পল্লিকবি জসীমউদ্দীনের ১২২তম জন্মবার্ষিকী আজ

কাগজ ডেস্ক
প্রকাশ: ০১ জানুয়ারি ২০২৫, ০৮:৫০ এএম

পল্লী কবি জসীমউদ্দীন। ছবি : সংগৃহীত
বাংলা সাহিত্যে পল্লী কবি উপাধিতে ভূষিত জসীমউদ্দীন এমনই এক ব্যক্তিত্ব যিনি আবহমান বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে লালিত প্রথম এবং পূর্ণাঙ্গ আধুনিক কবি।
‘তুমি যাবে ভাই, যাবে মোর সাথে, আমাদের ছোট গাঁয়’, ‘এইখানে তোর দাদির কবর ডালিম-গাছের তলে’, ‘ও বাবু সেলাম বারে বার, আমার নাম গয়া বাইদ্যা বাবু বাড়ি পদ্মা পার।’এমন শত কবিতা, গল্প, নাটক আর গানের মাধ্যমে গ্রাম-বাংলার মানুষের সুখ-দুঃখের কথা তুলে ধরেছেন কবি।
ঐতিহ্যবাহী বাংলা কবিতার মূল ধারাটিকে নগরসভায় নিয়ে আসার কৃতিত্ব জসীমউদ্দীনের। তার নকশী কাঁথার মাঠ ও সোজন বাদিয়ার ঘাট বাংলা ভাষার গীতিময় কবিতার উৎকৃষ্টতম নিদর্শনগুলোর অন্যতম। তার কবিতা বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে।
১৯০৩ সালের ১ জানুয়ারি ফরিদপুর জেলার তাম্বুলখানা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন জসীমউদ্দীন। মোহাম্মাদ জসীমউদ্দীন মোল্লা তার পূর্ণ নাম হলেও তিনি জসীমউদ্দীন নামেই পরিচিত। তার বাবার বাড়ি ছিল একই জেলার গোবিন্দপুর গ্রামে। বাবার নাম আনসার উদ্দিন মোল্লা। তিনি পেশায় একজন স্কুল শিক্ষক ছিলেন। মা আমিনা খাতুন ওরফে রাঙাছুট।
জসীমউদ্দীন ফরিদপুর ওয়েলফেয়ার স্কুল ও পরবর্তীতে ফরিদপুর জেলা স্কুলে (বর্তমানে ফরিদপুর জিলা স্কুল) পড়ালেখা করেন। এখান থেকে তিনি তার প্রবেশিকা পরীক্ষায় ১৯২১ সনে উত্তীর্ণ হন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিষয় থেকে বি. এ. এবং এম. এ. শেষ করেন যথাক্রমে ১৯২৯ এবং ১৯৩১ সনে।
আরো পড়ুন : বাংলা একাডেমি : সাহিত্য পুরস্কার ও সাম্মানিক ফেলোশিপ ঘোষণা
১৯৩১ থেকে ১৯৩৭ পর্যন্ত, দীনেশচন্দ্র সেনের সাথে লোক সাহিত্য সংগ্রাহক হিসেবে জসীম উদ্দীন কাজ করেন। তিনি পূর্ব বঙ্গ গীতিকার একজন সংগ্রাহকও। তিনি ১০,০০০ এরও বেশি লোক সংগীত সংগ্রহ করেছেন, যার কিছু অংশ তার সংগীত সংকলন জারি গান এবং মুর্শিদা গান এ স্থান পেয়েছে। তিনি বাংলা লোক সাহিত্যের বিশদ ব্যাখ্যা এবং দর্শন খণ্ড আকারেও লিখে গেছেন। ১৯৩৩ সনে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. দীনেশচন্দ্র সেনের অধীনে রামতনু লাহিড়ী গবেষণা সহকারী পদে যোগ দেন। এরপর ১৯৩৮ সনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। তিনি ১৯৪৪ সালে বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে এবং তথ্য ও সম্প্রচার বিভাগে যোগ দেন। ১৯৬২ সালে অবসর গ্রহণের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি ডেপুটি ডিরেক্টর হিসেবে কাজ করে গেছেন। তিনি গুরু মৃত্যুন জয় সিলের কাছে গুণগ্রাহী ছিলেন। ১৯৬৯ সনে রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় কবিকে সম্মান সূচক ডি লিট উপাধিতে ভূষিত করেন।
জসীম উদ্দীন একদম অল্প বয়স থেকেই লেখালেখি শুরু করেন। কলেজে অধ্যয়নরত থাকা অবস্থায়, পরিবার এবং বিয়োগান্ত দৃশ্যে, একদম সাবলীল ভাষায় তিনি বিশেষ আলোচিত কবিতা কবর লিখেন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাবস্থায় এই কবিতাটি প্রবেশিকার বাংলা পাঠ্যবইয়ে স্থান পায়।
গাঁয়ের লোকের দৃষ্টিতে গ্রাম্য জীবন এবং পরিবেশ-প্রকৃতি ফুটিয়ে তোলার জন্য জসীমউদ্দীন বিশেষভাবে পরিচিত। তার এই সুখ্যাতি তাকে পল্লি কবি উপাধি এনে দিয়েছে। তার কাব্যের গঠনপ্রণালী এবং বিষয়বস্তু পাঠককে বাংলা লোক সাহিত্যের প্রগাঢ় আস্বাদন এনে দেয়। তার রচিত নকশী কাঁথার মাঠ কাব্যগ্রন্থকে তার শ্রেষ্ঠ শিল্পকর্ম হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং পৃথিবীর অনেক ভাষায় এটি অনূদিত হয়েছে।
এছাড়াও জসীমউদ্দীন গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী অনেক গান রচনা করেছেন। বাংলার বিখ্যাত লোক সংগীতের গায়ক, আব্বাসউদ্দীন, তার সহযোগিতায় কিছু অবিস্মরণীয় লোকগীতি নির্মাণ করেছেন, বিশেষত ভাটিয়ালী ধারার। জসীমউদ্দীন রেডিওর জন্যেও আধুনিক গান লিখেছেন। তিনি তার প্রতিবেশী, কবি গোলাম মোস্তফার দ্বারা ইসলামিক সংগীত লিখতেও প্রভাবিত হয়েছিলেন। পরবর্তীতে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময়ে, তিনি বহু দেশাত্মবোধক গান লিখেন।
কাব্যগ্রন্থ : রাখালী (১৯২৭), নকশী কাঁথার মাঠ (১৯২৯), বালুচর (১৯৩০), ধানখেত (১৯৩৩), সোজন বাদিয়ার ঘাট (১৯৩৪), হাসু (১৯৩৮), রুপবতি (১৯৪৬), মাটির কান্না (১৯৫১), এক পয়সার বাঁশী (১৯৫৬), সখিনা (১৯৫৯), সুচয়নী (১৯৬১), ভয়াবহ সেই দিনগুলিতে (১৯৬২), মা যে জননী কান্দে (১৯৬৩), হলুদ বরণী (১৯৬৬), জলে লেখন (১৯৬৯), পদ্মা নদীর দেশে (১৯৬৯), কাফনের মিছিল (১৯৭৮), মহরম দুমুখো চাঁদ পাহাড়ি (১৯৮৭)।
নাটক : পদ্মাপার (১৯৫০), বেদের মেয়ে (১৯৫১), মধুমালা (১৯৫১), পল্লীবধূ (১৯৫৬), গ্রামের মেয়ে (১৯৫৯), ওগো পুস্পধনু (১৯৬৮), আসমান সিংহ (১৯৮৬)। আত্মকথা : যাদের দেখেছি ((১৯৫১), ঠাকুর বাড়ির আঙ্গিনায় (১৯৬১), জীবন কথা ( ১৯৬৪), স্মৃতিপট (১৯৬৪), স্মরণের সরণী বাহি (১৯৭৮)। উপন্যাস : বোবা কাহিনী (১৯৬৪)। ভ্রমণ কাহিনী : চলে মুসাফির (১৯৫২), হলদে পরির দেশে ( ১৯৬৭), যে দেশে মানুষ বড় (১৯৬৮), জার্মানীর শহরে বন্দরে (১৯৭৫)। সঙ্গীত : রঙিলা নায়ের মাঝি (১৯৩৫), গাঙের পাড় (১৯৬৪), জারি গান (১৯৬৮), মুর্শিদী গান (১৯৭৭)। অন্যান্য : বাঙালির হাসির গল্প ১ম খন্ড (১৯৬০), ২য় খন্ড (১৯৬৪), ডালিমকুমার (১৯৮৬)
গানের শিরোনাম : “কাজল ভ্রমরা যে”, আমার সোনার ময়না পাখি, আমার গলার হার খুলে নে, আমার হার কালা করলাম রে, আমায় ভাসাইলি রে, আমায় এতো রাতে, কেমন তোমার মাতা পিতা, নদীর কূল নাই কিনার নাই, ও বন্ধু রঙিলা, রঙিলা নায়ের মাঝি, নিশ্তে যাইও ফুলবাণে, ও ভোমরা, ও বাজান চল যাই মাঠে লাঙল বাইতে, প্রানো শখি রে ঐ শুনে কদম্ব তলে, ও আমার দরদি আগে জানলে, বাঁশরি আমার হারাই গিয়াছে, বালু চরের মেয়া, বাদল বাঁশি ওরে বন্ধু, গাঙ্গের কূলরে গেলো ভাঙিয়া, ও তুই যারে আঘাত হানলিরে মনে, ও আমার গহীন গানের নায়া ও আমার বন্ধু বিনুধিয়া।
অনুবাদ : জসীম উদ্দীনের “নকশী কাঁথার মাঠ” কাব্যটি “দি ফিল্ড অব এমব্রয়ডার্ড কুইল্ট” এবং বাঙালীর হাসির গল্প গ্রন্থটি ফোক টেল্স অব ইষ্ট পাকিস্তান নামে ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে।
পুরস্কার : প্রেসিডেন্টস এওয়ার্ড ফর প্রাইড অফ পারফরম্যান্স, পাকিস্তান (১৯৫৮), রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি. লিট ডিগ্রি, ভারত (১৯৬৯), ১৯৭৪ সনে তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেন একুশে পদক, বাংলাদেশ (১৯৭৬) ও স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার ১৯৭৮ (মরণোত্তর)।
১৪ মার্চ ১৯৭৬ সালে তিনি ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। তার শেষ ইচ্ছা অনুসারে তাকে ফরিদপুর জেলার আম্বিকাপুর গ্রামে তার দাদীর কবরের পাশে দাফন করা হয়। গোবিন্দপুরে প্রতিবছর জানুয়ারি মাসে তার জন্মদিনকে স্মরণ করে জসীম মেলা নামে একটি পাক্ষিক উৎসব উদযাপন করা হয়। তার নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি আবাসিক হলের নামকরণ করা হয়েছে।
গ্রাম-বাংলার মানুষের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার চিত্রকার পল্লিকবি জসীমউদ্দীনের ১২২তম জন্মবার্ষিকী আজ রবিবার (১ জানুয়ারি)। পল্লিকবির জন্মবার্ষিকী পালন উপলক্ষ্যে ফরিদপুরের বিভিন্ন সংগঠন নানা কর্মসূচি নিয়েছে।
পল্লিকবির ১২২তম জন্মবার্ষিকী পালন উপলক্ষে ফরিদপুরের সরকারি-বেসরকারি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়েছে। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে সকাল সাড়ে ৯টায় কবির সমাধীতে পুষ্পার্ঘ অর্পণ, ৯টা ১৫ মিনিটে কবির বাড়ির প্রাঙ্গণে আলোচনা সভা এবং আলোচনা সভা শেষে দোয়া ও মিলাদ মাহফিল।
এ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক মো. কামরুল হাসান মোল্লা এবং বিশেষ অতিথি হিসেবে ফরিদপুরের পুলিশ সুপার মো. আব্দুল জলিলের উপস্থিত থাকার কথা রয়েছে।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন পল্লিকবি জসীমউদ্দীনের জন্মবার্ষিকী উদযাপন কমিটির সভাপতি ফরিদপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) ইয়াসিন কবির। জেলা পরিষদ ও জসীম ফাউন্ডেশন যৌথভাবে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করবে।