নগদের ডিজিটাল জালিয়াতি : ৪১ পরিবেশক, ২৪ হাজার এজেন্ট ও ৬৪৩ কর্মকর্তা বরখাস্ত

কাগজ ডেস্ক
প্রকাশ: ১৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৭:৫৮ পিএম

ছবি : ভোরের কাগজ
মোবাইল আর্থিক সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান ‘নগদ লিমিটেড’ ব্যাংকে জমা করা টাকার অতিরিক্ত ৬৪৫ কোটি টাকার ই-মানি তৈরি করেছে এবং অনুমোদনবিহীন পরিবেশকদের মাধ্যমে ১ হাজার ৭১১ কোটি টাকা উত্তোলন করেছে। যদিও এটি ডিজিটাল জালিয়াতির আওতায় পড়তে পারে, তবে এখনো এ বিষয়ে কোনো মামলা দায়ের করা হয়নি। এর কারণ, মামলা দায়েরের বিষয়টি নিয়ে গত এক মাস ধরে ডাক অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ ব্যাংকের মধ্যে মতবিরোধ চলছে।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে নগদ লিমিটেডের কার্যক্রম শুরু হয়। ২০১৯ সালের ২৬ মার্চ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই এমএফএস সেবার উদ্বোধন করেন। প্রতিষ্ঠানটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়াই ব্যবসা শুরু করে এবং এর পরিচালনায় প্রথম থেকেই আওয়ামী লীগের একাধিক সংসদ সদস্য ও প্রভাবশালী ব্যক্তির হাত ছিল। এর ফলে হিসাব খোলা ও সরকারি ভাতা বিতরণে একচেটিয়া সুবিধা পায় নগদ, যা প্রতিষ্ঠানটিকে বড় ধরনের অনিয়মে জড়িয়ে পড়ার সুযোগ দেয়।
গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতিষ্ঠানটিতে প্রশাসক নিয়োগ দেয়। এর পরপরই প্রশাসক দলের পরিদর্শনে বড় ধরনের ডিজিটাল আর্থিক জালিয়াতির ঘটনা ধরা পড়ে। এ কারণে ১৮ নভেম্বর আইনি ব্যবস্থা নেয়ার জন্য ডাক অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ ব্যাংককে চিঠি পাঠান প্রশাসক। তবে এখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি এবং এ বিষয়ে একাধিক সভাও অনুষ্ঠিত হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র হুসনে আরা শিখা গণমাধ্যমকে জানান, আমরা নগদের ঘটনার ব্যাপারে অবগত। তবে, এই ঘটনায় কে মামলা দায়ের করবে, সে বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। বর্তমানে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও ডাক অধিদপ্তরের মধ্যে আলোচনা চলছে এবং আইনজীবীর মতামত নেয়া হচ্ছে। এরপরই সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
ডাক অধিদপ্তর ও থার্ড ওয়েভ টেকনোলজির মধ্যে ২০১৭ সালে হওয়া এক চুক্তি অনুযায়ী, ব্যাংকে যত টাকা জমা থাকবে ঠিক তার সমপরিমাণ ই-মানি ইস্যু করা যাবে। তবে প্রশাসক দল পরিদর্শনে দেখতে পায়, ব্যাংকে যে টাকা জমা আছে তার চেয়ে অতিরিক্ত ৬৪৫ কোটি টাকার ই-মানি ইস্যু করেছে নগদ।
এ ছাড়া নথিপত্র পর্যালোচনায় উঠে আসে, অনুমোদন ছাড়াই নগদে ৪১ পরিবেশকের মাধ্যমে ১ হাজার ৭১১ কোটি টাকা বের করে নেয়া হয়েছে। মূলত ই-মানির বিপরীতে নগদ টাকা তুলে নেয়া হয়। এসব পরিবেশকের দায়িত্ব ছিল সরকারি ভাতা বিতরণ করা। এই ডিজিটাল আর্থিক জালিয়াতির ঘটনায় ৪১ পরিবেশকের পাশাপাশি ২৪ হাজার ৯৭ এজেন্টকেও বরখাস্ত করেছেন নগদে নিযুক্ত প্রশাসক। ৩ হাজার ৮৩১টি মার্চেন্ট অ্যাকাউন্ট বা ব্যবসায়িক হিসাব বাতিল করা হয়েছে। এ ছাড়া নগদের ৬৪৩ জন বিক্রয় কর্মকর্তাকেও বরখাস্ত করা হয়েছে।
এদিকে যেসব গ্রাহক যথাযথ প্রক্রিয়া ছাড়া নগদে হিসাব খুলেছিলেন তাদের হিসাবগুলো এখন হালনাগাদ করা হচ্ছে। যথাযথভাবে হিসাব না খোলায় অনেকের হিসাব স্থগিত করা হয়েছে।
নগদে সংঘটিত অনিয়ম টাকার পরিমাণে দেশের সবচেয়ে বড় ‘ডিজিটাল আর্থিক জালিয়াতি’। তাই নগদে ফরেনসিক নিরীক্ষার সিদ্ধান্ত হয়েছে। ফরেনসিক নিরীক্ষা হলো, কোনো প্রতিষ্ঠানের আর্থিক লেনদেনের বিস্তারিত খতিয়ে দেখা, যার মাধ্যমে জালিয়াতি, অনিয়ম ও সুবিধাভোগীদের খুঁজে বের করা সম্ভব হয়।
জানা গেছে, নগদের মালিকানায় আওয়ামী লীগের নেতারা যুক্ত থাকায় তৎকালীন সরকার বিভিন্ন ভাতা বিতরণের জন্য নগদকে বেছে নিয়েছিল। আর এ সুযোগে সরকারি ভাতার একটা অংশ নিয়েও জালিয়াতি করা হয়। বিশেষ করে হিসাবে টাকা দেয়ার পর যেসব ভাতাভোগী তিন দিনের মধ্যে তা উত্তোলন করেননি তাদের টাকা তুলে নেয় নগদ।
তবে জালিয়াতির কারণে যে আর্থিক দায় তৈরি হয়েছে তা পড়ে ডাক অধিদপ্তরের ঘাড়ে। কারণ, নগদকে মোবাইলে আর্থিক সেবা প্রদানের সাময়িক অনুমতিপত্র তারাই দিয়েছে। ডাক অধিদপ্তরের পক্ষে সেবাটি পরিচালনা করে নগদ লিমিটেড, একসময় এটির নাম ছিল থার্ড ওয়েভ টেকনোলজি লিমিটেড।
বাড়ছে লেনদেনের সংখ্যা
মোবাইলে আর্থিক সেবায় বিকাশের পরই নগদের অবস্থান। দেশের দ্রুত বর্ধনশীল প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যেও নগদ একটি। দেখা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের নিযুক্ত প্রশাসক দল নগদের দায়িত্ব নেয়ার পর এটির লেনদেন বাড়ছে। যেমন, গত আগস্টে নগদের দৈনিক লেনদেন ছিল ৭৪৩ কোটি টাকা, যা বেড়ে সেপ্টেম্বরে ৮০৬ কোটি টাকা এবং অক্টোবরে ৮৭১ কোটি টাকায় উন্নীত হয়। আর নভেম্বরে তো লেনদেন এক হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। চলতি মাসেও একই রকম লেনদেন হচ্ছে।
নগদের একজন শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক দায়িত্ব নেয়ায় প্রতিষ্ঠানের গ্রাহকের স্বার্থ সুরক্ষিত হয়েছে। এতে নতুন গ্রাহক ও লেনদেন উভয়ই বাড়ছে। গ্রাহক বেড়ে এখন সাড়ে ৯ কোটি ছাড়িয়েছে।
মোবাইলে আর্থিক সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান ‘নগদ লিমিটেড’-এ বড় ধরনের জালিয়াতির অভিযোগ পাওয়া গেছে। ভুয়া পরিবেশক ও এজেন্ট দেখিয়ে প্রতিষ্ঠানটিতে আর্থিক জালিয়াতি এবং অতিরিক্ত ইলেকট্রনিক অর্থ বা ই-মানি তৈরি করা হয়েছে। এসব কারণে হিসাব মিলছে না ২ হাজার ৩৫৬ কোটি টাকার। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর বাংলাদেশ ব্যাংক নগদ পরিচালনায় যে প্রশাসক ও ব্যবস্থাপনা কমিটি বসিয়েছে, তাদের পরিদর্শনে এসব অনিয়মের তথ্য উঠে এসেছে।
অনুমোদনহীন পরিবেশক তৈরির দায়ে ছয় কর্মকর্তার একটি তালিকা চূড়ান্ত করে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়ার জন্য ডাক বিভাগের কাছে পাঠানো হয়েছে। এ ছাড়া নগদ পরিচালনায় জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে ডাক অধিদপ্তরকে চিঠি দিয়েছেন নগদে নিযুক্ত প্রশাসক মুহম্মদ বদিউজ্জামান দিদার। নগদের শীর্ষ পর্যায়ের পাঁচ কর্মকর্তাকে এর আগেই বরখাস্ত করা হয়েছিল।
নগদে যখন এসব অনিয়ম সংঘটিত হয়, তখন এর পরিচালনায় আওয়ামী লীগের একাধিক সংসদ সদস্য ও প্রভাবশালী ব্যক্তি যুক্ত ছিলেন। সবার চোখের সামনে এসব অনিয়ম হলেও চুপ ছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও ডাক অধিদপ্তর। কর্মকর্তারা বলছেন, নগদে ঘটা অনিয়ম টাকার হিসাবে দেশের সবচেয়ে বড় ‘ডিজিটাল জালিয়াতি’। তাই সিদ্ধান্ত হয়েছে, নগদে ফরেনসিক নিরীক্ষা হবে। ফরেনসিক নিরীক্ষা হলো, কোনো প্রতিষ্ঠানের আর্থিক লেনদেনের বিস্তারিত খতিয়ে দেখা, যার মাধ্যমে জালিয়াতি, অনিয়ম ও এর সুবিধাভোগীদের খুঁজে বের করা সম্ভব।
তবে জালিয়াতির কারণে যে আর্থিক দায় তৈরি হয়েছে, তা ডাক অধিদপ্তরের ঘাড়ে পড়ছে। কারণ, মোবাইলে আর্থিক সেবা দিতে যে সাময়িক অনুমতিপত্র দেয়া হয়েছে, সেটি তাদের। ডাক অধিদপ্তরের পক্ষে সেবাটি পরিচালনা করে নগদ লিমিটেড, যা একসময় ছিল থার্ড ওয়েভ টেকনোলজি লিমিটেড।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে ডাক অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এস এম শাহাব উদ্দীন গত রবিবার রাতে দেয়া লিখিত বক্তব্যে গণমাধ্যমকে জানান, এ বিষয়ে আইনি পদক্ষেপ নেয়ার কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন।
যেসব ডিজিটাল জালিয়াতি
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নিয়োগ পাওয়া প্রশাসক দল নগদ পরিচালনার পাশাপাশি আর্থিক অনিয়ম অনুসন্ধান শুরু করেন। এর ফলস্বরূপ, তারা বড় অঙ্কের ডিজিটাল জালিয়াতির বিষয়টি উন্মোচন করেন। নথিপত্র অনুযায়ী, ডাক অধিদপ্তর এবং থার্ড ওয়েভ টেকনোলজির মধ্যে ২০১৭ সালে স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুযায়ী, ব্যাংকে জমা থাকা টাকার সমপরিমাণ ই-মানি ইস্যু করার কথা ছিল। তবে প্রশাসক দল দেখতে পায়, নগদে অতিরিক্ত ৬৪৫ কোটি টাকার ই-মানি ইস্যু করা হয়েছে।
এছাড়া, প্রশাসক দল ডাক অধিদপ্তরকে জানায় যে, অনুমতি ছাড়াই নগদে ৪১টি পরিবেশক হিসাব খোলা হয়েছে, যার মাধ্যমে ১ হাজার ৭১১ কোটি টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। এসব পরিবেশক হিসাবের দায়িত্ব ছিল সরকারি ভাতা বিতরণ করা।
জানা গেছে, নগদের মালিকানায় আওয়ামী লীগের নেতারা যুক্ত থাকায় তৎকালীন সরকার ভাতা বিতরণের জন্য নগদকে বেছে নিয়েছিল। আর এ সুযোগে সরকারি ভাতার একটা অংশ নিয়ে জালিয়াতি করা হয়। বিশেষ করে হিসাবে টাকা দেয়ার পর যেসব ভাতাভোগী তিন দিনের মধ্যে তা উত্তোলন করেননি, তাদের টাকা তুলে নেয় নগদ। নথিপত্রে দেখা গেছে, কুমিল্লার পরিবেশক রংপুরের ভাতাভোগীদের অর্থ বিতরণ করেছে। ফলে এ ক্ষেত্রেও জালিয়াতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন নগদের একজন কর্মকর্তা।
নগদের প্রশাসক দল মনে করে যে অনুমোদন ছাড়াই যেসব পরিবেশক নিয়োগ করা হয়েছে, তাদের ব্যবহার করে এই জালিয়াতি করা হয়েছে। এর সঙ্গে জড়িত সন্দেহে ছয় কর্মকর্তার একটি তালিকা চূড়ান্ত করে তা ডাক অধিদপ্তরে পাঠানো হয়েছে। এ তালিকায় রয়েছেন নগদের নির্বাহী পরিচালক সাফায়েত আলম, অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আমিনুল হক, উপব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম মর্তুজা চৌধুরী, প্রধান প্রযুক্তি কর্মকর্তা আবু রায়হান, আর্থিক প্রশাসন ও পরিচালনা বিভাগের প্রধান রাকিবুল ইসলাম এবং সলিউশন ডিজাইন বিভাগের ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট নাজমুস সাকিব আকিব।
এ বিষয়ে নগদের প্রশাসক মুহম্মদ বদিউজ্জামান দিদার ৫ ডিসেম্বর ডাক অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে চিঠি দিয়ে জানিয়েছেন, ক্ষতিগ্রস্ত ও চুক্তিবদ্ধ পক্ষ হিসেবে ডাক বিভাগ এসব অনিয়ম/চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন/ক্ষতিপূরণের জন্য আইনি ব্যবস্থা নেয়ার অধিকার সংরক্ষণ করে বলে প্রশাসক দল মনে করে। প্রশাসকের আইনি ব্যবস্থা নেয়ার কোনো এখতিয়ার নেই।
গত ৫ আগস্টের পর আর অফিসে যাননি তৎকালীন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) তানভীর আহমেদ; নির্বাহী পরিচালক নিয়াজ মোর্শেদ ওরফে এলিট ও মারুফুল ইসলাম ওরফে ঝলক; উপপ্রধান মার্কেটিং কর্মকর্তা খন্দকার মোহাম্মদ সোলায়মান (সোলায়মান সুখন) এবং মানবসম্পদ কর্মকর্তা অনিক বড়ুয়া। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ২১ আগস্ট নগদে প্রশাসক বসায়। তারা দায়িত্ব নেয়ার পর এসব কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করা হয়। বরখাস্ত ব্যক্তিদের অনেকে নগদ লিমিটেডের মালিকানায়ও রয়েছেন।
যোগাযোগ করা হলে নগদের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর আহমেদ গণমাধ্যমকে বলেন, এসব অভিযোগ সঠিক নয়। আমার সময়ে ৩৪৫ কোটি টাকা ঘাটতি ছিল। এটা পরে কমে ৬০ কোটি টাকায় এসেছিল৷ অন্য কোনো অনিয়ম আমার সময়ে হয়নি।
নগদের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে গণমাধ্যমকে বলেন, ৬৪৫ কোটি টাকার অতিরিক্ত ই-মানি হয়েছে একটি ব্যাংকঋণ সমন্বয় করার কারণে। বিষয়টি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা করে কিস্তিতে সমন্বয় করা হচ্ছিল। প্রশাসক দায়িত্ব নিয়ে তা বন্ধ করে দিয়েছেন। কিছু ই-মানি ইস্যু হয়েছে পরিচালন খরচ মেটাতে গিয়ে। তিনি বলেন, ‘নগদের কার্যক্রম একরকম থমকে গেছে। নতুন করে কোনো অফার দেয়া হচ্ছে না, প্রচারণাও প্রায় বন্ধ। ব্যবস্থাপনা কমিটি ও প্রশাসক শুধু আগের ভুল ধরে চলছে।’
শুরুতেই বড় ভুল
ডাক অধিদপ্তরের নথিপত্র পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৭ সালে ডাক অধিদপ্তর পোস্টাল ক্যাশ কার্ড সেবা প্রচলনের জন্য উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান করে। পাশাপাশি এতে ডিজিটাল আর্থিক সেবার কথাও যুক্ত করা হয়। এ বিষয়ে ওই বছরের ৪ ডিসেম্বর ডাক অধিদপ্তর ও থার্ড ওয়েভ টেকনোলজির মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষর হয়। এ চুক্তিতে বলা হয়, পরিবেশন ও অন্যান্য খরচ বাদে গ্রাহক কমিশন থেকে যে আয় থাকবে, তার ৫১ শতাংশ পাবে ডাক বিভাগ ও ৪৯ শতাংশ পাবে থার্ড ওয়েভ টেকনোলজি।
এরপর ২০১৮ সালের ৮ আগস্ট ডাক অধিদপ্তর ‘নগদ’ নামে মোবাইলে আর্থিক সেবা চালুর অনুমতি চেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে আবেদন করে। শর্ত মেনে আবেদন না করার কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক অনুমোদন দেয়নি। তবে ডাক অধিদপ্তর নিজেদের আইনে পরিবর্তন এনে ২০১৯ সালের ২৬ মার্চ ‘নগদ’ নামে মোবাইলে আর্থিক সেবা চালু করে দেয়। তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেবাটি উদ্বোধন করেন। শর্ত পূরণ না করলেও ২০২০ সালের ১৫ মার্চ নগদকে অন্তর্বর্তীকালীন অনুমোদন দিয়ে ডাক অধিদপ্তরকে চিঠি দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এ সময় ব্যাংক হিসাব (ট্রাস্ট কাম সেটেলমেন্ট হিসাব) ডাক বিভাগের নামে খোলার শর্ত দেয়া হয়। তবে থার্ড ওয়েভ সে পথে যায়নি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকও কোনো তদারক করেনি। এরপরও দফায় দফায় অনুমোদনের মেয়াদ বাড়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর মধ্যে থার্ড ওয়েভ টেকনোলজি নিজেই নাম পরিবর্তন করে নগদ লিমিটেড হয়ে যায়। এককভাবে সরকারি ভাতা বিতরণ, শর্ত ছাড়া হিসাব খোলার সুযোগ ও সহজেই হিসাব খোলার সুবিধার ফলে নগদ হয়ে ওঠে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মোবাইলে আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান। সেবাটির গ্রাহক প্রায় ৯ কোটি। দিনে এক হাজার কোটি টাকার বেশি লেনদেন হচ্ছে নগদে। মোবাইলে আর্থিক সেবার চূড়ান্ত অনুমতি না পেলেও নগদকে প্রথমে আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও পরে ডিজিটাল ব্যাংক চালুর প্রাথমিক অনুমতি দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।
যারা এর পেছনে
থার্ড ওয়েভ টেকনোলজি প্রতিষ্ঠিত হয় ২০১৬ সালে, যার প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে ছিলেন তানভীর আহমেদ, কাজী মনিরুল কবির, সৈয়দ মোহাম্মদ কামাল, সৈয়দ আরশাদ রেজা ও মিজানুর রহমান। নগদ চালুর পূর্বে কিছু অংশীদার নিজেদের শেয়ার ছেড়ে দেন। এর মধ্যে কাজী মনিরুল কবির শেয়ার ছেড়ে দিলে মালিকানায় যোগ দেন আওয়ামী লীগের তৎকালীন দুই সংসদ সদস্য নাহিম রাজ্জাক ও রাজী মোহাম্মদ ফখরুল। এরপর যোগ দেন রেজওয়ানা নূর, যিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপ-প্রেস সচিব আশরাফুল আলম খোকনের স্ত্রী, তবে পরে তিনিও মালিকানা ছেড়ে দেন।
২০১৮ সাল থেকে নগদকে ডাক বিভাগের সেবা হিসেবে প্রচার করা হলেও, সরকারী এই সংস্থা নগদের মালিকানায় কখনো ছিল না এবং এখনো নেই। নগদ ও বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে নগদ লিমিটেডে নয়জন পরিচালক আছেন, যারা বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে নিবন্ধিত কোম্পানির প্রতিনিধি। এদের মধ্যে যুক্তরাজ্য, কানাডা ও সিঙ্গাপুরের একজন করে নাগরিক রয়েছেন, এবং বাকি ছয়জন বাংলাদেশি।
যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদপ্তরের (আরজেএসসি) তথ্য অনুযায়ী, নগদের শেয়ারধারী একটি কোম্পানির মালিকানায় ছিলেন নাহিম রাজ্জাক ও রাজী মোহাম্মদ ফখরুল। আর নগদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) তানভীর আহমেদ, জুনিয়র চেম্বার সভাপতি নিয়াজ মোর্শেদ ও জুনিয়র চেম্বার ঢাকার সাবেক সভাপতি মারুফুল ইসলাম রয়েছেন নগদের শেয়ারধারী একাধিক প্রতিষ্ঠানের মালিকানায়। এর মধ্যে নিয়াজ মোর্শেদ যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। ফলে নগদ পরিচিত হয়ে উঠেছিল তৎকালীন সরকারদলীয় নেতাদের একটি ক্লাব হিসেবে।
এ বিষয়ে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের সাবেক চেয়ারম্যান আনিস এ খান প্রথম আলোকে বলেন, নগদের পেছনে সব সময় বড় হাত ছিল। এ জন্য অনুমতি ছাড়া এটি এত বড় হওয়ায় সুযোগ পেয়েছে। মোবাইলে আর্থিক সেবার লাইসেন্স না পেলেও আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও ডিজিটাল ব্যাংকের অনুমতি পেয়েছিল। সবাই জানে, এর সুবিধাভোগী কে ছিল। এখন গরিব মানুষের বেহাত হওয়া টাকা যে পথে আদায় করা যায়, সরকারকে সে পথে এগোতে হবে।