বরেণ্য শিশুসাহিত্যিক কাইজার চৌধুরীর জন্মজয়ন্তী উদযাপন

কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০:২৯ পিএম

ছবি: ভোরের কাগজ
বরেণ্য শিশুসাহিত্যিক কাইজার চৌধুরীর ৭৫তম জন্মজয়ন্তী উদযাপিত হয়েছে। শুক্রবার (১৫ নভেম্বর) রাজধানীর বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে পদক্ষেপ বাংলাদেশের উদ্যোগে জন্মদিনের এ আয়োজনে তার সুহৃদ, শুভাকাঙ্ক্ষী ও শিল্প-সাহিত্য অঙ্গনের অনেকে লেখককে ফুলেল শুভেচ্ছা জানিয়েছেন।
আবৃত্তিশিল্পী রফিকুল ইসলাম লেখককে নিবেদন করে আবৃত্তি পরিবেশন করেন। দলীয় আবৃত্তি পরিবেশন করেন ঢাকা স্বরকম্পনের শিল্পীরা। আয়োজক সংগঠন পদক্ষেপ বাংলাদেশের সভাপতি বাদল চৌধুরী লেখক কাইজার চৌধুরীকে উত্তরীয় পরিয়ে তার হাতে সম্মাননা স্মারক তুলে দেন।
কবি ও ছড়াকার আসলাম সানীর সভাপতিত্বে ও আবৃত্তিশিল্পী ফয়জুল্লাহ সাঈদের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন- ড. ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায়, শিশুসাহিত্যিক সুজন বড়ুয়া, নাট্যজন ঝুনা চৌধুরী, মানজার চৌধুরী সুইট প্রমুখ।
পুরনো ঢাকার মাহুতটুলির নানাবাড়িতে কাইজার চৌধুরী ১৯৪৯ সালের ১৫ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। তার পৈত্রিক নিবাস মুন্সীগঞ্জ জেলার মেঘনাপাড়ের গজারিয়ায়। তার বাবা ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গর্ভনর আমিনুল হক চৌধুরী, মা নূর-ই–আক্তার বানু গৃহিণী।
মিসেস ডি বেইলস্ প্রাইভেট ইংলিশ ডে স্কুল, ঢাকার গেন্ডারিয়া মুসলিম হাইস্কুল, সেন্ট ফ্রান্সিস, সেন্ট গ্রেগরিজ এবং আরো তিনটে স্কুলের উঠোন পেরিয়ে অবশেষে আহমেদ বাওয়ানী একাডেমি থেকে এসএসসি পাস করেন ১৯৬৭ সালে। নটরডেম কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক (১৯৭২) ও স্নাতকোত্তর (১৯৭৩) ডিগ্রি লাভের মধ্য দিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সমাপ্তি। খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ হিসেবে পেশাগত জীবনে ছিলেন একজন সফল ব্যাংকার।
আরো পড়ুন: ‘আধুনিকতার ইতিহাস’ গ্রন্থের পাঠ উন্মোচন এবং আলোচনা সভা
বহুমাত্রিক আলোর উদ্বাসনে তিনি ছাত্র জীবন থেকে কর্মজীবন, সৃজনশীলতা থেকে জীবনের সব ক্ষেত্রে স্বনির্মিত একজন সফল ব্যক্তিত্ব। বিজ্ঞানমনস্ক প্রগতিশীল ব্যক্তি মানুষ এবং অগণিত পাঠকের হৃদয় হরণকারী নন্দিত লেখক হিসেবেও তার অবস্থান বাংলাদেশের সাহিত্যাঙ্গনে সুপ্রতিষ্ঠিত।
দেশের চলচ্চিত্র-শিক্ষা-শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে তিনি সম্পৃক্ত। ভ্রমণ-চলচ্চিত্র-সংগীতপ্রিয় মানুষ। নিজেও একসময় বেহালার সুরের মধ্যে নিমগ্ন থাকতেন।
আপাদমস্তক গল্পের মানুষ তিনি। গল্প তার চোখে-মুখে, মগজের কোষে কোষে, শিরা-উপশিরায়। গল্প যেন তাকে ঘুমোতে দেয় না। মন খুলে গল্প শোনাতে পারলেই যেন তার শান্তি। গল্প বলেন মজা করে। দারুণ তার গল্প বলার ভঙ্গি। যেমন তার কাহিনীর চমক, তেমনি বর্ণনার ঝলক। কথার চমৎকারিত্বে কখনও ঘোর লাগার জোগাড়, কখনও আবার হতবাক হতে হয় বিস্ময়ে। বিষয়ে-বুননে-কথনে অত্যন্ত সপ্রতিভ আধুনিক গল্পের রূপকার তিনি। যদি তার গল্পের সঙ্গে লেখকের নাম নাও ছাপা হয়, তবু পাঠকের বুঝতে কষ্ট হয় না, গল্পটি কার। এই স্বতন্ত্র ধারার গল্প লেখকের নাম কাইজার চৌধুরী।
পাঁচ দশকেরও বেশি সময় ধরে অবিরল ধারায় লিখে চলেছেন তিনি। লিখছেন শিশু-কিশোরদের জন্য। কিন্তু কেবল ছোটরাই তার পাঠক নয়। তিনি সেই শিশুসাহিত্যের লেখক, যা সর্বজন পাঠ্য। তাই তার পাঠক-পরিধি বেশ বিস্তৃত।
কাইজার চৌধুরী মূলত সহজ সাবলীল ভাষার লেখক। যে কোনো বিষয় নিয়েই লিখুন না কেন, সরস উপস্থাপনার গুণে তার সব লেখায় হাস্যরসটা প্রধান হয়ে ওঠে। তবে হাস্যরসের আড়ালে গল্পের মূল সুর-স্বাদ কখনও ঢাকা পড়েনা। বরং ভিন্নমাত্রা পায়। এটি তার রচনার অনন্য বৈশিষ্ট্য।
আরো পড়ুন: ‘সংস্কৃতিবাংলা’ সংগঠনের আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা
কাইজার চৌধুরীর বিষয়-বৈচিত্র্য, ধরন-প্রকৃতি একেবারে তার নিজস্ব। নির্মল হাসির গল্প ছাড়াও তিনি প্রচুর মুক্তিযুদ্ধের গল্প লিখেছেন। লিখেছেন বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে। বঙ্গবন্ধুর বীরগাথার মহাকাব্যিক রূপায়ণ করেছেন তার লেখার আপন আঙ্গিনায়। কাইজার চৌধুরীর লেখায়, মেধা-প্রজ্ঞা আর কল্পনাশক্তির এমন আশ্চর্য সমন্বয় ঘটে, যা কথাসাহিত্যককে করে হৃদয়গ্রাহী।
শিল্প-সাহিত্যের পাশাপাশি চলচ্চিত্র নিয়েও গভীর উৎসাহ তার। লাতিন আমেরিকান ও প্রতিবাদী চলচ্চিত্র সম্পর্কিত কিছু প্রবন্ধ বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সংসদ প্রকাশিত ‘ধ্রুপদী’ ও ‘চলচ্চিত্রপত্রে’ ছাপা হয়েছে। এই রচনাগুলো বাদ দিলে অবশিষ্ট যা থাকে, তার পুরোটাই শিশুতোষ রচনা। তার লেখা গল্প-উপন্যাস হয়ে উঠেছে সববয়সী পাঠকের আনন্দের উৎস। শিশু-কিশোরের হৃদয়ের চোখ দিয়ে তিনি দেখেন ওদের পৃথিবী। সিরিয়াস বিষয়ের সঙ্গেও হাস্যরসিকতায় তার লেখা হয়ে ওঠে অত্যন্ত সুখপাঠ্য। শিশু মনস্তত্ত্ব যেমন তার নখদর্পণে, তেমনি দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য রচনায়ও ঋদ্ধ। ভাষা আন্দোলন, বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধসহ বাংলা ও বাঙালির সব অর্জন এবং আনন্দবেদনা বাঙ্ময় হয়ে ওঠে তার লেখায়।
তিনি অর্জন করেছেন রাষ্ট্রীয় সাহিত্যস্বীকৃতিসহ দেশে-বিদেশে বহু সম্মাননা ও পুরস্কার। বাংলা একাডেমি পুরস্কারসহ অগ্রণী ব্যাংক শিশুসাহিত্য পুরস্কার, পদক্ষেপ পুরস্কার, চন্দ্রাবতী স্বর্ণপদক, কবি আবুজাফর ওবায়দুল্লাহ সাহিত্য পুরস্কার, ছোটদের কাগজ শিশুসাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন।
অর্ধশতাধিক গ্রন্থের রচয়িতা কাইজার চৌধুরীর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থসমূহ: আমার ছেলেবেলা, রাজুর বিড়ম্বনা, স্বপনের মাউথ অর্গান, ভুতের খোঁজে, তুলি ও চিল, চোরা গঞ্জের গল্প, বিল্টু মামার আরেক কান্ড, শোভনের একাত্তর, অন্য কিশোর, ন্যাড়ার বাড়ির ভুত, চোর ডাকাতের গল্প, একাত্তরের রূপকথা, একাত্তরের একদিন, আমাদের একাত্তর, পুরানো সেই ভুতের কথা, গল্প আরো ছয়, চোরের গল্প ভূতের গল্প, গায়ের নাম রুমঝুমপুর, ভুত আছে ভুত নেই, ভয়ে আছে ভুতেরাও, পাখির খোঁজে, বিল্টু মামার গাড়ি, গোয়েন্দা সাজলো বিল্টু মামা, ভুত চেনা সহজ নয়, শহরে এক বাঘ এসেছিল, হাসির ছক্কা, হাতে খড়ি, ছাপাখানার ভুত।