কোরিয়ার অভিভাবকদের ভরসা কেন ‘হ্যাপিনেস ফ্যাক্টরিতে’?

কাগজ ডেস্ক
প্রকাশ: ০২ জুলাই ২০২৪, ০১:১৬ পিএম

ছবি: সংগৃহীত
হ্যাপিনেস ফ্যাক্টরিতে ঘরের দরজার নিচে খাবার দেয়ার যে ছোট্ট ফাঁকা জায়গাটা রাখা হয়েছে, সেটাই বাইরের জগতের সঙ্গে একমাত্র সংযোগ। ফোন বা ল্যাপটপ ব্যবহারের অনুমতি সেখানে নেই। ছোট্ট কক্ষগুলোতে বাসিন্দাদের সঙ্গী কেবল দেয়াল। তারা চাইলে কয়েদিদের মত নীল পোশাক পরতে পারেন, যদিও তারা বন্দি নন।
দক্ষিণ কোরিয়ায় এই হ্যাপিনেস ফ্যাক্টরিতে মানুষ ‘অবরুদ্ধ অবস্থার অভিজ্ঞতা’ নিতে যায়।
সেখানে যাওয়া মানুষদের মধ্যে বেশিরভাগই সন্তানের বাবা-মা। তাদের শিশুটি হয়ত সমাজ থেকে নিজেকে একেবারেই গুটিয়ে নিয়েছে। পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার অনুভূতি কেমন- সেই অভিজ্ঞতায় নিচ্ছেন এই অভিভাবকরা।
নির্জন কক্ষ
এখানে যারা কিছু সময়ের জন্য থাকতে আসেন, তাদের বর্ণনা করা হয় হিকিকোমোরি হিসাবে। নব্বইয়ের দশকে সম্পূর্ণভাবে সমাজবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া জাপানের কিশোর ও তরুণদের বোঝাতে শব্দটি তৈরি হয়েছিল।
দক্ষিণ কোরিয়ার স্বাস্থ্য ও কল্যাণ মন্ত্রণালয় গত বছর ১৯ থেকে ৩৪ বছর বয়সী ১৫ হাজার জনের ওপর জরিপ চালিয়ে দেখতে পেয়েছে, তাদের ৫ শতাংশের বেশি মানুষ নিজেদেরকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছেন।
বিবিসি লিখেছে, জরিপের এই ফল যদি বৃহৎ অর্থে দক্ষিণ কোরিয়ার জনসংখ্যার প্রতিনিধিত্ব করে, তাহলে সেখানে পাঁচ লাখ ৪০ হাজার মানুষ একই অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন।
আরো পড়ুন: ট্রাম্পকে দায়মুক্তির রায় আইনের ‘ভয়াবহ নজির’
এ পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে আসতে গত এপ্রিল থেকে ১৩ সপ্তাহের অভিভাবক শিক্ষা কর্মসূচি শুরু করেছে বেসরকারি সংস্থা দ্য কোরিয়া ইয়ুথ ফাউন্ডেশন এবং ব্লু হোয়েল রিকোভারি সেন্টার।
লোকজন কীভাবে তাদের বাচ্চাদের সাথে আরো ভালো যোগাযোগ রাখতে পারে তা শেখানোই এ কর্মসূচির মূল লক্ষ্য।
কর্মসূচির অংশ হিসেবে গ্যাংওন প্রদেশের হংচিয়ন-গানে তিন দিন কারাগারের মত নির্জন কক্ষে থাকতে হয় অংশগ্রহণকারীদের। এই বিচ্ছিন্নতার অনুভূতি জাগানোর উদ্দেশ্য হল, মা-বাবারা যেন তাদের সন্তানকে আরো গভীরভাবে বুঝতে পারেন।
‘আবেগীয় কারাগার’
জিন ইয়াং-হাইয়ের (ছদ্মনাম) ছেলে তিন বছর ধরে নিজেকে শয়নকক্ষে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে।
নিজে বন্দি সময় কাটানোর পর থেকে জিন উপলব্ধি করতে পারছেন, এর চেয়ে তার ২৪ বছর বয়সী ছেলের ‘আবেগীয় কারাগার’ একটু হলেও ভালো।
৫০ বছর বয়সী মা জিন বলেন, আমি কেবল ভাবতাম, আমার ভুলটা কোথায় ছিল। সেই ভাবনাও ছিল খুব পীড়াদায়ক। এখন নিজের অভিজ্ঞতা থেকে একটা ধারণা আমি পাচ্ছি।
কথা বলতে অনীহা
ছেলে সবসময়ই মেধাবী ছিল জানিয়ে জিন বলেন, সন্তানকে নিয়ে তার ও ছেলের বাবার উচ্চাশা ছিল। প্রায়ই অসুস্থ হওয়ায় স্কুলে যাওয়া তার জন্য কঠিন হয়ে পড়ছিল। বন্ধুদের সঙ্গে চলাফেরাও কঠিন ঠেকছিল। ক্ষুধামান্দ্য দেখা দিয়েছিল ওর।
ছেলে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হল, একটি টার্ম ভালোই করেছিল বলে মনে হয়েছে মা জিনের কাছে। কিন্তু এক সময় সব ওলটপালট হয়ে গেল, সবকিছু থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিল ছেলে। সারাক্ষণ নিজের ঘরেই বন্দি থাকে সে, ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা আর খাবারেও তার অনিহা। এসব দেখে ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল জিনের।
উদ্বেগ, পরিবার ও বন্ধুদের সঙ্গে সম্পর্কের জটিলতা এবং শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে না পারার হতাশা হয়ত জিনের ছেলের ওপর প্রভাব ফেলেছিল। কিন্তু সমস্যা যে আসলে কী, তা নিয়ে মায়ের সঙ্গেও কথা বলতে চায়নি ছেলে। জিন যখন হ্যাপিনেস ফ্যাক্টরিতে গেলেন, বিচ্ছিন্ন জীবন বেছে নেয়া অন্য তরুণদের লেখা পড়লেন।
তিনি বলেন, ওই নোটগুলো পড়ে আমি বুঝতে পারছিলাম, আহ, ও নিজেকে আড়াল করে রেখেছে, কারণ কেউ তাকে বোঝে না।
পার্ক হান-সিল (ছদ্মনাম) হ্যাপিনেস ফ্যাক্টরিতে এসেছিলেন তার ২৬ বছর বয়সী ছেলের জন্য, যে সাত বছর আগে বাইরের জগতের সঙ্গে সব ধরনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। কয়েকবার বাড়ি থেকে পালিয়েও গিয়েছিল তার ছেলে। তবে এখন সে খুব কমই ঘর থেকে বের হয়।
পার্ক তাকে একজন কাউন্সেলরের কাছে নিয়ে যান এবং ডাক্তার দেখাতে যান। কিন্তু তার ছেলে মানসিক স্বাস্থ্যের ওষুধ নিতে রাজি হয়নি। একপর্যায়ে সে ভিডিও গেমে আসক্ত হয়ে পড়ে।
আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্ক
আইসোলেশন প্রোগ্রামের মাধ্যমে পার্ক এখন তার ছেলের অনুভূতিগুলো আরো গভীরভাবে বুঝতে শুরু করেছেন।
তিনি জানান, আমি বুঝতে পারছি যে একটি নির্দিষ্ট ছাঁচে না ফেলে আমার সন্তানের জীবনকে মেনে নেয়া গুরুত্বপূর্ণ।
এদিকে দক্ষিণ কোরিয়ার স্বাস্থ্য ও কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের গবেষণা বলছে, তরুণদের বিচ্ছিন্ন হওয়ার পেছেনে বিভিন্ন কারণ আছে।
১৯ থেকে ৩৪ বছর বয়সীদের ওপর পরিচালিত জরিপ অনুযায়ী, সবচেয়ে সাধারণ কারণগুলো হল–
- চাকরি পেতে জটিলতা (২৪.১%)
- আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্কের সমস্যা (২৩.৫%)
- পারিবারিক সমস্যা (১২.৪%)
- স্বাস্থ্যগত সমস্যা (১২.৪%)
বিশ্বের যে কয়টি দেশে সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে, তার একটি দক্ষিণ কোরিয়া। এ সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে গত বছর দেশটির সরকার পাঁচ বছর মেয়াদি একটি পরিকল্পনা প্রকাশ করে।
মন্ত্রীরা ঘোষণা দিয়েছেন, প্রতি দুই বছর অন্তর ২০ থেকে ৩৪ বছর বয়সীদের জন্য সরকরি অর্থায়নে মানসিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হবে।
তবে ওয়ার্ল্ড ইনইকুয়ালিটি ডেটাবেজের তথ্য অনুযায়ী, গত তিন দশকে দেশটিতে সম্পদগত বৈষম্য বেড়েই চলেছে।
তরুণরা যে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলছেন, একে ‘পারিবারিক সমস্যা’ হিসেবে দেখছেন ব্লু হোয়েল রিকভারি সেন্টারের পরিচালক কিম ওক-র্যান।
অনেকক্ষেত্রে তরুণরা নিজেদের সমস্যার কথা পরিবারের সদস্যদেরকেও বলতে পারে না।
কিম বলেন,‘তারা বিষয়টিকে প্রকাশ্যে আনতে পারে না, ফলে বাবা-মাও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন।
"প্রায়ই তারা ছুটির দিনে পারিবারিক অনুষ্ঠানে অংশ নেয়া বন্ধ করে দেন।”
‘নজর রাখব’
যে মা-বাবারা হ্যাপিনেস ফ্যাক্টরিতে সময় কাটিয়েছেন, তারা এখন অপেক্ষায় আছেন, একদিন তাদের সন্তান স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবে।
আপনার ছেলে যদি আইসোলেশন থেকে বেরিয়ে আসে, তাকে কী বলবেন? এমন প্রশ্ন শুনে জিনের চোখে জল আসে।
কাঁপা কাঁপা গলায় বলেন, “তুমি অনেক কিছু সহ্য করেছ। এটা খুব কষ্টের ছিল, তাই না? আমি তোমাকে দেখে রাখব।”