তসলিম-সৌরভ প্রতারক চক্রের অন্তর্বর্তী জামিন

কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৪:৩২ পিএম

প্রতারকচক্র বাবা তসলিম হোসেন ও ছেলে সৌরভ ইয়াকুব হোসেন
প্রতারক চক্রের সদস্য বাবা এএইচএম তসলিম হোসেন আর ছেলে সৌরভ ইয়াকুব হোসেনকে বাদীর সঙ্গে মীমাংসা করার শর্তে অস্থায়ী জামিন দিয়েছে আদালত। আজ বৃহস্পতিবার নিম্ন আদালতে বাবা-ছেলে আত্মসমর্পণ করলে আদালত শর্ত সাপেক্ষে অন্তর্বর্তী জামিন দিয়েছেন। এর আগে প্রতারক এএইচএম তসলিম হোসেন তার এক বন্ধুসহ রাজধানী বসুন্ধরাতে গিয়ে বাদী জান্নাতুল ফেরদাউস মুক্তাকে মামলা তুলে নেয়ার জন্য হুমকি-ধমকি দেন। এ বিষয়েও থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করা হয়েছে।
জানা গেছে, দেশের বিভিন্ন জায়গায় নানান লোভনীয় প্রকল্প করার কথা বলে বাবা-ছেলে প্রতারকচক্র হাতিয়ে নিয়েছে কোটি কোটি টাকা। তারা আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকার কারণে এতদিন কেউ মুখ খুলতে সাহস পায়নি। অবশেষে গত ১১ নভেম্বর জান্নাতুল ফেরদাউস মুক্তা নামে একজন ভুক্তভোগী বাবা-ছেলের প্রতারণার বিষয়টি উত্থাপন করে মামলা দায়ের করেছেন। ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট নাজমিন আক্তারের আদালত মামলাটি গ্রহণ করে আসামিদের বিরুদ্ধে সমন জারি করেন। মামলা নাম্বার সিআর ৬২৯/২৪। এর আগেও বাবা-ছেলে একাধিকবার প্রতারণার অভিযোগে কারাভোগ করেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্টিল স্ট্রাকচারাল ওয়ার্কস ও হোজায়ফা ইকো ব্রিকস (সৌরভ ব্রিকস) ফ্যাক্টরির চেয়ারম্যান এএইচএম তসলিম হোসেন ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক তার ছেলে সৌরভ ইয়াকুব হোসেন। তসলিম হোসেন বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের পরিচালক ছিলেন। সরকারের ২ কোটি ১৮ লাখ টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তার বিরুদ্ধে ২০১৮ সালের ৮ আগস্ট দুদক মামলা করে (মামলা নং-২৯) এবং একই বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর তাকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে জেল হাজতে পাঠায়। এরপর সরকারি চাকরি বিধিমালা ১৯৮২ এর ১৪১ নং বিধান মোতাবেক তসলিম হোসেনকে প্রতারণার অভিযোগে সরকারি চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়।
তসলিম হোসেন কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে একমাত্র ছেলে সৌরভ ইয়াকুব হোসেনকে সঙ্গে নিয়ে যোগসাজশ ও জালিয়াতির মাধ্যমে নতুন আঙ্গিকে প্রতারণা শুরু করেন। স্টিল স্ট্রাকচারাল ওয়ার্কস ও হোজায়ফা ইকো ব্রিকস-এর ব্যবসার কথা বলে অনেক উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীদের থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। ঢাকার অদূরে সাভার-হেমায়েতপুরে ইটের বিকল্প পরিবেশবান্ধব কংক্রিট ব্লকের ফ্যাক্টরি; ঢাকা, চট্টগ্রাম, পাবনাসহ বিভিন্ন জেলায় ডেভেলপার প্রতিষ্ঠান উইন উইন কনস্ট্রাকশন; রাতে ঢাকায় খাবার সরবরাহ করার জন্য ই-কমার্সভিত্তিক ব্যবসা লেট নাইট সেবা; ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান দামওয়ালা, ভারত-বাংলাদেশে যৌথ প্রযোজনার সিনেমা নির্মাণের জন্য প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ফ্ল্যাশ এন্টারটেইনমেন্ট; লন্ডনে ম্যান-পাওয়ারের ব্যবসাসহ বিভিন্ন ব্যবসার নামে বাবা-ছেলে সাধারণ মানুষের কোটি-কোটি টাকা লোপাট করেছেন।
দেশের একটি শীর্ষ ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের মালিক পরিচয় দিয়ে এবং ওই প্রতিষ্ঠান থেকে গ্রাহকের টাকা তুলে দেয়ার নামেও নানান সময় প্রতারণা করেছেন সৌরভ ইয়াকুব হোসেন। তিনি জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের সদ্য সাবেক মহাপরিচালক এএইচএম শফিকুজ্জামানের কাছ থেকেও টাকা ধার নিয়ে সেই টাকা আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। লন্ডনে আদম ব্যবসার জন্য লন্ডন প্রবাসী একজনের সঙ্গে সৌরভের পার্টনারশিপ হয়েছিল। তারা বাংলাদেশ থেকে কয়েকশত মানুষ ইংল্যান্ডে নিয়ে যাওয়ার জন্য কাজ শুরু করেছিল। ঢাকার হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে ৩৩ লাখ টাকা ভাড়া বাকি হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে হোটেল কর্তৃপক্ষ মামলা করে এবং সেই প্রবাসী পার্টনার কারাগারে গেলেও সৌরভ পালিয়ে যায়।
এমন অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে বাবা তসলিম হোসেন এবং ছেলে সৌরভ ইয়াকুব হোসেনের বিরুদ্ধে। কিন্তু তারা আওয়ামী লীগের রাজনীতি করতেন বলে তাদের বিরুদ্ধে সরাসরি কোনো ব্যবস্থা নেয়া যাচ্ছিল না। অবশেষে গত সোমবার ঢাকার আদালতে তসলিম-সৌরভের বিরুদ্ধে মামলা করেন নারী উদ্যোক্তা জান্নাতুল ফেরদাউস মুক্তা। তিনি এজাহারে লিখেছেন, পিতা তসলিম এবং পুত্র সৌরভ নিজেদের বড় ব্যবসায়ী এবং বিনিয়োগকারী হিসেবে উপস্থাপন করেন। ২০২২ সালের ১৮ আগস্ট স্বাক্ষীদের সম্মুখে তিনশত টাকা মূল্যমানের নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে দুইজনের সঙ্গে মুক্তার একটি ব্যবসায়িক অংশীদারীত্ব চুক্তিনামা সম্পাদিত হয়। এই চুক্তি অনুযায়ী সৌরভ মুক্তার সঙ্গে একটি অংশীদারি ব্যবসা শুরু করেন যার নাম ‘লেট নাইট সেবা’। লেট নাইট সেবা মূলত অংশীদারিমূলক যৌথভাবে রাতে খাদ্য, ওষুধ এবং যন্ত্রপাতি সরবরাহ ব্যবসা পরিচালনা করবে বলে চুক্তিবদ্ধ হন। এটি একটি লিমিটেড কোম্পানি হবে এবং উভয় পক্ষ সমান হারে লাভ-লোকসানের অংশ প্রতি মাসের ১-১০ তারিখের মধ্যে বুঝে পাবে। আলোচনা সাপেক্ষে সকলেই মাসিক ভাতা পাবেন বলেও জানানো হয়।
এমন একটি লোভনীয় ব্যবসার প্রস্তাবনা দিয়ে মুক্তার সঙ্গে তসলিম হোসেন এবং ছেলে সৌরভ ইয়াকুব হোসেন স্ট্যাম্পে চুক্তি করেন এবং বিভিন্ন সময় নগদ, চেক ও ব্যাংক ট্রান্সফারের মাধ্যমে মোট ১৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা প্রদান করেন। মামলার এজাহারে টাকা প্রদানের তারিখ, চেক নাম্বার ও অন্যান্য বিবরণ উল্লেখ করা হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে এসব টাকা ফেরত চেয়ে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও পিতা-পুত্র কোনো টাকা ফেরত দেবে না এবং উল্টা মুক্তাকে ভাড়াতে খুনি দিয়ে মেরে ফেলবে বলে হুমকি দেয়। এসব ঘটনার প্রেক্ষিতে তিনি আদালতে মামলা দায়ের করেন এবং আদালতে আসামীদের বিরুদ্ধে সমন জারি করেছেন।