পাবনায় ৫০ বিঘা ফসলি জমি দখল করে ইটভাটা, অভিযোগ করেও হচ্ছেনা সুরাহা

কাগজ ডেস্ক
প্রকাশ: ০৫ জুন ২০২৪, ০৬:৫৫ পিএম

মেসার্স মাষ্টার ব্রিকস ইটভাটা। ছবি: সংগৃহীত
পাবনার বেড়া উপজেলার আমিনপুর সিন্দুরীয়া গ্রামে অবৈধভাবে প্রায় ৫০ বিঘার মতো ফসলি জমি দখল করে ৫টি ইটভাটা তৈরি করেছেন প্রভাবশালীরা। এলাকাবাসী বিভিন্ন সময়ে ইটভাটাগুলো বন্ধে জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত অভিযোগ জানালেও প্রশাসন তেমন কোনো ব্যবস্থাই গ্রহণ করেনি। অভিযোগ রয়েছে, ইটভাটা নিয়ে ওসি থেকে ডিসি পর্যন্ত রয়েছে ভয়াবহ সিন্ডিকেট। ফলে ৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে প্রশাসনেকে মোটা অংকের টাকা দিয়ে টিকে আছে ইটভাটাগুলো।
সরেজমিনে দেখা গেছে, ফসলি জমি দখল ও এলাকার বিভিন্ন ফসলি জমির মাটি কেটে অবৈধভাবে চলছে ৫টি ইটভাটা। এই ইটভাটাগুলোর কারণে এলাকায় ফসলি জমির পরিমাণ যেমন কমেছে, তেমনি ভাটার ধোঁয়ার কারণে পরিবেশ হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে এবং সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যগত সমস্যা দেখা দিয়েছে।
এই ৫টি ইটভাটা হচ্ছে- মাস্টার্স ব্রিকস, সততা, সততা প্লাস, একতা ও মণ্ডল ভাটা। মাস্টার্স ব্রিকসের মালিক আব্দুল আলিম ও রাজ্জাক মাস্টারসহ প্রায় ১০ জন, সততার মালিক হানিফ মোল্লা, একতা মালিক মঞ্জু মণ্ডল ও মণ্ডল ইটভাটার মালিক কাবুল মণ্ডল। এসব ইটভাটার কোনো অনুমোদন নেই। শুধু পেশিশক্তি ও রাজনৈতিক আশ্রয়ের জোরে ৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে টিকে আছে ইটভাটাগুলো।
এদিকে বিভিন্ন সময়ে বহুবার দেশের জাতীয় দৈনিকগুলোতে এ বিষয়ে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। এলাকাবাসী জেলা প্রশাসক ও পরিবেশ অধিদপ্তরে অভিযোগ দিলে তারা সতর্ক করে জরিমানা করে সময় দিলেও বন্ধ হয়নি এসব অবৈধ ভাটা।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, জোর করে তাদের ফসলি জমি দখল করে ইটভাটাগুলো করা হয়েছে। তারা জেলা প্রশাসককে অভিযোগ দিলেও তেমন কোনো কাজে আসেনি। প্রশাসন তেমন কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি। এ ছাড়া কেউ অবৈধ এসব ভাটা বন্ধের জন্য ডিসি অফিসে অভিযোগ দিলে তাদের মারধর করা হয় ও প্রাণনাশের হুমকিও দেওয়া হয়। এ জন্য ভয়ে অনেকে কথা বলতে চান না।
মাস্টার্স ব্রিকস ইটভাটার শেয়ার রয়েছে আব্দুল আলিমের। সম্প্রতি তার মারধরের শিকার হয়েছেন তারই চাচাতো ভাই শরীফ। এই ভাটায় চোঙ যেখানে বসানো হয়েছে, সেখানে শরীফের এক বিঘার বেশি জমি রয়েছে। শরীফের বড় বোন শিউলি জানান, শুধু ইটভাটা নয়, তারা আমার আরও বেশ কয়েকটা জমি দখল করে রেখেছেন। একটি জমি দখলে নিয়ে বাড়িও বানিয়েছেন।
তিনি আরো জানান, আমার বাবা ছিলেন শ্বাসকষ্টের রোগী। এই ভাটার কারণে তিনি প্রচণ্ড কষ্টে ছিলেন। গত জানুয়ারিতে তিনি মারা গেছেন। জমি দখলের প্রতিবাদ করলে আলিম এর আগেও বেশ কয়েকবার আমাদের বাড়িতে হামলা করে ঘরের দরজা ও বিভিন্ন আসবাবপত্র ভাঙচুর করে।
ইটভাটার পাশে বাড়ি ও মুদি দোকান রয়েছে ফজের খার। তিনি বলেন, বাড়িতে ভাটার ধোঁয়া ঢোকে। ধোঁয়ার কারণে আমাদের প্রায় সবাই শ্বাসকষ্টের রোগে ভুগছি। এ ছাড়া ফসল, আম, জাম, কাঁঠাল কিছুই হয়নি এ বছর।
ফজেরের বাড়ির পাশেই বাড়ির খলিল বলেন, ভাটার মালিকরা সবাই সন্ত্রাসী। তাদের কাছে খুন-গুম কোনো বিষয় নয়। তাই ধোঁয়া সমস্যা হলেও কিছু করার নেই। তাদের বিরুদ্ধে বলতে গেলে এখানে বসবাস করতে পারব না।
বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ইটভাটার কারণে ফসলি জমি ধ্বংস হয়। যেখানে ইট পোড়ানো হয়, সেখানকার মাটি পুড়ে যায় ও উর্বরতা নষ্ট হয়। ফলে সেখানে ১০০ বছরেও আর ফসল উৎপাদন করা সম্ভব হয় না।
এ ছাড়া ইটভাটার ধোঁয়া ও ভাটায় চলাচল করা বালুর ট্রাকের ধোঁয়ার কারণে অন্য জমিগুলোতে ফসল হয় না। বায়ুদূষণ হয়। পোড়ানো ইটের ক্ষুদ্র কণাগুলো থেকে মানুষের চোখে সমস্যা, শ্বাসকষ্ট ও চুলকানি হয়ে থাকে। এ ছাড়া ইটভাটার প্রচণ্ড তাপের কারণে আশপাশে পশুপাখি থাকে না, সব মিলিয়ে স্বাস্থ্যের প্রচণ্ড ক্ষতি হয়।
আর কয়লা দিয়ে ইট পোড়ানোর কথা থাকলেও, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই লাকড়ি ব্যবহার করা হয়- যা আরো মারাত্মক ক্ষতিকর। ইটভাটাগুলোতে নিম্নমানের জ্বালানি ব্যবহারের ফলে ক্ষতিকর কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গত হয়।
এ বিষয়ে পাবনা জেলা প্রশাসক মু. আসাদুজ্জামান (কালেক্টর ও বিজ্ঞ জেলা ম্যাজিস্ট্রেট) বলেন, ফসলি জমির মাটি কাটা ও ইটাভাটা করা সম্পূর্ণ নিষেধ। ফসলি জমিতে ইটভাটা চলছে এমন অভিযোগ পেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নিয়ে থাকি। এ ক্ষেত্রে যে যত ক্ষমতাশালীই হোক না কেন, কাউ ছাড় দেয়া হয় না।
অন্যদিকে মোটা অংকের টাকা খেয়ে প্রশাসনের কতিপয় কর্মকর্তা ইটভাটাগুলো সচল রেখেছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। এ অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ডিসি জানান, সুনির্দিষ্টভাবে অভিযোগ দিলে তদন্ত করে দেখা হবে। তদন্তে কোনো কর্মকর্তা জড়িত থাকলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।