- শিশু ও বয়স্করা আক্রান্ত হচ্ছেন বেশি
মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ শিক্ষার্থী মনোময় মুগ্ধ। উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তির জন্য প্রস্তুতি চলছিল তার। সপ্তাখানেক আগে ঘুম থেকে উঠে তার গা গরম অনুভূত হলো। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জ্বরও বাড়তে থাকে। নাপা খেয়ে জ্বর কমানোর চেষ্টা করেও যখন ব্যর্থ হলো; তখন মুগ্ধকে নিয়ে যাওয়া হলো চিকিৎসকের কাছে। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ডেঙ্গু পরীক্ষা করানো হলে রিপোর্ট নেগেটিভ আসে।
এরই মধ্যে কেটে গেছে ৫ দিন। বমি, ডায়রিয়া ও প্রচণ্ড মাথাব্যথায় মুগ্ধ দিন দিনই কাহিল হয়ে যাচ্ছিল। অবস্থা বেগতিক দেখে মুগ্ধর মা মনোরমা দে ছেলেকে নিয়ে যান ঢাকা মেডিকেলে। ভর্তি করান। হাসপাতালে দুদিন রাখার পর মুগ্ধকে চিকিৎসক টাইফয়েড শনাক্তের জন্য ব্লাড কালচার পরীক্ষা করতে দেন। এরপর শুরু হয় মুগ্ধর টাইফয়েডের চিকিৎসা।
একই অবস্থা অনার্সপড়ুয়া জিসান রহমানেরও। জ্বর হওয়ার পর চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলে ডেঙ্গু পরীক্ষা করার পর রিপোর্ট নেগেটিভ আসে। এরপর অনেকটা নিশ্চিন্তই ছিল জিসানের পরিবার। কিন্তু থেমে থেমে জ্বরের তীব্রতা বাড়ার পাশাপাশি ক্ষুধামন্দা ও শরীর ব্যথা কিছুতেই কমছিল না জিসানের।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের বহির্বিভাগে দেখানোর পর চিকিৎসক প্রেসক্রিপশনে কিছু পরীক্ষা করানোর পরামর্শ দেন। সে অনুযায়ী পরীক্ষা করানো হলে রিপোর্টে জিসানের টাইফয়েড ধরা পড়ে। এরইমধ্যে পেরিয়ে যায় ৮/১০ দিন। পরে তাকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেলে ভর্তি করানো হয়।
দেশে ডেঙ্গু মৌসুম চলছে। ডেঙ্গুর সঙ্গে এবার রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে বাড়ছে টাইফয়েডে আক্রান্তের সংখ্যাও। ডেঙ্গুর লক্ষণের সঙ্গে মিল থাকায় ডেঙ্গুর সঙ্গে নীরবেই বাড়ছে এ রোগে আক্রান্তের সংখ্যা। মূলত জ্বরের শুরুতে চিকিৎসক ডেঙ্গুর পরীক্ষা দিচ্ছেন, পরে ডেঙ্গু শনাক্ত না হলে করানো হচ্ছে টাইফয়েড পরীক্ষা। পরীক্ষায় শনাক্ত হতে পেরিয়ে যাচ্ছে অনেকটা সময়। যা রোগীর জন্য বিপজ্জনক হয়ে পড়ছে।
চিকিৎসকরা বলছেন, টাইফয়েড জ্বর হলো একটি ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ। সালমোনেলা টাইফি ব্যাকটেরিয়ার কারণে এই রোগ হয়। সাধারণত দূষিত খাবার বা পানির মাধ্যমে এ রোগ ছড়ায়। টাইফয়েডের জীবাণু শরীরে ঢুকলে গুরুতর সব অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দ্রুত চিকিৎসা না করা হলে টাইফয়েড গুরুতর সংক্রমণ ও জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে। যা রোগীর মৃত্যুঝুঁকি বাড়িয়ে দেয় দ্বিগুণ।
চিকিৎসকদের মতে, সাধারণত শরীরে রোগের জীবাণু প্রবেশের ১০ থেকে ১৪ দিন পর টাইফয়েডের লক্ষণ দেখা দেয়। জ্বর এই রোগের প্রধান লক্ষণ, যা প্রথম চার-পাঁচ দিন কখনো বাড়ে আবার কখনো কমে। তবে কোনো সময় সম্পূর্ণ ছেড়ে যায় না। এরমধ্যে ১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত টানা জ্বর হওয়া, সঙ্গে মাথাব্যথা, শরীর ব্যথা ও শারীরিক দুর্বলতা, ক্ষুধামন্দা হওয়াসহ কারো কারো কোষ্ঠকাঠিন্য হতে পারে। শিশুদের ক্ষেত্রে ডায়রিয়া ও বমি, গা ম্যাজ ম্যাজ করাসহ কফ বা কাশি হতে পারে।
ডেঙ্গুর পাশাপাশি টাইফয়েড রোগী বাড়ার বিষয়টি স্বীকার করেন প্রখ্যাত মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও পপুলার মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. খান আবুল কালাম আজাদ। তিনি ভোরের কাগজকে জানান, তার কাছে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের মধ্যে টাইফয়েড রোগীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।
তিনি বলেন, এখন ডেঙ্গুর মৌসুম। ডেঙ্গুরোগীর পাশাপাশি টাইফয়েড রোগীও বাড়ছে। ডেঙ্গুকে আমরা অবশ্যই গুরুত্ব দেব, তবে অনান্য রোগের বিষয়টিও আমাদের গুরুত্ব দিতে হবে। ডেঙ্গুকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে কোথাও কোথাও টাইফয়েডকে অবহেলা করা হচ্ছে। রোগী যখন চিকিৎসকের কাছে যাবেন তখন ডেঙ্গুর পাশাপাশি টাইফয়েড, নিউমোনিয়া, প্রস্রাবের ইনফেকশনের বিষয়টিও এখন গুরুত্ব দিতে হবে।
দেশে টাইফডের প্রাদুর্ভাব কখন বেশি হয়- এ প্রশ্নর উত্তরে টিকাবিষয়ক জাতীয় কমিটি (ন্যাশনাল ইমিউনাইজেশন টেকনিক্যাল এডভাইজারি গ্রুপ) নাইট্যাগের এই চেয়ারম্যান বলেন, আগে ধারণা করা হতো বর্ষাকালে যেহেতু মানুষ পানির সংস্পর্শে বেশি আসে তখন টাইফয়েডে মানুষ বেশি আক্রান্ত হয়। কিন্তু এখন সারা বছরই এই রোগী পাওয়া যায়। অপরিচ্ছন্নতা, সঠিক সময়ে সঠিক নিয়মে হাত না ধোয়া, দূষিত পানি বা খাবার খাওয়ার মাধ্যমে শরীরে এই রোগের জীবাণু প্রবেশ করে। যে কোনো বয়সেই টাইফয়েড হতে পারে। তবে শিশু এবং যাদের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কম তাদের আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি।
চিকিৎসকরা বলছেন, টাইফয়েড জ্বর থেকে সুস্থ হওয়ার পর অনেকের শরীরের পিত্তথলিতে এই জীবাণু সুপ্ত অবস্থায় থেকে যেতে পারে এবং পরে বাহক হিসেবে তিনি রোগ ছড়াতে পারে। আক্রান্ত রোগীর মলের মাধ্যমে জীবাণু পরিবেশে ছড়ায়। টাইফয়েডে পরিপাকতন্ত্র ছিদ্র এবং রক্তক্ষরণ হতে পারে। মস্তিষ্ক ও অগ্ন্যাশয়ে প্রদাহ, মেরুদণ্ডে সংক্রমণ, প্লীহা বড় হয়ে যাওয়া, পিত্তথলিতে সংক্রমণ, স্নায়ুবিক সমস্যার সতো সমস্যাও দেখা দিতে পারে।
এ কারণে কোনো জ্বরকেই অবহেলা না করার পরামর্শ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ। তিনি বলেন, জ্বর আসলে কোনো রোগ নয়। এটি অন্য কোনো রোগের লক্ষণ মাত্র। সবচেয়ে সাধারণভাবে বলা যায়, দেহে কোনো জীবাণুর সংক্রমণ হলে জ্বর হতে পারে। ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস ইত্যাদির আক্রমণে মানুষ জ্বরে ভোগে।
প্রখ্যাত এই মেডিসিন বিশেষজ্ঞ বলেন, ডেঙ্গুর মতোই টাইফয়েড রোগীকে চিকিৎসার পাশাপাশি বেশি পরিমাণে তরল খাবার খেতে হবে। কারণ দীর্ঘস্থায়ী জ্বর এবং ডায়রিয়ার কারণে রোগীর শরীরে পানি স্বল্পতা দেখা দেয়। টাইফয়েডের রোগীকে পূর্ণ বিশ্রামে থাকতে হবে। জ্বর বেশি থাকলে ভেজা গামছা বা তোয়ালে দিয়ে পুরো শরীর মুছে দিতে হবে। উচ্চ ক্যালরি সমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে। প্রতিবার বাথরুম ব্যবহারের পর হাত পানি ও সাবান দিয়ে ভালো করে ধুয়ে ফেলতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো চিকিৎসক অ্যান্টিবায়োটিকের যে কোর্স দিয়েছেন সেটি সম্পন্ন করতে হবে। পানি ফুটিয়ে খেতে হবে। বাইরের খোলা কিংবা বাসি খাবার খাওয়া যাবে না।