয়ে পুলিশের চেকপোস্ট। মহাসড়কগুলোতে প্যাট্রলিং (টহল) থাকলেও এর কার্যকারিতা নিয়ে উঠছে প্রশ্ন। নৈশকোচ চালক, হেলপার ও সুপারভাইজাররা কাউন্টার ছাড়াই ইচ্ছেমতো যত্রতত্র যাত্রী তোলেন ও নামান। টার্মিনাল থেকে কোচ ছাড়ার আগে যাত্রীদের ভিডিও করার কথা থাকলেও তা করা হচ্ছে না। এতে সড়ক-মহাসড়কে বেড়েছে বাস ডাকাতির ঘটনা। দুর্ধর্ষ ডাকাতরা বাসের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে রাস্তায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা চক্কর দিয়ে ডাকাতি করলেও পুলিশ টের পাচ্ছে না। কোনো ঘটনায় বাসের নারী যাত্রীরা প্রতিবাদ করলে তারা সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন। গত কয়েক বছরের বাস ডাকাতির ঘটনা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, অধিকাংশ ঘটনায় ডাকাতরা টাঙ্গাইল থেকে উঠেছে বা এই পথকে নিরাপদ ভেবে ডাকাতি করেছে। সর্বশেষ কুষ্টিয়ার দৌলতপুর থেকে গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় নারায়ণগঞ্জের উদ্দেশে ছাড়া ঈগল পরিবহনের বাসে টাঙ্গাইলে ডাকাতি ও সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনায় দেশজুড়ে তোলপাড় চলছে।
এ প্রসঙ্গে পুলিশ সদর দপ্তরের ডিআইজি (অপারেশন্স) হায়দার আলী খান বলেছেন, যাত্রী নিরাপত্তার দায়িত্ব বাস মালিক ও শ্রমিকদের। মালিক চাইলে বাসের ভেতরে সিসিটিভি লাগাতে পারেন। কাউন্টার ছাড়া পথে যাত্রী তুললে পুলিশের করার কিছু থাকে না। এজন্য মালিক ও শ্রমিক ইউনিয়নকে বলা হয়েছে আগেই। পথে যাত্রী তুললে কাউন্টারে ভিডিও করেও লাভ নেই। এজন্য সবাইকে সতর্ক হতে হবে। তিনি বলেন, হাইওয়েতে যাত্রী ও পরিবহনের নিরাপত্তায় পুলিশকে সতর্ক থাকতে সব সময় নির্দেশনা দেয়া থাকে। চেকপোস্ট ও প্যাট্রলিং (টহল) প্রসঙ্গে কথা বলতে হাইওয়ে পুলিশের প্রধান, অতিরিক্ত আইজিপি মল্লিক ফখরুল ইসলামের মোবাইল ফোনে একাধিকবার চেষ্টা করেও সাড়া পাওয়া যায়নি। ডিআইজি আতিকা ইসলাম এনডিসি কোর্সের ট্রেনিংয়ে থাকায় মন্তব্য করেননি। অতিরিক্ত ডিআইজি মিজানুর রহমান বলেছেন, হাইওয়েতে টহল আছে, তারা কাজ করছে। গাজীপুর হাইওয়ে পুলিশের অতিরিক্ত সুপার নাজমুস সাকিব খান বলেছেন, রাস্তায় চেকপোস্ট বসানো আপাতত বন্ধ রয়েছে। কত দিন ধরে বন্ধ রয়েছে তার সঠিক তথ্য তার জানা নেই। তিনি বলেন, সুনির্দিষ্ট তথ্য না পেলে আমরা গাড়ি তল্লাশি করি না।
তারপরও মাঝেমধ্যে চেকপোস্ট বসাই। চেকপোস্ট বসালে মানুষের ভোগান্তি বাড়ে। চেকপোস্ট না বসানোর কারণে যানজট কিছুটা কমেছে। তবে এখন মনে হচ্ছে, মানুষের ভোগান্তি হলেও চেকপোস্ট বসানো প্রয়োজন।
বাস ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্য্যান রমেশ চন্দ্র ঘোষ ভোরের কাগজকে বলেছেন, কোচে এখন আর হ্যান্ডিক্যাম দিয়ে ভিডিও করা হয় না। অনেক ক্যামেরা নষ্ট হয়ে গেছে। তবে অনেক বাসে মোবাইল ফোনে ভিডিও করা বা ছবি তোলা হয়। গত ঈদের পর থেকে মহাসড়কে হাইওয়ে পুলিশের চেকপোস্ট বন্ধ রয়েছে। চেকপোস্টের কারণে ওই পয়েন্টে যানজট হওয়ায় যাত্রীদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তা বন্ধ আছে। তবে টহল চলে বলে জানান তিনি। রমেশ চন্দ্র বলেন, আগের তুলনায় যাত্রী কমে যাওয়ায় বাসের স্টাফরা রাস্তায় যাত্রী তোলে ও নামায়। এই সুযোগে যাত্রীবেশে ডাকাত উঠে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ বলেন, ডাকাতি প্রতিরোধে মহাসড়কে যত্রতত্র যাত্রী না উঠানো, যাত্রা শুরুর আগে ভিডিও করার জন্য সংগঠনের পক্ষ থেকে সব সময় বলা হয়। বিজ্ঞপ্তি দিয়ে এসব বিষয়ে মনে করিয়ে দেয়া আমাদের নিয়মিত কাজের অংশ। তবে ডাকাতি প্রতিরোধে মালিকের চেয়ে চালকের সচেতন বেশি হওয়া প্রয়োজন। অনেক সময় নির্দেশনা অমান্য করে চালক ও তার সহকারী যাত্রী উঠিয়ে থাকে। ফলে প্রায়ই ডাকাতির ঘটনা ঘটছে। তিনি আরো বলেন, ডাকাতি কমিয়ে আনতে হাইওয়ে পুলিশকে আরো তৎপর হতে হবে। টহল বাড়াতে হবে। অন্যথায় কমবে না। হাইওয়ে পুলিশকে টহল চালিয়ে যেতে হবে। পাশাপাশি চালক ও মালিককে সচেতন হতে হবে। কেননা ট্রিপ প্রতি চুক্তিতে চালককে টাকা দেয়ায় মাঝরাতে যত্রতত্র যাত্রী উঠানো হচ্ছে। এতে ভয়ংকর ঝুঁকিতে পড়ছে অন্য যাত্রীরা। সুতরাং, চুক্তিভিত্তিক নয় বেতনভুক্ত চালক ও হেলপারের ব্যবস্থা করতে হবে।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী ভোরের কাগজকে বলেন, মহাসড়কে বাসে ডাকাতির ঘটনা কমিয়ে আনতে ক্যামেরাভিত্তিক পরিবহন ব্যবস্থার বিকল্প নেই। ডিজিটাল পদ্ধতিতে সড়ক-মহাসড়ক মনিটরিং করতে হবে। যেসব জায়গা ডাকাতির জন্য ঝুঁকিপূর্ণ সেগুলো চিহ্নিত করে হাইওয়ে পুলিশের টহল চালিয়ে যেতে হবে। পাশাপাশি চালক ও মালিককে সচেতন হতে হবে। কেননা ট্রিপ প্রতি চুক্তিতে চালককে টাকা দেয়ায় মাঝরাতে যত্রতত্র যাত্রী উঠানো হচ্ছে। এতে ভয়ংকর ঝুঁকিতে পড়ছে অন্য যাত্রীরা। সুতরাং, চুক্তিভিত্তিক নয়, বেতনভুক্ত চালক ও হেলপারের ব্যবস্থা করতে হবে।
জানা গেছে, চলতি বছরের ১৫ জানুয়ারি সাভারে বগুড়া থেকে ছেড়ে আসা রাজধানীর গাবতলীগামী একটি দূরপাল্লার বাসে ডাকাতি হয়েছে। অস্ত্রের মুখে ১৫ যাত্রী ও বাসের তিন স্টাফের হাত-পা বেঁধে মারধর করে লুটপাট চালায় ডাকাত দল। গত ১৭ মে সাভারে চলন্ত বাসে ডাকাতির অভিযোগে দেশীয় অস্ত্রসহ এক ব্যক্তিকে বেধড়ক মারধর করে পুলিশের কাছে সোপর্দ করেন উত্তেজিত যাত্রীরা। ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের নবীনগর এলাকায় সেনা শপিং কমপ্লেক্সের সামনে এ ঘটনা ঘটে। গত ২৯ জুন সাভারে একটি দূরপাল্লার চলন্ত বাসে দুর্ধর্ষ ডাকাতির ঘটনা ঘটে। এ সময় ডাকাতদের ছুরিকাঘাতে কয়েক যাত্রী গুরুতর আহত হয়। পরে দুজন ডাকাতকে আটক করে স্থানীয়রা। ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের সাভারে বাংলাদেশ লোক প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের (বিপিএটিসি) সামনে এ ঘটনা ঘটে।
২০১৮ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি আশুলিয়ায় টাঙ্গাইল থেকে ছেড়ে আসা ঢাকাগামী ধলেশ্বরী পরিবহন নামে একটি বাসে দুর্ধর্ষ ডাকাতির ঘটনা ঘটে। এ সময় ডাকাতদের অস্ত্রের আঘাতে বাসচালক শাহজাহান মিয়া নিহত হন। সেই সঙ্গে আহত হন গাড়ির হেলপার ও সুপারভাইজার।
২০১৭ সালের ১৮ জানুয়ারি সাভারে সায়েম স্পেশাল রজনীগন্ধা নামের একটি নৈশকোচ ছিনতাই করে ডাকাতরা। ডাকাতের হামলায় আহত হয় অন্তত ১০ জন। ডাকাতরা দুই নারী যাত্রীকেও শ্লীলতাহানির চেষ্টা করে। পরদিন ভোরে পথচারীরা ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের পাশে সাভারের শিমুলতলা এলাকায় বাসের ভেতর থেকে যাত্রীদের উদ্ধার করে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়। বাসটি ঢাকা-রাজশাহী-চাঁপাই রোডে চলাচল করে।