ফিলিস্তিনে ইসরাইলের বর্বর হামলার প্রতিবাদে ঢাকায় সভা

কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০১ নভেম্বর ২০২৪, ০৫:৪৭ পিএম

ছবি: ভোরের কাগজ
ফিলিস্তিন ও লেবাননে ইসরাইলের অব্যাহত বর্বর হামলার প্রতিবাদে ‘মহান নেতা ইসমাঈল হানিয়া, সাইয়্যেদ হাসান নাসরুল্লাহ ও ইয়াহিয়া ইবরাহীম হাসান আস সিনওয়ারসহ শীর্ষ নেতৃবৃন্দের শাহাদাত এবং গাজা-ফিলিস্তিনকেন্দ্রিক প্রতিরোধ অক্ষের অর্জন’ শীর্ষক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। শুক্রবার (১ নভেম্বর) সকালে আল-কুদস কমিটি বাংলাদেশের উদ্যোগে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) মিলনায়তনে এ সভা হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) দর্শন বিভাগের চেয়ারম্যান ও আল কুদস কমিটি বাংলাদেশের সভাপতি অধ্যাপক ড. শাহ্ কাউসার মুস্তাফা আবুলউলায়ীর সভাপতিত্বে সভায় আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ইরানের আল মুস্তফা (সা.) আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশ কান্ট্রি ডিরেক্টর হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলেমিন শাহাবুদ্দীন মাশায়েখী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের সিনিয়র প্রফেসর ড. কেএম সাইফুল ইসলাম খান, খেলাফত মজলিসের মহাসচিব অধ্যাপক ড. আহমদ আব্দুল কাদের, দৈনিক আজকের ভোলা সম্পাদক অধ্যক্ষ মুহাম্মাদ শওকাত হোসেন, ইসলামী শিক্ষা উন্নয়ন পরিষদ, বাংলাদেশের সভাপতি অধ্যক্ষ ড. একেএম মাহবুবুর রহমান প্রমুখ।
আলোচনা সভায় প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন দৈনিক ইনকিলাবের সিনিয়র সহকারী সম্পাদক জামাল উদ্দিন বারী। এতে ইরানের আল মুস্তফা (সা.) আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশ কান্ট্রি ডিরেক্টর হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলেমিন শাহাবুদ্দীন মাশায়েখী বলেন, ৭০ বছরের অধিক সময়কাল ধরে যায়নবাদী ইসরাইল ফিলিস্তিনের জনসাধারণের ওপর নির্যাতন চালিয়ে আসছে। তাদের ভূখণ্ড জবরদখল করে যাচ্ছে। আরব-ইসরাইল যুদ্ধে পরাজয়ের পর প্রথমে মিশর ও জর্ডান এবং এরপর আরব বিশ্বের দেশগুলো ইসরাইলমুখী হয়ে পড়ে। কিন্তু গত বছরের ৭ অক্টোবর ইসরাইলে হামাসের আক্রমণের পর পরিস্থিতি সম্পূর্ণরূপে পরিবর্তিত হয়ে যায়। যেখানে আরব বিশ্ব মাত্র কয়েক দিনে পরাজিত হয়েছিল সেখানে ফিলিস্তিনের যোদ্ধারা মাসের পর মাস প্রতিরোধ সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, ফিলিস্তিনের পাশে লেবাননের হিজবুল্লাহ, ইয়েমেনে হুথি, ইরাকের প্রতিরোধ যোদ্ধারা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করছে। আর ইরান সরাসরি ইসরাইলের সামরিক স্থাপনাগুলোতে আক্রমণের মাধ্যমে ইসরাইলকে কোণঠাসা করে ফেলেছে। এসব আক্রমণে ইসরাইলের সামরিক শক্তি ও তাদের তথাকথিত শক্তিশালী এয়ার ডিফেন্সের দুর্বলতা স্পষ্টভাবে ধরা পড়ছে।
হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলেমিন শাহাবুদ্দীন মাশায়েখী বলেন, প্রতিরোধ যোদ্ধাদের মোকাবিলায় ইসরাইলের অর্থনীতিতে চরম ধস নেমেছে। প্রবৃদ্ধির হার নিম্নগামী হয়ে পড়েছে। সামরিক ব্যয় মেটাতে তাদের অর্থনীতি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। আতঙ্কে ইহুদিরা ইসরাইল ত্যাগ করে অন্য দেশে চলে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, কিছু দেশ মৌখিকভাবে ফিলিস্তিনকে সমর্থন করার কথা বলে ইসরাইলের সঙ্গে সবধরনের সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে। ইসরাইল ও তার দোসরদেরকে নিজেদের ভূমি ব্যবহার করে ফিলিস্তিন ও প্রতিরোধ আন্দোলনের জন্য সংগ্রামরত দেশগুলোতে আক্রমণের সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছে। এরকম কপটতা পরিহার করে যদি সত্যিকার অর্থে মুসলমানরা একতাবদ্ধ হয়ে যায়নবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে তাহলেই মুসলমানরা সফল হতে পারে।
খেলাফত মজলিসের মহাসচিব প্রফেসর ড. আহমদ আব্দুল কাদের বলেন, গত বছরের অক্টোবর মাসের আগে আরব বিশ্বের পরিস্থিতি এমন হয়ে পড়েছিল যে, কতিপয় আরব দেশ ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয়ার চিন্তা করতে থাকে। কিন্তু অক্টোবর মাসের যুদ্ধ সব হিসাব নিকাশকে বদলে দেয়। আরব দেশগুলো নিজেদের পরিকল্পনা থেকে দূরে সরে আসতে বাধ্য হয়।
তিনি বলেন, মুসলিম দেশগুলো ঐক্যবদ্ধ না হলে ফিলিস্তিন মুক্ত করা সম্ভব নয়। আর মুসলমানদের ঐক্য সৃষ্টি না হওয়ার পেছনে কারণ হলো দেশগুলোতে ইসলামপন্থী সরকার না থাকা। যদি দেশগুলোতে ইসলামপন্থী সরকার থাকত তবে মুসলমানরা একতাবদ্ধ হওয়ার সুযোগ লাভ করত।
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের উদাহরণ টেনে খেলাফত মজলিসের মহাসচিব বলেন, ইরানে বিপ্লব হওয়ার কারণেই তাদের পক্ষে সম্ভব হয়েছে মজলুম ফিলিস্তিনের পাশে দাঁড়ানোর।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের চেয়ারম্যান ও আল কুদস কমিটি বাংলাদেশের সভাপতি অধ্যাপক ড. শাহ্ কাউসার মুস্তাফা আবুলউলায়ী বলেন, মুসলিম বিশ্বে বর্তমানে যে সংকট বিরাজ করছে তা মোকাবিলায় মুসলমানদের ঐক্যের বিকল্প নেই। মুসলিম দেশসমূহ ঐক্যবদ্ধ হওয়ার মাধ্যমেই কেবল দানবীয় ইহুদিবাদী আগ্রাসনকে প্রতিহত করা সম্ভব।
তিনি বলেন, ন্যাটোর ন্যায় মুসলিম দেশগুলোর একটি সামরিক জোট গঠন করা এখন সময়ের দাবি। ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো অর্থনৈতিক জোট গঠন করে মুসলিম দেশসমূহ অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন করতে পারে। সমস্ত মুসলিম উম্মাহকে আল্লাহর হুকুম মোতাবেক সম্মিলিত হতে উদাত্ত আহবান জানান খেলাফত মজলিসের মহাসচিব।
ইসলামী শিক্ষা উন্নয়ন পরিষদ, বাংলাদেশের সভাপতি অধ্যক্ষ ড. একেএম মাহবুবুর রহমান বলেন, ইমাম খোমেইনী (রহ) মুসলমানদের দুর্বলতার অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন যে, মুসলমানরা তাদের শত্রু-মিত্র চিনতে পারে না। আর যারা চিনতে পারে তারা শাসনক্ষমতাকে আঁকড়ে থাকার লোভে ইসলামের শত্রুদেরকে সহযোগিতা করে। তাই আমাদের প্রয়োজন শত্রু-মিত্রকে চেনা। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে ফিলিস্তিন প্রসঙ্গ আসা দরকার যাতে তরুণ প্রজন্ম এ বিষয়ে জানতে পারে, সচেতন হতে পারে।
অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের সিনিয়র প্রফেসর ড. কেএম সাইফুল ইসলাম খান বলেন, মুসলমানরা নিজেদের কর্মের দ্বারাই নিজেদের পরিচয় হারিয়ে ফেলেছে। মহান আল্লাহ বলেন, তোমরাই বিজয়ী হবে যদি তোমরা মুমিন হও। অথচ আমাদের ইমান দুর্বল হয়ে গেছে। আমরা বস্তুগত বিষয় নিয়ে এত ব্যস্ত হয়ে পড়েছি যে, মূল বিষয় ছেড়ে অন্য বিষয়ে মত্ত হয়ে পড়েছি। ইয়েমেনের অর্থনীতি দুর্বল হওয়া সত্ত্বেও সেদেশের জনগণ ইমানের বলে বলীয়ান হয়ে ফিলিস্তিনের পাশে দাঁড়িয়েছে। অথচ আরব বিশ্ব নীরব।
তিনি বলেন, আল্লাহ আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন একতাবদ্ধ হওয়ার জন্য, কিন্তু আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছি। এর পেছনে ইসরাইলের ষড়যন্ত্রও সবার কাছে স্পষ্ট। আর আল্লাহ তাআলার আদেশের বিপরীতে গিয়ে সফল হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই নেই।
দৈনিক আজকের ভোলা পত্রিকার সম্পাদক অধ্যক্ষ মুহাম্মাদ শওকাত হোসেন বলেন, ইসলাম ও মুসলমানদেরকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র হিসেবেই ফিলিস্তিনের পবিত্র ভূমিতে ইহুদিদের পুনর্বাসনের পরিকল্পনা করা হয়। সেই থেকে দখল ও নির্যাতন চলে আসছে। মুসলিম বিশ্ব কার্যকর ভূমিকা পালন করতে ব্যর্থ হয়। ফিলিস্তিনের মুক্তি আন্দোলনের জন্য সংগঠন গড়ে উঠলেও তারা আপোষকামী হয়ে ওঠে।
তিনি বলেন, ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামি বিপ্লবের পর ইমাম খোমেইনী রমজান মাসের শেষ শুক্রবার জুমআতুল বিদায় ‘আল-কুদস দিবস’ পালনের আহ্বান জানান। একই সঙ্গে মুসলমানদের ঐক্যের জন্য আহ্বান করেন। ইরানের ইসলামি বিপ্লবের চেতনায় হামাস গড়ে উঠলে ফিলিস্তিনের মুক্তি আন্দোলন গতি পায়। ইন্তিফাদা শুরু হয়।
অধ্যক্ষ মুহাম্মাদ শওকাত হোসেন বলেন, গত বছরের অক্টোবরে হামাস ইসরাইলে আক্রমণ করলে ইসরাইল দুটি পদক্ষেপ নেয়। একটি হলো নির্বিচারে সাধারণ জনগণকে হত্যা করার মাধ্যমে জনগণের মধ্যে হামাসের প্রতি অসন্তোষ সৃষ্টি করা। আর দ্বিতীয়টি হলো আন্দোলনের নেতাদেরকে হত্যা করা। এরই ধারাবাহিকতায় তারা ইসমাইল হানিয়া, ইয়াহিয়া সিনওয়ারকে হত্যা করে। এক্ষেত্রে আমাদের স্মরণ করা প্রয়োজন যে, যায়নবাদী ইসরাইল সবসময়ই মানুষ হত্যা করে চলছিল। কিন্তু বিশ্বের দৃষ্টি এদিকে ছিল না। হামাসের এই যুদ্ধের মাধ্যমে প্রাথমিক সফলতা অর্জিত হয়েছে। হামাসের পাশে হিজবুল্লাহ, হুথি, ইরাক ও সিরিয়ার যোদ্ধারা রয়েছে। সবচেয়ে বড় সমর্থন জুগিয়ে চলছে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান।
সভায় প্রবন্ধ উপস্থাপক দৈনিক ইনকিলাবের সিনিয়র সহকারী সম্পাদক জামাল উদ্দিন বারী বলেন, ইসরাইলী আগ্রাসনে গত ১৩ মাসে মুসলমানদের পূণ্যভূমি ফিলিস্তিনের গাজা শহরকে ধ্বংস স্তুপে পরিণত করা হয়েছে। নির্বিচার হত্যা করা হয়েছে প্রায় ৪৫ হাজার ফিলিস্তিনিকে। এদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু। ইসরাইলী বোমায় লক্ষাধিক ফিলিস্তিনি আহত হয়েছে। গাজা উপত্যকার বিশ লাখের বেশি মানুষকে উদ্বাস্তু চরম খাদ্য সংকট, দুর্ভিক্ষ ও মানবেতর জীবনে ঠেলে দেয়া হয়েছে। সেখানে ইরান ছাড়া আর কোনো আরব দেশকে সামরিক-অর্থনৈতিক সহায়তা নিয়ে ফিলিস্তিনিদের পাশে দাঁড়াতে দেখা যাচ্ছে না। এ এক বিষ্ময়কর বাস্তবতা।
তিনি বলেন, বিশ্বজনমত ফিলিস্তিনিদের পক্ষে থাকলেও আরব শাসকরা এখনো ইঙ্গ-মার্কিনীদের কৃত্রিম দোস্তি ত্যাগ করে আল আকসা ও আরব ফিলিস্তিনীদের রক্ষায় দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিতে পারেনি। ফিলিস্তিনি শিশুদের হত্যা করতে যারা নিঃশর্তভাবে শত শত কোটি ডলারের বিদ্ধংসী মারনাস্ত্র সরবরাহ দিয়ে যাচ্ছে, তাদের সাথে সদ্ভাব পরিত্যাগ করে মুসলমানদের সম্মিলিত স্বার্থের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে না পারলে আগামি কয়েক দশকে ফিলিস্তিন, লেবানন, জর্ডান এবং সিরিয়ার জনগণের ওপর জায়নবাদী আগ্রাসনে মানবিক বিপর্যয় দেখা দিতে পারে। তাই ইসরাইলের অব্যাহত এই আগ্রাসন মোকাবেলায় বিশ্বের মুসলমানদের ঐক্যের বিকল্প নেই।
ফিলিস্তিন ও লেবাননে ইসরায়েলি সেনাদের অব্যাহত গণহত্যা অভিযানের তীব্র নিন্দা জানান তিনি। অবিলম্বে এই হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করতে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহ ও ইসলামী দেশগুলোকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। ইসরাইলের অব্যাহত পাশবিক হামলার প্রতিবাদে ফিলিস্তিন ও লেবাননের সংগ্রামী জনতার প্রতিরোধ আন্দোলনের প্রশংসা করে জামাল উদ্দিন বারী বলেন, মাতৃভূমি রক্ষায় ফিলিস্তিন ও লেবাননের মুজাহিদদের রক্ত বৃথা যেতে পারে না। আল্লাহর রহমত তাদের সাথে রয়েছে। বিজয় তাদের আসবেই।
আলোচনাসভার শুরুতেই ফিলিস্তিনের ওপর এক প্রামাণ্যচিত্র দেখোনো হয় এবং সভা শেষে ইসরাইলের বিরুদ্ধে প্রেসক্লাবের সামনে থেকে একটি প্রতিবাদ মিছিল বের হয়ে তা জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে গিয়ে শেষ হয়।