যেভাবে তৈরি হয়েছিল অমর একুশের সেই গান

কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১৯ মে ২০২২, ০৪:৫৪ পিএম

প্রতীকী ছবি
ফেব্রুয়ারি এলেই ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানটি সবার মুখে মুখে শোনা যায়। শব্দ আর সুরের মূর্ছনায় আমাদের মানসপটে ভেসে আসে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির ভাষাশহিদদের স্মৃতি। সেই গানের লেখক আবদুল গাফফার চৌধুরী চিরঘুম দিয়েছেন। আজ বৃহস্পতিবার (১৯ মে) লন্ডনের একটি হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
১৯৫২ সালের অগ্নিঝরা মুহূর্তে কালজয়ী এই গানে প্রথম সুরারোপ করেন আবদুল লতিফ। পরে দ্বিতীয়বার সুরারোপ করেন আলতাফ মাহমুদ। এই সুরেই এখন গাওয়া হয় একুশের গান।
আবদুল গাফফার চৌধুরীর লেখা গানটি এখানে পুরোটুকু দেয়া হলো-
আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি
ছেলেহারা শত মায়ের অশ্রু ঝরা এ ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি
আমার সোনার দেশের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি।
জাগো নাগিনীরা জাগো নাগিনীরা জাগো কালবোশেখীরা
শিশু হত্যার বিক্ষোভে আজ কাঁপুক বসুন্ধরা,
দেশের সোনার ছেলে খুন করে রোখে মানুষের দাবি
দিন বদলের ক্রান্তিলগ্নে তবু তোরা পার পাবি?
না, না, না, না খুন রাঙা ইতিহাসে শেষ রায় দেওয়া তারই
একুশে ফেব্রুয়ারি একুশে ফেব্রুয়ারি।
সেদিনও এমনি নীল গগনের বসনে শীতের শেষে
রাত জাগা চাঁদ চুমো খেয়েছিল হেসে;
পথে পথে ফোটে রজনীগন্ধা অলকনন্দা যেন,
এমন সময় ঝড় এলো এক ঝড় এলো খ্যাপা বুনো।।
সেই আঁধারের পশুদের মুখ চেনা,
তাহাদের তরে মায়ের, বোনের, ভায়ের চরম ঘৃণা
ওরা গুলি ছোঁড়ে এদেশের প্রাণে দেশের দাবীকে রোখে
ওদের ঘৃণ্য পদাঘাত এই সারা বাংলার বুকে
ওরা এদেশের নয়,
দেশের ভাগ্য ওরা করে বিক্রয়
ওরা মানুষের অন্ন, বস্ত্র, শান্তি নিয়েছে কাড়ি
একুশে ফেব্রুয়ারি একুশে ফেব্রুয়ারি।
তুমি আজ জাগো তুমি আজ জাগো একুশে ফেব্রুয়ারি
আজো জালিমের কারাগারে মরে বীর ছেলে বীর নারী
আমার শহীদ ভায়ের আত্মা ডাকে
জাগো মানুষের সুপ্ত শক্তি হাটে মাঠে ঘাটে বাটে
দারুণ ক্রোধের আগুনে আবার জ্বালবো ফেব্রুয়ারি
একুশে ফেব্রুয়ারি একুশে ফেব্রুয়ারি।
এই গান লেখার সময় আবদুল গাফফার চৌধুরী ঢাকা কলেজের বিদায়ী ছাত্র ছিলেন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্রদের ওপর পুলিশের গুলি চালানোর খবর পেয়ে তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যান খোঁজ নিতে। সেই সময় আউটডোরে এক নিহত ছাত্রের লাশ দেখে তিনি আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন। গুলিতে ছাত্রটির মাথার খুলি উড়ে গেছিল। নিহত ছাত্রটি ছিলেন শহীদ রফিকুদ্দীন।
২২ ফেব্রুয়ারি নিহতদের স্মরণে গায়েবানা জানাজা হয়েছিল এবং মওলানা ভাসানী সেই জানাজায় ইমামতি করেন। জানাজা শেষ হওয়ার পর গণমিছিল শুরু হয়, যে মিছিলে আবদুল গাফফার চৌধুরী পুলিশের লাঠিচার্জে আহত ও অজ্ঞান হয়ে পড়েন। তার বন্ধুরা তাকে প্রথমে কার্জন হলে নিয়ে যান। পরে সেখান থেকে গেন্ডারিয়ার একটি বাসায় নিয়ে যান। আহত অবস্থায় সেই বাসাতেই তিনি এই কবিতা লিখেছিলেন। ১৯৫৪ সালে হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত একুশে সংকলনে কবিতাটি প্রকাশিত হয়। তৎকালীন পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী সংকলনটি বাজেয়াপ্ত করে।
এরপর গেন্ডারিয়ায় গোপন এক সভায় এক ইশতেহার প্রকাশ করা হয় এবং সেই ইশতেহারেই প্রথম এই গান ছাপানো হয়। প্রথমে আবদুল লতিফ কবিতাটির সুরারোপ করেন এবং ১৯৫৩ সালে গুলিস্তানের ব্রিটেনিয়া হলে ঢাকা কলেজের নবনির্বাচিত ছাত্র সংসদের অভিষেক অনুষ্ঠানে আব্দুল লতিফ ও আতিকুল ইসলাম প্রথম গানটি পরিবেশন করেন। ঢাকা কলেজের কিছু ছাত্র কলেজ প্রাঙ্গনে শহীদ মিনার স্থাপনের চেষ্টা করার সময় গানটি গাওয়ার অপরাধে তাদেরকে কলেজ থেকে বহিষ্কার করা হয়। পরে মাওলানা ভাসানী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের অনুরোধে শহীদ শেখ সোহরাওয়ার্দী বহিষ্কারের জন্য তৎকালীন সরকারের বিরুদ্ধে কঠোর ভাষায় প্রতিবাদ জানালে বহিষ্কারাদেশ তুলে নেয়া হয়। গানটি গাওয়ার অপরাধে সে বছর আবদুল লতিফ এর বাসাতেও গ্রেপ্তারের জন্য পুলিশ আসে।
পরবর্তীতে সেসময়কার খ্যাতিমান সুরকার আলতাফ মাহমুদ গানটিতে পুনরায় সুরারোপ করেন। বর্তমানে এটিই গানটির প্রাতিষ্ঠানিক সুর হিসেবে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত।
প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশের সব জেলা, সব শহর থেকে ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে শত শত মানুষ এই গান গেয়ে শহীদ মিনার অভিমুখে খালি পায়ে হেঁটে যান। ভাষা শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে একুশে ফেব্রুয়ারির প্রভাতফেরিতে এই গান গেয়ে সবাই শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রাক্কালে ১৯৬৯ সালে জহির রায়হান তার ‘জীবন থেকে নেওয়া’ ছবিতে গানটি ব্যবহার করেন। বর্তমানে এই গান ইংরেজি, হিন্দি, মালয়, ফরাসি, সুইডিশ, জাপানিসহ ১২টি ভাষায় গাওয়া হয়।