ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক: কোমর পানিতে দুর্ভোগের ১৬ ঘণ্টা

কাগজ ডেস্ক
প্রকাশ: ২৪ আগস্ট ২০২৪, ০৮:১৮ এএম

ছবি: সংগৃহীত
কক্সবাজার ঘুরতে গিয়েছিলেন কুমিল্লার এক পর্যটক বন্যার খবর পেয়ে বৃহস্পতিবার (২২ আগস্ট) সকালে বাড়ির উদ্দেশে রওনা দেন।
কিন্তু বন্যার কারণে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ফেনীর কিছু অংশে পানি থাকায় যানচলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এতে তিনি ছাগলনাইয়া উপজেলার লেমুয়ার এক জায়গাতেই বাসের মধ্যে ১৬ ঘণ্টা বসে ছিলেন।
শুক্রবার (২৩ আগস্ট) সকালে চার ঘণ্টা কোমর ও বুক সমান পানি ভেঙে কয়েকবার যানবাহন পাল্টে প্রায় পাঁচ ঘণ্টার চেষ্টায় কুমিল্লায় পৌঁছাতে সক্ষম হন সামছুল আলম নামের ওই ব্যক্তি।
শুধু তিনিই নন, এরকম হাজার হাজার মানুষের দুর্ভোগের রাত-দিন কেটেছে এই মহাসড়কে। তবে সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে নারী-শিশুদের।
সামছুল আলম বলেন, কিছুটা অস্বস্তি নিয়েই তিনি বৃহস্পতিবার সকাল ৯টায় হানিফ পরিবহনের একটি বাসে করে কুমিল্লার উদ্দেশে কক্সবাজার থেকে রওনা দেন। চট্টগ্রামের বারইয়ারহাট পার হওয়ার পরই মহাসড়কের কয়েকটি স্থানে পানি দেখতে পান। ওইদিন বিকেল সাড়ে ৩টায় তাদের বহনকারী বাসটি ফেনীর ছাগলনাইয়া উপজেলার লেমুয়া নামক স্থানে পৌঁছে। এরপর থেকে একই স্থানে পরদিন শুক্রবার সকাল ৭টা পর্যন্ত অপেক্ষা করলেও বাসটি আর এক ইঞ্চিও সামনে আগাতে পারেনি।
বাধ্য হয়ে বাস থেকে নেমে শুক্রবার সকাল ৭টার দিকে হেঁটেই সামনের দিকে রওনা দেন তিনি। কিছুদূর যেতেই দেখেন মহাসড়ক ভাসছে পানিতে। শুরুতে হাঁটু ও কোমর সমান পানি হলেও একটু দূর যেতেই বুক সমান পানি। সেই সঙ্গে রয়েছে পানির তীব্র স্রোত।
প্রায় চার ঘণ্টা এমন পানির পথ মাড়িয়ে ফেনী সদরের মহিপাল এলাকায় পৌঁছান সামছুল। এরপর বিভিন্ন যানবাহনে ভেঙে ভেঙে এদিন দুপুরে কুমিল্লায় পৌঁছান তিনি। বাসায় এসে শুক্রবার বিকেলে খবর নিয়ে জানতে পারেন, তাকে বহনকারী বাসটি এখনো আগের জায়গাতেই দাঁড়িয়ে আছে।
আরো পড়ুন: বন্যা দুর্গতদের মধ্যে স্বেচ্ছাসেবক দলের ত্রাণ বিতরণ
ফেনীর ছাগলনাইয়া উপজেলার লেমুয়া থেকে মহিপাল পর্যন্ত এলাকাটি প্রায় সাড়ে আট কিলোমিটার। এর মধ্যে অন্তত ছয় কিলোমিটার মহাসড়কই বৃহস্পতিবার দুপুর থেকে টানা বৃষ্টি ও ভারত থেকে নেমে আসা পানিতে ভাসছে। পরিস্থিতি খারাপ হওয়ায় বন্ধ রয়েছে মহাসড়কের যানচলাচল। এরই মধ্যে তীব্র স্রোতে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এই মহাসড়ক।
ঘটনাস্থলে থেকে দেখা গেছে, মানুষের এই দুর্ভোগ ছিলো অবর্ণনীয়। ভুক্তভোগীদের ভাষ্য, এমন ভয়াবহ দুর্ভোগে আগে তাদের কেউই পড়েননি। আর স্থানীয়রা বলছেন, মহাসড়কে এমন পানি উঠতে আগে কখনো দেখেননি তারা।
সামছুল আলম বলেন, বৃহস্পতিবার বিকেল থেকেই আমার মতো হাজার হাজার যাত্রী এই ভয়ানক বিপদের মধ্যে পড়েন। তবে সবচেয়ে বেশি বেকায়দায় পড়েছেন নারী ও শিশুরা। আশপাশের বাড়িঘর সব কিছু পানির নিচে। বানভাসি মানুষ তাদের গবাদি-পশু নিয়ে মহাসড়কের ডিভাইডারে আশ্রয় নিয়েছেন। আশপাশে কোথাও কোনো খাবারের দোকান নেই। পুরো রাতটা কেটেছে আতঙ্কের মধ্যে।
তিনি বলেন, সকালে যখন ঝুঝলাম যানচলাচল সহজে শুরু হবে না, তখন ঝুঁকি নিয়েই হেঁটে রওনা হই। কোমর ও বুক সমান পানিতে প্রায় চার ঘণ্টা হেঁটে অবশেষে বাসায় ফিরতে পেরেছি। ফেরার সময় দেখেছি লালপোল এলাকায় এক দম্পতি তাদের শিশু সন্তানসহ ভেসে যান। পরে কিছুদূর গিয়ে স্বামী-স্ত্রী গাছের সঙ্গে আটকে গেলেও তাদের শিশু সন্তানের শেষ পরিণতি কী হয়েছে- সেটা বলতে পারবো না।
ওই এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, দুইদিক মিলিয়ে অন্তত ৫০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে কয়েক হাজার যানবাহন আটকে রয়েছে। বৃহস্পতিবার দুপুরের পর থেকে এখানে এসে আটকেপড়া যানবাহনগুলোর বেশিরভাগই দূরপাল্লার বাস। শতাধিক বাস ও ট্রাক পানি পার হতে গিয়ে বিকল হয়ে পড়ে রয়েছে মহাসড়কে।
আরো পড়ুন: সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টারে ফেনী থেকে আনা সেই নারী মা হলেন
এ ছাড়া কোথাও কোথাও লাশবাহী গাড়ি ও অ্যাম্বুলেন্সও দাাঁড়িয়ে ছিলো দুদিন ধরে। তীব্র স্রোতের কারণে মহাসড়কের বিভাজকে থাকা গাছগুলো উপচে পড়েছে। বিভাজকগুলোর মাটি স্রোতে ভেসে গেছে। এরপরও পানির মধ্যে নিজেদের গবাদি-পশু নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন বানভাসি মানুষ। আশপাশে কোথাও নেই খাবারের দোকান। দু-একটি দোকান যা ছিলো- সেগুলোর খাবার বৃহস্পতিবার বিকেলের মধ্যেই মানুষজন কাড়াকাড়ি করে কিনে নিয়ে গেছেন। আশপাশে শৌচাগার না থাকায় নারীরা পড়েন চরম বেকায়দায়। কারণ আশপাশের সব বাড়িঘরও পানিতে তলিয়ে গেছে।
শুক্রবার দুপুরে ভুক্তভোগী আরেক যাত্রী বলেন, পানি কখন কমবে সেই অপেক্ষায় মানুষ সারাদিন সারারাত বাসে বসে ছিলাম। পেছনে গাড়ির দীর্ঘ সারি এবং উল্টোপথও ব্লক হয়ে থাকায় ফিরে যাওয়ারও উপায় নেই। যার কারণে বাধ্য হয়ে বেশিরভাগ মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দীর্ঘ স্রোতের পথ পানি মাড়িয়ে গন্তব্যে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। যানচলাচল বন্ধ থাকার বিষয়টি আগে জানলে রওনা হতাম না।
বৃহস্পতিবার বিকেল থেকেই ওই এলাকায় খাদ্য সংকট তীব্র হয়ে পড়ে। রাতে খাবারের অভাবে প্রায় প্রতিটি বাসেই আটকেপড়া শিশুদের কাঁদতে দেখা গেছে। এতে শিশুদের অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে পড়ে। অনেক শিশু অসুস্থ হয়ে পড়ে। কিন্তু তাদের চিকিৎসা বা সহায়তা দেয়ার মত কোনো পরিস্থিতি ছিলো না। এতে শিশুদের নিয়ে বাবা-মা অসহায় অবস্থার মধ্যে পড়েছেন।
ফেনী শহরের বাসিন্দা আলাল নামে এক অটোরিকশা চালক বলেন, আমার বয়স ৫৫ বছর; এই বয়সে কখনো ফেনী শহর বা মহাসড়কে এভাবে পানি উঠতে দেখিনি। মহাসড়কে চলাচলকারী যাত্রীদের এমন ভয়াবহ দুর্ভোগ আগে কখনো দেখিনি। এতো পরিমাণ মানুষ যে কোনো দোকানে এক প্যাকেট বিস্কুটও ছিলো না। শুক্রবার সকালে মহিপাল এলাকায় অনেক স্বেচ্ছাসেবীদের মানুষের জন্য শুকনো খাবার নিয়ে আসতে দেখেছি।
শুক্রবার বিকেলে লেমুয়া এলাকায় আটকে থাকা বাস চালক হুমায়ুন কবির বলেন, এমন দুর্ভোগে জীবনে কখনো পড়িনি। বৃহস্পতিবার বিকেল থেকে গাড়ি নিয়ে একই স্থানে দাঁড়িয়ে আছি। মনে হচ্ছে আজ রাতও এখানেই কাটাতে হবে। কখন ঢাকায় ফিরবো বলতে পারছি না। ৪২ জন যাত্রী নিয়ে কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম থেকে এসেছি। এখনো কয়েকজন গাড়িতে বসে আছেন। বাকিরা নিজ দায়িত্বে পানি পার হয়ে চলে গেছেন। এই দুর্ভোগ বর্ণনা করে শেষ করা যাবে না।