কালো আইনের ফাঁদে বিজিবি সদস্য

কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৩ মার্চ ২০২৩, ০১:২৩ পিএম

ছবি: ভোরের কাগজ
একটি গ্রাম, তিনটি গ্রুপ (সমাজ)। একে অপরের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ হয় প্রতিদিন। স্থানীয় বাজারে পরস্পরের আড্ডা, এমনকি চা-বিস্কুট খাওয়ার রেওয়াজও রয়েছে। তবে সেখানে বলবৎ রয়েছে প্রাচীনকালের মতো একটি ‘কালো আইন’। যে আইনে, এক সমাজের মানুষ অন্য সমাজে দাওয়াত দিতে বা খেতে পারবেন না; এমনকি মৃত ব্যক্তির দাফন-কাফন বা সৎকারে অংশ নিলে পেতে হবে শাস্তি! সেই আইনের রোষানলে ভাতিজির বিয়ের দাওয়াত খেয়ে শাস্তি পেয়েছেন এক বিজিবি সদস্য।
রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার গণিপুর ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডে ওই গ্রামটির অবস্থান। নাম ‘নামাজগ্রাম’। দেশের গ্রামাঞ্চলে ইসলাম ধর্মের রেওয়াজ মোতাবেক কোরবানির গোশত বা ফিতরা বণ্টনের জন্য বেশ কয়েকটি পরিবার নিয়ে একটি করে গ্রুপ করা হয়। এলাকায় সেটি ‘সমাজ’ হিসেবে পরিচিত।
বাগমারার নামাজগ্রামে রয়েছে এ রকম তিনটি সমাজ। সেখানে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান না থাকলেও তিন সমাজে রয়েছে তিনটি মসজিদ। গণিপুর ইউপির ৩ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য মিজানুর রহমান মজনুর বাড়ি ওই গ্রামে। তার সমাজে রয়েছে প্রায় ৬০টি পরিবার। আর বাকি দুটি সমাজের পরিবার সংখ্যা ৬০।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, এলাকায় ‘কালো আইন’ শক্তভাবে প্রয়োগে ইউপি সদস্য মজনুর নেতৃত্বে রয়েছে একটি চক্র। এ চক্রের অন্যতম সদস্যরা হলেন- ইউপি সদস্যের ভাই মো. মোস্তাক, জামাল ও ফিরোজ। প্রায় ২০ বছর আগে অভ্যন্তরীন দ্বন্দ্বের জেরে সমাজ তিনটি ভাগে বিভক্ত হয়। ওই সময় আইন তৈরি করে দাওয়াত খাওয়া, বিয়ে বা সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশ নিতে নিষেধ করা হয় কঠোরভাবে। এমনকি ইউপি সদস্যের সমাজের কেউ মারা গেলে অপর দুই সমাজের কেউ দাফন-কাফন বা সৎকারে অংশ নিতে পারবেন না, তাদের জানাজার নামাজেও ইউপি সদস্যের সমাজের লোকজন যেতে পারবেন না বলেও আইন করা হয়।
সূত্র জানায়, গত বছর থেকে এ আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ শুরু করেন ইউপি সদস্য মজনু। সবশেষ গত ১৭ ফেব্রুয়ারি স্থানীয় এক নারীর বিয়ের দাওয়াত খাওয়াকে কেন্দ্র করে তিনি সালিস ডাকেন। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে ৯টার ওই সালিসে প্রতিপক্ষের সমাজ থেকে প্রায় ৬ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করেন তিনি। সেখানে হুসেন আলী নামে এক বিজিবি সদস্যকেও জরিমানা করা হয়। পরে তারা থানায় একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন।
এ বিষয়ে বিজিবি সদস্য হুসাইন আলী ভোরের কাগজকে বলেন, ‘অপর সমাজে দাওয়াত খাওয়া যাবে না, কাজ করা যাবে না, কেউ মারা গেলে মাটিও দেয়া যাবে না; যদি কেউ যায় তাহলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে- এমন আইন চালু রয়েছে। এর আগে সাধারণ মানুষকে অনেকবার জরিমানা করা হয়। সবশেষ আমার নিজের ভাতিজির (ভাইয়ের মেয়ে) বিয়ে খেতে বাধা দেয়া হয়। তবে সেই বিয়ে খাওয়ায় সালিস বসিয়ে আমাদের জরিমানা করেছেন ইউপি সদস্য মজনু ও সমাজের মাতুব্বররা। এ সময় তারা আমাকে অনেক গালিগালাজ করেন। এ ঘটনায় আমরা থানায় অভিযোগ দিয়েছি।’
আনসার ব্যাটেলিয়নে কর্মরত শামসুল ইসলাম নামে ওই গ্রামের এক বাসিন্দা বলেন, ‘নিজের ভাইয়ের বাসায় নিজের ভাই খেতে পারবে না, কেউ মারা গেলে অন্য সমাজের মানুষ আরেক সমাজে মাটি দিতে পারবে না, এগুলা নিয়ম বানাইছে। এগুলা কুসংস্কার। বিজিবি সদস্য হুসেন তার ভাইয়ের বাসায় খেয়েছে, সে জন্য তাকে জরিমানা করেছে। এক গ্রুপ আছে উগ্র মেজাজি, তারা গালমন্দ করে। আমি ছুটিতে বাসায় এসে এসব দেখেছি।’
মাহবুবুর রহমান নামে এক মাদরাসা শিক্ষক বলেন, অসভ্য সমাজে বর্বর আইনটা চলছিল। ১০ বছর আগে আমরা শিক্ষিতরা আইনটা উচ্ছেদের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হই। মেম্বার সবশেষ আইন করেছেন, ‘অন্য সমাজের কেউ মারা গেলে জানাজা নামাজে অংশ নিতে পারবে না।’
এ ব্যাপারে অভিযুক্ত ইউপি সদস্য মিজানুর রহমান মজনু ভোরের কাগজকে বলেন, ‘এলাকায় এরকম কিছু হয়নি, তবে মতানৈক্য রয়েছে। ওজু করেছি, নামাজে যাব। অন্যায় করব না, প্রশ্রয়ও দেব না।’
জানতে চাইলে বাগমারার গণিপুর ইউপি চেয়ারম্যান মো. মনিরুজ্জামান ভোরের কাগজকে বলেন, ‘এ রকম কথা শুনেছি। তারা থানায় গেছে; থানা কী করবে, করুক।’
আর বাগমারা থানার ওসি আমিনুল ইসলাম ভোরের কাগজকে জানান, ‘সমাজে প্রথা ছিল, তবে ডেকে বলা হয়েছে। তারা এমন ভুল আর করবে না। আবার খোঁজখবর নেব।’