হাওর বিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠনের দাবি

রাসেল আহমদ, মধ্যনগর (সুনামগঞ্জ)
প্রকাশ: ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৬:৩৬ পিএম

ছবি: ভোরের কাগজ
বিশ্ব জলাভূমি দিবস উপলক্ষে গত ২ ফেব্রুয়ারি সুনামগঞ্জের দিরাইয়ে দিনব্যাপী হাওর উৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছে। বাংলাদেশ হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন অধিদপ্তরের আয়োজনে উপজেলার কালনী নদীর তীরে উজানধলের মাঠে এ উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। হাওরাঞ্চলের সাতটি জেলার ৪৯টি উপজেলার বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষ এই উৎসবে অংশ নেন। আলোচনা পর্বে সরকারি কর্মকর্তাদের পাশাপাশি হাওরাঞ্চলের সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে কথা বলেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার প্রতিনিধিরা। তারা হাওরপাড়ের মানুষের জীবনমান উন্নয়ন, প্রকৃতি ও পরিবেশের পরিকল্পিত উন্নয়নের জন্য পৃথক ‘হাওর মন্ত্রণালয়’ গঠনের দাবি জানান।
বাংলাদেশের ৬৪ টি জেলার মধ্যে সুনামগঞ্জ, নেত্রকোণা, মৌলভীবাজার, সিলেট, হবিগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় রয়েছে হাওরের অবস্থান। অর্থাৎ ৭ জেলার ৬৮ টি উপজেলায় ৪১৪ টি হাওর রয়েছে। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় হাওর হাকালুকি ও টাঙ্গুয়া।
স্থানীয়রা বলছেন, সরকারের অনেক আয়ের উৎস এই হাওর। পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য পার্বত্য বিষয়ক মন্ত্রণালয় রয়েছে। হাওরবাসীর শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ ও মৌলিক সমস্যাগুলোর জন্য হাওর মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। হাকালুকি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় হাওর। এর আয়তন ১৮ হাজার ১১৫ হেক্টর। হাওরটি মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা ৬০ শতাংশ, কুলাউড়ায় ১২ শতাংশ, ফেঞ্চুগঞ্জে ১০ শতাংশ, গোলাপগঞ্জে ১০ শতাংশ ও জুরি উপজেলা ৮ শতাংশ এলাকা নিয়ে অবস্থিত। এই হাওরে ২৭৩টি ছোট-বড়-মাঝারি বিল রয়েছে। শীতকালে এসব বিলকে ঘিরে পরিযায়ী পাখিদের বিচরণে মুখর হয়ে ওঠে গোটা এলাকা। আর প্রায় ১০০ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত টাঙ্গুয়ার হাওর বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মিঠা পানির জলাভূমি। স্থানীয়দের কাছে হাওড়টি নয়কুড়ি কান্দার ছয়কুড়ি বিল নামেও পরিচিত। এটি বাংলাদেশের দ্বিতীয় রামসার সাইট। সুনামগঞ্জের মধ্যনগরে প্রায় ৬৫ ভাগ ও অবশিষ্টাংশ তাহিরপুর উপজেলাজুড়ে বিস্তৃত টাঙ্গুয়ার হাওর। মেঘালয় পাহাড় থেকে ৩০টিরও বেশি ঝরনা এসে মিশেছে এই হাওরে।
হাওরাঞ্চলে সারাবছরে একটি মাত্র ফসল ফলে। সেই ফসলের ওপর ভিত্তি করে কৃষক সারা বছর তার জীবন-জীবিকা চালান। উজান থেকে নেমে আসা ভারতীয় পাহাড়ি ঢলে যদি নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধ ভেঙে যায়, ফসল হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যান কৃষক। যেমন- ২০১৭ সালে ও চলতি বছরে হাওরাঞ্চলের অধিকাংশ কৃষকের জমি অকাল বন্যায় পানির নিচে তলিয়ে গিয়েছিল। প্রতিবছর হাওরের জলাভূমিগুলো ইজারা দিয়ে রাজস্ব খাতে কোটি কোটি টাকা খাজনা পাচ্ছে সরকার। যদিও হাওরাঞ্চলের মানুষের জীবনমান উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে সরকার। স্থানীয়রা বলছেন, বিশাল আয়তনের ৭ জেলার ৬৮টি উপজেলার এই বিশাল হাওরবাসীর কল্যাণে পৃথক মন্ত্রণালয় স্থাপন করা সময়ের দাবি।
হাওর বিষয়ক মন্ত্রণালয় বাস্তবায়ন আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ইকবাল হোসেন বলেছেন, প্রতিবছর সরকার শত শত কোটি টাকা বরাদ্দ দিচ্ছে হাওরাঞ্চলের ফসলরক্ষা বাঁধের জন্য। পানি উন্নয়ন বোর্ডের গাফিলতির কারণে অকাল বন্যায় ফসল হারায় কৃষক। তাই হাওরাঞ্চলের টেকসই ও স্থায়ী উন্নয়নমূলক কাজের জন্য হাওর মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। হাওর মন্ত্রণালয়ের দাবিতে আমরা বিভিন্ন সময়ে সংবাদ সম্মেলন, মানববন্ধন ও বিগত সরকার প্রধান বরাবরে স্মারকলিপি দিয়েছি।
গণমাধ্যম কর্মী আল আমিন সালমান বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে যদি তিন জেলা নিয়ে পার্বত্য বিষয়ক মন্ত্রণালয় হতে পারে, তা হলে হাওরবেষ্টিত সাত জেলা নিয়ে হাওর বিষয়ক মন্ত্রণালয় কেন হবে না। হাওরের মানুষের কথা চিন্তা করে বর্তমানে রাষ্ট্রের সংস্কার কাজের দায়িত্ব পালনকারী অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে হাওর মন্ত্রণালয় স্থাপনের জোর দাবি জানাচ্ছি।
হাওরকেন্দ্রীক বেসরকারি গবেষণা ও উন্নয়ন সংস্থা 'জনাশিউশ' এর নির্বাহী চেয়ারম্যান সাজেদা আহমেদ বলেন, হাওরের সম্ভাবনা ও সংকট বহুমাত্রিক। যার অনেকগুলো সামনে আসে না।
বাংলাদেশ হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. আখতারুজ্জামান বলেছেন, প্রতিবছর পাহাড়ি ঢলের সঙ্গে এক বিলিয়ন টন পলি আসে হাওরাঞ্চলের বুকে। এতে ৫০ বছর পর হাওরাঞ্চল মরুভূমিতে পরিণত হবার সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু এটি একমাত্র সংকট নয়। হাওরাঞ্চলে বড় ধরনের ভূমিকম্পের ঝুঁকি রয়েছে। যা হাওর সভ্যতার ধ্বংসের কারণ হতে পারে।
গবেষণা বলছে, ইন্ডিয়ান, ইউরেশিয়ান এবং বার্মা তিনটি গতিশীল প্লেটের সংযোগস্থলে বাংলাদেশের অবস্থান। বাংলাদেশের দুই দিকের ভূ-গঠনে শক্তিশালী ভূমিকম্পের শক্তি জমা হয়েছে। এর একটা হচ্ছে উত্তরপূর্ব কোনে হাওরাঞ্চল অধ্যুষিত সিলেটে। এই অঞ্চলে অবস্থিত ডাউকি ফল্টে ৫-৬ মিটার চ্যুতি ঘটানোর মতো শক্তি অর্জন করেছে। এখানে আসলে একটা বড় ধরনের ভূমিকম্প আমাদের হাওরবাসীর দ্বারপ্রান্তে অবস্থান করছে। এই সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশে নেই কোন কার্যকর উদ্যোগ। কাজেই হাওরের সংকট ও সম্ভাবনা নিয়ে বিস্তৃত পরিসরে কাজ করা প্রয়োজন। এজন্যই হাওর বিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠন জরুরি।
'আমরা হাওরবাসী' সংগঠনের কেন্দ্রীয় তথ্য ও গবেষণা বিষয়ক সমন্বয়ক ফেরদৌস আলম বলেন, ২০১২ সালে ১৬ মার্চ টাঙ্গুয়ার হাওরপাড়ের শ্রীপুর দক্ষিণ ইউনিয়নের লামাগাঁও গ্রামে হাওর অঞ্চলের সামগ্রিক উন্নয়নের দাবিতে নাগরিক সমাবেশে হাওরবাসীর জন্য মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠার দাবি জানাই। এরপর ২০১৩ সালে ঢাকার শওকত ওসমান মিলনায়তনে হাওরাঞ্চলের সার্বিক উন্নয়নে প্রথম ‘হাওর মন্ত্রণালয়’ গঠন শীর্ষক সেমিনারের মাধ্যমে বিষয়টি তুলে ধরি। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রয়াত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও রাষ্ট্র বিজ্ঞানী ড. এমাজ উদ্দিন আহমেদ।
হাওর গবেষক ও লেখক সজল কান্তি সরকার বলেন, প্রতিবছর আমাদের হাওরের সাত জেলা থেকে সরকার কোটি কোটি টাকা রাজস্ব পায়। সরকারের অনেক আয়ের উৎস রয়েছে হাওরে। তাই হাওরবাসীর শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ ও মৌলিক সমস্যাগুলোর জন্য হাওর মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন।
‘আমরা হাওরবাসী’ সংগঠনের কেন্দ্রীয় সমন্বয় কমিটির প্রধান সমন্বয়ক রুহুল আমিন বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে গঠিত বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের লক্ষ্য রাষ্ট্র সংস্কার ও সকল ক্ষেত্রে বৈষম্য দূরীকরণ। বাংলাদেশের ভেতরে ভৌগলিক কারণেই পশ্চাৎপদ জনপদ হাওরাঞ্চল ও পার্বত্য এলাকা। পার্বত্য এলাকার সামগ্রিক উন্নয়নে পৃথক মন্ত্রণালয় থাকলেও দুই কোটি মানুষের জনবসতি এই হাওরাঞ্চলের উন্নয়নে কার্যকর পদক্ষেপ ইতোপূর্বে কোনো সরকার নেয়নি। বর্তমান সরকার রাষ্ট্রের সকল নাগরিককে যদি বৈষম্যহীন একটি রাষ্ট্র ও সকলের জন্য আর্থ-সামাজিক সমতা নিশ্চিত করতে চান— তাহলে হাওরাঞ্চলকে নিয়ে বিশেষভাবে ভাবতে হবে। এজন্য আমরা একটি পৃথক মন্ত্রণালয় গঠনের দাবি জানাই।