পূর্বধলা ও শ্যামগঞ্জ মুক্ত দিবস আজ

তিলক রায় টুলু, পূর্বধলা নেত্রকোনা থেকে
প্রকাশ: ০৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০:৩৪ এএম

বীর মুক্তিযোদ্ধা সুধীর বড়ুয়ার সমাধিসৌধ। ছবি : ভোরের কাগজ
পূর্বধলা উপজেলা ও শ্যামগঞ্জ মুক্ত দিবস আজ। ১৯৭১ সালের এ দিনে নেত্রকোনা জেলার পূর্বধলা উপজেলা ও শ্যামগঞ্জ এবং তার আশপাশ এলাকা থেকে পাকহানাদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসর রাজাকার ও আলবদরদের পরাজিত করে বীর মুক্তিযোদ্ধারা ঐতিহাসিক রেলওয়ের মাঠে স্বাধীন বাংলার লাল সবুজ পতাকা উত্তোলন করেন। শত্রু মুক্ত করেন শ্যামগঞ্জ ও পূর্বধলা এলাকাকে।
স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিকামী জনতার যৌথ প্রতিরোধের মুখে পাকহানাদার বাহিনী ৮ ডিসেম্বর পূর্বধলা থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। পরদিন ৯ ডিসেম্বর সকালে আবারো হানাদার বাহিনী জারিয়া-ময়মনসিংহ রেলপথে ট্রেনযোগে গৌরীপুর থেকে প্রবেশ করতে চাইলে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিপাগল জনতার তীব্র আক্রমণ ও প্রতিরোধের মুখে পিছু হটতে বাধ্য হয়। এ সময় পিছুহটা পাকসেনারা পূর্বধলা উপজেলার পাবই রেলসেতুটি মাইন বিস্ফোরণে ধ্বংস করে যায়।
তৎকালীন নেত্রকোনা মহকুমা ও ময়মনসিংহ জেলার সংযোগস্থল শ্যামগঞ্জ ও এর আশেপাশের এলাকা পাকিস্তানি হানাদার মুক্ত হয়। বিজয়ের ঠিক আগ মুহূর্তে ৯ ডিসেম্বর সকালে একদল পাকিস্তানি সৈন্যের ব্রাশফায়ারে নির্মমভাবে নিহত হন তৎকালীন ইপিআর হাবিলদার সুধীর বড়ুয়া।
৮ ডিসেম্বর রাত ১১টার পর থেকে নেত্রকোনা, মোহনগঞ্জ, বারহাট্টা, দূর্গাপুর, জারিয়া এবং সুনামগঞ্জ জেলার ধর্মপাশা এলাকা থেকে পাকিস্তানি সৈন্যরা ট্রেনে করে শ্যামগঞ্জ এলাকায় জড়ো হতে থাকে। প্রায় তিন শতাধিক পাকসেনা ও রাজাকার শ্যামগঞ্জ রেলওয়ে মাঠ স্টেশন এলাকা, মইলাকান্দা গোহালাকান্দা ও বাজার দখল করে কিছু কিছু স্থানে বাঙ্কার খনন করে। এ খবর পেয়ে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনীর চারদিকে অবস্থান নেয় এবং আক্রমণের অপেক্ষায় থাকে।
আরো পড়ুন : ঢাকায় পৌঁছেন ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিক্রম মিশ্রি
চারদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান টের পেয়ে শ্যামগঞ্জের বিভিন্ন স্থানে থাকা পাক সৈন্যরা স্টেশনে জড়ো হয়ে ট্রেনে এলাকা ত্যাগ করে। পাকিস্তানি সৈন্যদের পলায়নের খবর চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লে স্বাধীনতাকামী জনতা রাস্তায় নেমে আসে এবং বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে থাকা মুক্তিযোদ্ধারা শ্যামগঞ্জ এলাকায় আসতে থাকে। বিকালে রজব কোম্পানি, বেলাল কোম্পানি ও শামসু সেকশনে নিজ নিজ গ্রুপ নিয়ে শ্যামগঞ্জ ঐতিহাসিক রেলওয়ের মাঠে জড়ো হয়ে বিজয়ের আনন্দে মেতে উঠে। বিকাল ৫টায় ঐতিহাসিক রেলওয়ের মাঠে প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশের লাল সবুজ পতাকা উত্তোলন করেন শিল্পী শাহাতাব। এ সময় মুক্তিযোদ্ধারা ফাঁকা গুলি ছোড়েন এবং জয়বাংলা স্লোগানে পুরো এলাকা প্রকম্পিত করে তোলেন।
এদিকে ইপিআর এর সুধীর বড়ুয়া তার দলবল নিয়ে শ্যামগঞ্জ ডাকবাংলায় রাত কাটানোর জন্য চলে আসতে থাকেন এবং সন্ধ্যায় শ্যামগঞ্জ বাজারের পূর্বপাশে অবস্থানকারী এবং রেকি করে এগিয়ে আসা পাক সেনাদের সঙ্গে শ্যামগঞ্জ পশ্চিম বাজারের পল্লী চিকিৎসালয়ের সামনে মুখোমুখি হয়ে পড়েন। এ সময় পাক সেনাদের সঙ্গে থাকা কয়েকজন রাজাকার জয় বাংলা স্লোগান দিলে তাদেরকে বন্ধু মনে করে সুধীর বড়ুয়াও জয় বাংলা স্লোগান দেন। একই সময় পাকসেনাদের মেশিনগানের ব্রাশ ফায়ারে সুধীর বড়ুয়ার দেহটি মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। তার আরো দুজন সাথীও আহত হন।
পরদিন সকালে ভারতীয় বাহিনীর মেজর প্রিথ সিং, ক্যাপ্টেন মুরারী, ক্যাপ্টেন বালাজিত সিং, ক্যাপ্টেন চোপড়াসহ ভারতীয় সেনা সদস্যদের উপস্থিতিতে শ্যামগঞ্জ ঐতিহাসিক রেলওয়ের মাঠের উত্তর পাশে সম্পন্ন সামরিক কায়দায় শহীদ সুধীর বড়ুয়াকে সমাহিত করা হয়।
পূর্বধলার এই যুদ্ধই ছিল একাত্তরের রণাঙ্গনের নেত্রকোনা জেলার শেষ যুদ্ধ। পড়ে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তায় তার স্মৃতিতে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়। প্রতিবছর ২১ ফেব্রুয়ারি, ২৬ মার্চ, ও ১৬ ডিসেম্বর স্কুল কলেজের ছাত্র/ছাত্রী সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তার স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে তার প্রতি শ্রদ্ধা জানান।
তার এই বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার তাকে মরণোত্তর বীরবিক্রম উপাধিতে ভূষিত করেন। এই যুদ্ধই ছিল একাত্তর রণাঙ্গনের নেত্রকোনা জেলার শেষ যুদ্ধ।
স্বাধীনতার ৫৩ বছর পড়েও এই বীর মুক্তিযোদ্ধার স্মৃতিসৌধটি চরম অযত্ন ও অবহেলায় পড়ে রয়েছে। বর্তমান নতুন প্রজন্ম জানেই না এই বীর সেনানীর বীরত্বগাঁথা গল্পের কাহিনী। অপরদিকে, বর্তমানে তার স্মৃতিসৌধটি সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এই বীর মুক্তিযোদ্ধার সমাধির চারপাশে ময়লা আবর্জনা ফেলে ময়লার বাগাড়ে পরিণত করা হয়েছে। চারপাশে গড়ে উঠেছে অবৈধ দোকান পাঠ।
এদিকে পূর্বধলা মুক্ত দিবস পালন উপলক্ষে জাতীয় পতাকা উত্তোলন, র্যালি ও আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে।