রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে যেতে নারাজ বহু ইউক্রেনীয় পুরুষ

কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২৯ আগস্ট ২০২৩, ১০:৩০ এএম

রাশিয়ার সামরিক অভিযান শুরু হওয়ার পর এই দেড় বছরে ইউক্রেনের হাজারো সেনা হতাহত হয়েছেন। বহু সেনা টানা যুদ্ধ করতে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠেছেন। এমন পরিস্থিতিতে যুদ্ধের ময়দানে নতুন সেনা সরবরাহ করতে গিয়ে অনেকটা হিমশিম খাচ্ছে কিয়েভ। খবর: বিবিসি।
যুদ্ধ শুরুর পর ইউক্রেনের বহু নাগরিক সামরিক বাহিনীতে যোগ দিয়েছেন। অনেকেই আবার যুদ্ধ করতে নারাজ। এ কারণে হাজার হাজার মানুষ দেশ ছেড়েছেন।
অনেকেই ঘুষ দেয়াসহ নানা কৌশলে সেনাবাহিনীর নিয়োগ কর্মকর্তাদের হাত করে যুদ্ধে যাওয়া এড়িয়েছেন।এমনই একজন ইয়েহোর। নিরাপত্তার জন্য নিজের আসল নাম প্রকাশ করেননি তিনি।
ইয়েহোর জানান, তার বাবা সোভিয়েত ইউনিয়নের হয়ে আফগানিস্তান যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। এর জেরে তিনি মানসিক সমস্যায় ভুগেছিলেন। বাবার অবস্থা দেখার পর এখন তার যুদ্ধে যাওয়ার ইচ্ছা নেই।
রাশিয়ার হামলার আগে ইউক্রেনের কোনো নাগরিক সেনাবাহিনীতে কাজ না করতে চাইলে বিকল্প হিসেবে তাকে কৃষিকাজ বা সামাজিক বিভিন্ন কাজ করার সুযোগ দেয়া হতো। তবে গত বছর সামরিক আইন জারির পর সেই সুযোগ আর নেই।
এমনটা করা উচিত নয় বলেই মনে করেন ইয়েহোর। তার ভাষায়, ‘প্রত্যেকের পরিস্থিতিই আলাদা। আসলে সংবিধানে যেমনটা লেখা আছে- সব পুরুষ নাগরিকদের অবশ্যই যুদ্ধে যেতে হবে, তা এ যুগের মূল্যবোধের সঙ্গে যায় না বলে আমার মনে হয়েছে।’
সমপ্রতি ইয়েহোরকে কিয়েভে থামিয়েছিল পুলিশ। পরে তাকে সেনা নিয়োগ কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়। পুলিশের অভিযোগ ছিল, তিনি সেনাবাহিনীতে যোগদান এড়াতে চাচ্ছিলেন। তবে ইয়েহোর তাদের জানান, তিনি মেরুদণ্ডের সমস্যায় ভুগছেন। এরপর তাকে ছেড়ে দেয়া হয়। যদিও পরেরবার পার পাবেন কিনা, এ নিয়ে তার সন্দেহ রয়েছে।
ইউক্রেনে সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়া বাধ্যতামূলক করা হলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে ছাড় দেয়া হয়। যেমন শারীরিক সমস্যা থাকলে,
সন্তানকে দেখভালের অন্য কেউ না থাকলে বা অসুস্থ কারো সেবার দায়িত্বে থাকলে তিনি ওই ছাড় পাবেন। অন্যথায় কেউ সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়া এড়াতে চাইলে তার জরিমানা, এমনকি ৩ বছরের কারাদণ্ডও হতে পারে।
তবে শর্ষেতেই ভূত রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
বলা হচ্ছে, ইউক্রেনের সেনাবাহিনীতে নিয়োগের ক্ষেত্রেই বড় দুর্নীতি হচ্ছে। ঘুষ নেয়াসহ নানা অভিযোগ ওঠার পর ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর সব নিয়োগ কেন্দ্রের প্রধানদের চাকরিচ্যুত করেছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি।
ওডেসায় সেনা নিয়োগপ্রক্রিয়ায় নেতৃত্বে থাকা একজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে, স¤প্রতি তিনি দুর্নীতির লাখ লাখ ডলার খরচ করে স্পেনের দক্ষিণ উপকূলে বাড়ি-গাড়ি কিনেছেন। যদিও ওই সেনা কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি অভিযোগের বিষয়টি উড়িয়ে দিয়েছেন।
সেনা নিযুক্তির কারণে ৬০ বছরের কম বয়সিরা ইউক্রেনের বাইরে যেতে পারছেন না। এরপরও যুদ্ধে যোগ না দিতে চাওয়া হাজার হাজার মানুষ কার্পাথিয়ান পর্বতমালা পেরিয়ে রোমানিয়ায় যাচ্ছেন। যারা দেশে থাকছেন, তারা সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়া এড়াতে বিভিন্ন চ্যাটিং গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন। নিয়োগকারী সেনা কর্মকর্তারা কখন কোন এলাকায় রয়েছেন, সেই তথ্য ওই গ্রুপগুলোয় জানা যায়।
সেনা নিয়োগকারী কর্মকর্তারা বিভিন্ন এলাকায় টহল দেন। সবুজ উর্দির কারণে তারা ‘অলিভস’ নামে পরিচিত। তাদের সামনে কেউ পড়লে হাতে একটি নোটিস ধরিয়ে দেয়া হয়।
সেখানে নিয়োগ কেন্দ্রে গিয়ে নিবন্ধন করার নির্দেশনা লেখা থাকে। তবে অভিযোগ আছে, অনেককে সাক্ষাতের পরই নিয়োগের জন্য তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তাদের বাড়ি ফেরারও সুযোগ দেয়া হচ্ছে না।
ইউক্রেনের জাতীয় তথ্যভাণ্ডারে নাগরিকদের যাবতীয় তথ্য হালনাগাদ রাখার আহ্বান জানিয়েছে দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, প্রয়োজনমতো তাদের যুদ্ধে বিভিন্ন কাজে লাগানো হবে।
এ কাজে সেনা কর্মকর্তারা নিপীড়নমূলক বিভিন্ন কৌশল বেছে নিচ্ছেন বলে অভিযোগ আছে। এমনকি অনেককে মাত্র এক মাস প্রশিক্ষণ দিয়েই সম্মুখযুদ্ধে পাঠানো হচ্ছে।
তবে যুদ্ধ নিয়ে ইউক্রেনের মানুষের ভয় যে কাটছে এর আভাস পাওয়া গেছে কিয়েভের একটি ক্যাম্পে।
প্রয়োজন পড়লে রুশ সেনাদের কীভাবে মোকাবিলা করতে হবে, বেসামরিক লোকজনকে সেই প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছিল সেখানে। ওই ক্যাম্পে ছিলেন আনতোন নামের ২২ বছর বয়সি এক ছাত্র। যুদ্ধে যোগ দেবেন বলে এরই মধ্যে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন তিনি।
আনতোন বলেন, ‘যখন যুদ্ধ শুরু হয়েছিল, আমি সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। এখন আমাকে যুদ্ধে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে।’ ভীত কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে আনতোন বলেন, ‘অবশ্যই। সবাই ভয় পাচ্ছে। তবে যদি যুদ্ধ পরিস্থিতি আরো জটিল হয়, তখন আমরা কোনোভাবেই কিয়েভে বসে থাকব না।’
রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইউক্রেন প্রত্যাশার চেয়ে বেশি করে দেখিয়েছে। প্রতিরোধের মুখে পুরো ইউক্রেন দখলের স্বপ্ন ত্যাগ করতে হয়েছে মস্কোকে। এখন তারা দেশটির এক-পঞ্চমাংশ ভূখণ্ড দখলে রাখতেই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।
তবে ইউক্রেনকেও ক্ষণে ক্ষণে নিজেকে গুছিয়ে নিতে হচ্ছে। দেশের মানুষকে যুদ্ধে নামার জন্য প্ররোচিত করতে হচ্ছে। কারণ, যুদ্ধে লোকবল দরকার। তবে তিক্ত হলেও সত্য যে, যুদ্ধক্ষেত্র সবার জন্য নয়।