মধ্যনগরের হাওরে ঝুঁকিতে জীববৈচিত্র্য!

রাসেল আহমদ, মধ্যনগর (সুনামগঞ্জ) থেকে
প্রকাশ: ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০১:৫০ পিএম

প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা হাওর, বিল ও নদীর পাড়কে বলা হয় ‘কান্দা’। হাওরের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় এই কান্দা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
কিন্তু সুনামগঞ্জের মধ্যনগর উপজেলায় বিভিন্ন হাওরে ফসল রক্ষা বাঁধে মাটি দিতে সেই ‘কান্দার’ মাটি কেটে নেয়া হচ্ছে।
ফসলহানি ঠেকাতে গিয়ে ঝুঁকিতে ফেলা হচ্ছে হাওরের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যকে। হাওর বিধ্বংসী বেকু মেশিনের তাণ্ডবে একের পর এক কান্দা রূপ নিচ্ছে ডোবা-নালায়।
অপরিকল্পিত কর্মকাণ্ডে ঝোপঝাড়-জঙ্গল ও প্রাণবৈচিত্র্যে ভরপুর কান্দা এখন মৃত্যুপুরীর পথে এগিয়ে চলেছে। হাওরের কান্দা এভাবে কাটা হলে শুধু জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হবে তা নয়, হাওরপারের কৃষকেরাও গভীর সমস্যায় ভুগবে। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে সহসাই পরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণে মনোযোগ দেয়ার তাগিদ সচেতন মহলের।
মধ্যনগরের বিভিন্ন হাওর এলাকা ঘুরে দেখা যায়, পিআইসির (প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি) লোকজন হাওর রক্ষা বাঁধে মাটি ফেলতে মহাধুমধামে কাটছে হাওরের বস্তি কান্দা। ইঞ্জিনচালিত বেকু মেশিন দিয়ে প্রকৃতির ওপর জোর-জবরদস্তি চালিয়ে কান্দার পর কান্দায় খানাখন্দের সৃষ্টি করা হচ্ছে।
কিছুদিন আগেও যেখানে ছিল গো চারণ ভূমি, সেই জায়গা এখন ডোবা-নালায় রূপান্তরিত হয়েছে। কান্দা কর্তনের এমন অশুভ কর্মকাণ্ড চলতে থাকলে নিকট ভবিষ্যতে কৃষকের কাজে নানা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিসহ নিশ্চিতভাবে জীববৈচিত্র্যে বিরূপ প্রভাব পড়বে।
আরো পড়ুন: ৯৯৯ কল করে উদ্ধার হলো হারিয়ে যাওয়া ৩১ কিশোর
হাওরপারের কৃষকরা জানান, কান্দা হচ্ছে হাওরের প্রাণ। হিজল-তমালসহ নানা জাতের উদ্ভিদ জন্মে এই কান্দায়। এখানে অযত্নে বেড়ে ওঠা গাছগাছালি ও ঝোপঝাড়ে আশ্রয় নেয় নানা প্রজাতির পাখি এবং বন্যপ্রাণী। কৃষকের ফসল মাড়াই থেকে শুরু করে ধান ও খড় শুকানোর কাজে ব্যবহৃত হয় কান্দা। গোচারণ ভূমি হিসেবেও কান্দার বিকল্প নেই। হাওরের কান্দা একসঙ্গে এতকিছুর সংস্থান করলেও তা রক্ষার বদলে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে দাঁড় করানো হচ্ছে।
প্রতি বছর অপরিকল্পিত ও দায়সারাভাবে নির্মিত বাঁধের মাটি হাওরে গিয়ে পড়ছে। তাতে হাওর ভরাট হয়ে পানি ধারণক্ষমতা কমে যাচ্ছে। ফলে অল্প বৃষ্টিতে পানি ফুলেফেঁপে হাওর উচ্চ ঝুঁকিতে পড়ছে। এ অবস্থায় হাওরে পরিকল্পিত টেকসই বাঁধ নির্মাণে নজর দেয়ার দাবি কৃষকসহ হাওর সচেতন মানুষের।
উপজেলার বোয়ালার হাওরের কৃষক জমশেরপুর গ্রামের গোপেশ চন্দ্র সরকার। গত বছর দুয়েক হলো বোয়ালার হাওরের পতিত কান্দায় নিজ উদ্যোগে লাগিয়েছেন সহস্রাধিক হিজল- করচের চারা। দুই বছরে সেই চারা মেলেছে ডাল-পালা। স্থানীয়রা এর নাম দিয়েছেন 'গোপেশবাগ'।
হাওরপ্রেমী এই কৃষক বললেন, আমাদের হাওরে একসময় অসংখ্য কান্দা ছিল। গেল সাত আট বছর হয় বাঁধের কাজে মাটি নিতে নিতে কান্দা কেটে বিনাশ করা হচ্ছে। শঙ্কা প্রকাশ করে তিনি আরও বলেন, 'হাওরের জীববৈচিত্র্য রক্ষা একান্ত প্রয়োজন। কান্দা কাটার মাটি বাঁধে ফেলায় তা নদী-হাওর দুইদিকে পড়ে ভয়ংকর বিপদ ডেকে আনছে। অদূর ভবিষ্যতে কান্দা বিলুপ্তির কারণে হাওরবাসীকে আরেক যুদ্ধে নামতে হবে।'
শালদিঘা হাওর পাড়ের কৃষক দ্বিজেন্দ্র তালুকদার বলেন, কৃষক হাওরে ধান লাগিয়ে কান্দায় হিজল-করচের ছায়ায় বসে। সেখানে গরু-বাছুরের ঘাস খাওয়ানো থেকে শুরু করে সব কাজই করা হয়। কান্দার ঝোপ-ঝাড়ে ওয়াপ, শিয়াল, বিভিন্ন জাতের পাখি নিরাপদে চলাফেরা করে। কিন্তু এইভাবে কান্দা কাটা হলে সবদিক থেকেই ক্ষতি হবে। কান্দা না কেটে বিকল্প পদ্ধতি গ্রহণ করা দরকার।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপপরিচালক বিমল চন্দ্র সোম বলেন, জেলায় আড়াই থেকে তিন হাজার হেক্টর কান্দা ভূমি আছে। এগুলোতে বন বাদালি কমেছে। তবে কোন কোন কান্দায় হিজল-করচের বাগান আছে এখনো। কৃষকের বীজতলার কাজে ব্যবহৃত হয় এখন কান্দা। হাওরের কান্দা ও গোচারণ ভূমি রক্ষার বিষয়টি এখন চিন্তার বিষয়। প্রতিবছর এভাবে কান্দা কেটে বাঁধ দেওয়া হলে আগামী এক দশক পর হাওরে মাটি সংকট দেখা দেবে। আমরাও বলছি, এখন আর কান্দা কেটে মাটি নয়, স্লুইস গেট বা রাবার ড্যাম করতে হবে। এজন্য বিভিন্ন সভায় প্রস্তাব করছি আমরা।
সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মামুন হাওলাদার ভোরের কাগজকে বলেন, ফসল বাঁচাতে হলে বাঁধ দিতে হবে। হ্যাঁ, হাওরে এখন মাটির সংকট চলছে। আগামী দিনে সংকট আরও ঘনীভূত হবে। কান্দা না কেটে বিকল্প হিসেবে কি করা যায় এ নিয়ে আমরাও ভাবছি। এজন্য স্থায়ী বাঁধের চিন্তা করা হচ্ছে। এটা হলো, বাঁধের ওপরের অংশ সিসি ব্লক দিয়ে মুড়িয়ে দেয়া হবে। তখন কান্দা কেটে হাওরকে ক্ষতিগ্রস্ত করা লাগবেনা।