হুমকিতে পোশাক শিল্প

কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২৫ অক্টোবর ২০২৪, ০২:০৩ পিএম

ছবি: সংগৃহীত
সাম্প্রতিক সময়ে শ্রমিক অসন্তোষে দেশের তৈরি পোশাক শিল্প খাতে ছিল অস্থিরতা। সাভার, আশুলিয়া ও নারায়ণগঞ্জের শিল্পাঞ্চলে বেতন বৈষম্যসহ বিভিন্ন দাবিকে শ্রমিক অসন্তোষের প্রধান কারণ হিসেবে ধরা হয়। কিন্তু এর পেছনে ছিল রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সুযোগে ব্যক্তিস্বার্থ, যা পোশাক খাতে নৈরাজ্য তৈরি করে। রাজনৈতিক দলের নামে বিশেষ স্বার্থান্বেষী মহলের ব্যক্তিগত লাভের কাছে হুমকির মুখে পড়েছে তৈরি পোশাকের মতো দেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানিমুখী খাত।
সংশ্লিষ্টদের মতে, দেশের তৈরি পোশাক খাতে অস্থিরতার পেছনে রয়েছে একাধিক কারণ। যার মধ্যে রয়েছে ঝুট ব্যবসা নিয়ে দ্বন্দ্ব, মালিকানার সমস্যা, শ্রমিকদের বকেয়া পাওনা, কোনো কোনো জায়গায় বহিরাগতদের উস্কানি এবং শ্রমিকদের নতুন কিছু দাবি দাওয়া। বাংলাদেশ ন্যাশনাল লেবার ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক মরিয়ম আক্তারের মতে, শ্রমিক অসন্তোষ সৃষ্টির নেপথ্যে বহিরাগত প্রভাব কাজ করেছে। তিনি জানান, ঝুট ব্যবসা নিয়ে একটা সমস্যা; আগে যারা ছিল তাদের জায়গায় নতুন লোকজন এই ব্যবসা নিতে চায়। এ ছাড়া কিছু বহিরাগত সমস্যা ছিল। আর আন্তর্জাতিক কিছুটা চাপ থাকেই। যারা চায় আমাদের দেশ থেকে এই শিল্পটা আরেক দেশে যেন চলে যায়।
সাভার-আশুলিয়া-গাজীপুর এলাকায় প্রায় ৪১৭টি পোশাক কারখানায় দীর্ঘদিন অস্থিরতার কারণে বন্ধ ছিল। একই অস্বাভাবিক পরিস্থিতি বিরাজ করেছে নারায়ণগঞ্জ শিল্পাঞ্চলে। তৈরি পোশাক খাতে নৈরাজ্য সৃষ্টিকারী মহলটি তাদের রাজনৈতিক প্রভাবও কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে। এই বিষয়ে সম্প্রতি একটি জাতীয় গণমাধ্যমে বিস্তারিত প্রতিবেদনও প্রকাশ হয়। সেখানে দেখা যায়, ৫ আগস্ট পটপরিবর্তনের পর বিএনপির কেন্দ্রীয় ও মাঠপর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ বেশ কয়েকজন নেতার বিরুদ্ধে নানা ধরনের অভিযোগ ওঠে। যাদের অনেকের বিরুদ্ধে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা ইতোমধ্যে ব্যবস্থা নিয়েছে। তবে নারায়ণগঞ্জ শিল্পাঞ্চলে অভিযুক্তদের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত বিএনপির কেন্দ্রীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদকের বিরুদ্ধে নারায়ণগঞ্জে রপ্তানিমুখী পোশাক প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ফকির গ্রুপের কাছ থেকে সুবিধা দাবি করার অভিযোগ উঠেছে।
আরো পড়ুন: শুল্ক ছাড়েও বাড়তি তেল-চিনির দাম
নারায়ণগঞ্জ বিএনপির স্থানীয় নেতাকর্মী ও শিল্প মালিকদের সঙ্গে কথা বলে তার সম্পর্কে আরো অনেক অভিযোগ পাওয়া গেছে। অনুসন্ধানে জানা যায়, আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে নারায়ণগঞ্জে কমপক্ষে ১৫টি কারখানা ও টেক্সটাইল মিলে তালা দিয়ে জোরপূর্বক চাঁদা আদায় করা হয়। এ ছাড়াও কমপক্ষে ৪০ ব্যক্তিকে মারধর, জখম, বাড়িঘর বা আসবাবপত্র ভাঙচুর, হত্যার হুমকি, বাড়িঘরে তালা দিয়ে অর্থ আদায়ের অভিযোগ উঠেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলার দুপ্তারা ইউনিয়নে অবস্থিত একটি তৈরি পোশাক কারখানা মালিক জানান, চাঁদার টাকা দিয়ে আপাতত নিজের কারখানা রক্ষা করেছেন তিনি। তিনি আশঙ্কা করেন, চাঁদা না দিলে হয়তো শত কোটি টাকা মূল্যের কারখানাটিতে অগ্নিসংযোগ করা হতো।
বিএনপির কেন্দ্রীয় এই নেতাকে নিয়ে নিজ দলের নারায়ণগঞ্জের স্থানীয় নেতাকর্মীরাও দ্বিধাগ্রস্ত। বিদেশে লোক পাঠানো, নিজের ব্যবসা থেকে মুনাফা ও সুদ দেয়ার টোপ ফেলতেন বলে নানান গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে অভিযোগ করা হয়।
৫ আগস্ট পরবর্তী আড়াইহাজার উপজেলার সাতগ্রাম, কালাপাহাড়িয়া, দুপ্তারা, বিশনন্দী ও হাইজাদী ইউনিয়ন এবং গোপালদি ও আড়াইহাজার পৌরসভায় অবস্থিত কিছু নির্দিষ্ট শিল্পকারখানায় তার উদ্যোগে একদল কর্মী তালাবদ্ধ করার অভিযোগ পাওয়া যায়। অনেক ব্যবসায়ী নিজ প্রতিষ্ঠান রক্ষার স্বার্থে আপসের মাধ্যমে কারখানা রক্ষা করেন।
আরো পড়ুন: কৃষিপণ্য ছাড়াই ‘স্পেশাল ট্রেন’ দিনাজপুর থেকে ফিরে এলো ঢাকায়
কথিত চাঁদা এবং সুযোগ-সুবিধা না দেয়ার অসম্মতিতে তার রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হন ফকির নিটওয়্যারস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফকির আখতারুজ্জামান, ফকির ফ্যাশন লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফকির কামরুজ্জামান নাহিদ এবং উপব্যবস্থাপনা পরিচালক ফকির মাশরিকুজ্জামান নিয়াজ। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সুযোগে জুন মাসে সংঘটিত একটি নিহতের ঘটনা আগস্ট মাসে দেখিয়ে ফকির আখতারুজ্জামানের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করা হয়।
এ বিষয়ে ফকির গ্রুপের জেনারেল ম্যানেজার সুমন কান্তি সিংহ বলেন, ফকির নিটওয়্যার তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে সুনামের সঙ্গে পোশাক রপ্তানি করে আসছে। নারায়ণগঞ্জ শিল্পাঞ্চলে গেল অর্থবছরের সর্বোচ্চ করদাতাদের মধ্যে এই শিল্পগোষ্ঠী অন্যতম। ব্যবসা ও অর্থনীতিতে অবদান রাখছেন এমন একজন সিআইপিকে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সুযোগে হত্যা মামলার আসামি করা এবং অন্যান্য পরিচালকদের সুনাম নষ্ট করা দেশের ব্যবসায়ীদের জন্য অনেক বড় অশনিসংকেত। সরকারের উচিত তৈরি পোশাকসহ অন্যান্য শিল্পকে সুরক্ষা দিতে বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন করা; দেশের ব্যবসা ও অর্থনীতি রক্ষা করা। এসব সুযোগসন্ধানী রাজনৈতিক দলের নাম ভাঙিয়ে দেশ ও দেশের মানুষের ক্ষতি করার চেষ্টা করছে। এসব বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সচেতন থাকা উচিত। এসব বিষয়ে স্থানীয় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, জেলা প্রশাসক, এমনকি প্রধান উপদেষ্টা বরাবর লিখিত অভিযোগ জানানো হয়েছে।
অভিযোগের বিষয়ে বিএনপির ওই নেতার সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও কথা বলা সম্ভব হয়নি।